জাতকের নাম: তিকিতাকা।
পিতৃপরিচয়: জোহান ক্রুয়েফ।
নামকরণ: স্প্যানিশ ভাষ্যকার আন্দ্রে মন্তেস।
কাকা-জেঠু: লুই আরাগোনেস, পেপ গুয়ার্দিওলা।
বিশেষ কৃতিত্ব: ইউরোপিয়ান কাপ, লা লিগা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ এবং অবশ্যই বিশ্বকাপ জয়।
জন্ম: ১৯৮৮, জুলাই (সঠিক দিন বলা সম্ভব নয়)।
অফিশিয়াল বার্থ সার্টিফিকেট: ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ।
মৃত্যু: ২০১৪, ১৮ জুন।
আন্তর্জাতিক ফুটবল দুনিয়ায় বুধবার থেকে শুরু কোরাস তাই বলছে— ইনিয়েস্তারা টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেওয়ার সঙ্গেই তিকিতাকারও মৃত্যু ঘোষণা হয়ে গেল। বায়ার্ন মিউনিখের ঘরের মাঠে বিপর্যয় থেকেই সে ভেন্টিলেটরে চলে গেছিল। মারাকানা নামক মৃতস্বপ্নের সুবিখ্যাত ভাগাড়ে তার এ বার সলিলসমাধি ঘটল। ঠিক যেমন ১৯৫০ সালে এ মাঠে ঘটেছিল ব্রাজিলীয় বিশ্বকাপ-স্বপ্নের।
বিশ্বব্যাপী আলোচনার মাপকাঠিতে তিকিতাকা বহু দিনই রেনাস মিশেলস প্রবর্তিত টোটাল ফুটবলকে হারিয়ে দিয়েছে। গত কয়েক বছর তা আরওই আলোচিত হতে হতে বুধবার যেন অনেকে তার প্রামাণ্য ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন। ব্রাজিলীয় ফুটবল সমাজের হাবভাব দেখে কিন্তু মনে হল না তারা সেই কোরাসে গলা মেলাতে এতটুকু আগ্রহী বলে।
সত্যি-মিথ্যে জানি না, কোনও একটা ব্রাজিলীয় চ্যানেলে নাকি জর্জিনহো বলেছেন, “তিকিতাকার মৃত্যুতে এত বিস্ময়ের কী আছে! এটা তো হওয়ারই ছিল। বাড়ির পোষ্য কখনও বাড়ির লোকের চেয়ে বেশি বাঁচে নাকি?” সাংবাদিকদের মুখে শুনলাম বলেই নয়। এই ভঙ্গিতে কোনও ব্রাজিলীয় ফুটবলার তিকিতাকার বিরুদ্ধে বলবে, শুনে আশ্চর্য লাগছে।
মুখ্য কারণ, বার্সা এদের খুব ভালবাসার ক্লাব। অতীতে একটা সময় ছিল যখন ব্রাজিলীয় ফুটবলে একটা ইগো কাজ করত যে, আমরা হলাম বিশ্বসেরা। আমাদের আবার অন্যের খেলার মডেল কপি করতে হবে কেন? ওয়েস্ট ইন্ডিজ যেমন আজও বিদেশ থেকে ফাস্ট বোলার ট্রেনিং দিতে আসবে শুনলে সাম্রাজ্যের এমন পড়তি অবস্থাতেও খিঁচিয়ে আসে। আধুনিক ফুটবল ব্রাজিল সেই ইগো-মুক্ত।
তারা বরং মনে করে, যেহেতু আমাদের আগের সেই সোনার দল নেই যে তিনটে টাচে বিপক্ষ পেনাল্টি বক্সে পৌঁছে দেবে, তা হলে পাসিং গেমটা খারাপ কী? টোস্টাও যাঁকে একটা সময় হোয়াইট পেলে বলা হত, তিনি গত বছর অবধি বলে এসেছেন, “ব্রাজিলের উচিত তিকিতাকা খেলে মাঠটাকে বড় করা। নইলে ওরা খেলার ধকল নিতে পারবে না। আমাদের আর ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে খেলার সেই টিম নেই।”
বিশ্বকাপ এমনিতে এমন একটা কুম্ভমেলার মতো ব্যাপার আর মিডিয়া ব্যবস্থায় যেহেতু পেশাদারিত্বের অভাব এবং তার সঙ্গে বিকট ভাষা-সমস্যা, জানা গেল না জোহান ক্রুয়েফ এখানে এসেছেন কি না। মহা-আলোচিত এই সিস্টেমের তিনিই জন্মদাতা। আজকের দিনে একটা মন্তব্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হত যে, চব্বিশ বছর পুরনো সিস্টেমকে ফেলে কি ফুটবল এগিয়ে গিয়েছে? নাকি যন্ত্র আগের মতো কাজেরই আছে, দক্ষ যন্ত্রী নেই?
প্রবাদ অনুযায়ী ২০০৬ বিশ্বকাপে স্পেন বনাম তিউনিশিয়া ম্যাচ থেকে এই অভিব্যক্তির জন্ম। যখন স্পেনিয়ার্ডরা টুকটুক করে নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট পাসে খেলেছেন, প্রয়াত ভাষ্যকার আন্দ্রে মন্তেস বলতে থাকেন, তি-কি-তা-কা, তি-কি-তা-কা... বলা হয়ে থাকে এই সময় সিস্টেমের মাধ্যমে সেই সব ফুটবলাররাও শ্রেষ্ঠত্বের সুযোগ পায়, যারা বড় চেহারার নয়। তেমন লম্বা নয়, কিন্তু টেকনিক্যালি নিখুঁত। যেমন মেসি। যেমন জাভি। যেমন ইনিয়েস্তা। যেমন ফাব্রেগাস।
ইন্টারেস্টিং হল, ভারত মনে করে এই তিকিতাকা পদ্ধতিতে খেলেই তারা জাতীয় ফুটবল কৃতিত্বের শেষ কোহিনুরে হাত দিতে পেরেছিল। বাষট্টির এশিয়ান গেমস জয় নাকি সম্ভব হয়েছিল এই পাসিং নির্ভর সিস্টেমের জন্য। কলকাতা থেকে পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় বলছিলেন, “রহিম সাহেবকে এই জন্য ভারতের সর্বকালের সবচেয়ে দূরদর্শী কোচ মানি। উনি সেই কবেই আমাদের বলতেন ইউরোপ-লাতিন আমেরিকা তো বটেই, ফিজিক্যালি অনেক ফিট কোরিয়া-জাপানের সঙ্গে স্বাভাবিক খেলে ওদের হারাতে পারবে না। বল দখলের খেলায় যাও। চার-পাঁচটা পাস নিজেদের মধ্যে খেলতে খেলতে তার পর পেনিট্রেটিভ জোনে চলে যাও।”
চুনী গোস্বামী— বাষট্টির সোনাজয়ী অধিনায়কও তাই মনে করেন যে, রহিমের চোখ যুগান্তকারী ছিল। চুনী বলছিলেন, “ক্যালকাটা ফুটবলের সেই সময় ব্রিটিশ-নির্ভর লম্বা বল স্টাইলে খেলা হত। জাতীয় দলে রহিম সাহেব সেটা পুরো বদলে দেন। উনি ছোট ছোট পাসে আমাদের খেলানো প্রথম শুরু করেন। বারবার বলতেন মাঠটাকে বড় করো। স্ট্রেচ করো নিজেদের মধ্যে পাস খেলে খেলে। দেখবে কত সুবিধা পাও। তখন কোনও দিন স্বপ্নেও ভাবিনি, এক কালে এর উন্নততর ভার্শানকেই বলা হবে তিকিতাকা। আর সেই সিস্টেম বিশ্বব্যাপী এত জনপ্রিয় হবে।”
আর্মান্দো কোলাসো গোয়া থেকে ফোনে বলছিলেন, “ডেম্পোর কোচ থাকাকালীন আমি চেষ্টা করেছি এই সিস্টেমে খেলতে। সাফল্যও পেয়েছি। তবে এই সিস্টেমে খেলতে দুটো জিনিস লাগবে। প্রথমত একটা সেট টিম লাগবে যারা কয়েক বছর খেলে খেলে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়াটা খুব ভাল করে ফেলেছে। দুই, টেকনিক্যালি সেই প্লেয়ারদের প্রায় নিখুঁত হতে হবে।” মোহনবাগান কোচ এই ব্যাপারে ইস্টবেঙ্গল কোচের সঙ্গে এক মেরুতে। সুভাষ ভৌমিকও মনে করেন, চুনীর দল-পরবর্তী ভারত যে এই সিস্টেম অক্ষত রাখতে পারেনি কারণ সেই কোয়ালিটির এক ঝাঁক প্লেয়ার আর একসঙ্গে আসেনি।
ব্রাজিলে বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের মত হল, সিস্টেমের জন্য স্পেন হারেনি। হেরেছে তারুণ্যের টগবগানি হারিয়ে ফেলা একদল তারকা প্লেয়ার। যারা সিস্টেমের যোগ্য থাকতে পারেনি।
প্লাস কোচের ভুল সিদ্ধান্তে। তাদের মতে, সামনে দিয়েগো কোস্তাকে রেখে তিকিতাকা সম্ভব নয়। দু’ম্যাচে ১৩৯ মিনিট মাঠে থেকে কোস্তা একটাও গোলে শট নিতে পারেননি। শুধু সে জন্য নয়, তাঁর খেলার ধরনটা যে ইংলিশ ফুটবলের মতো। তিকিতাকার সঙ্গে যায় না, এটা দেল বস্কির বোঝা উচিত ছিল। শুনে মনে পড়ে গেল, টোস্টাও যখন ব্রাজিলের তিকিতাকা খেলার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, তখন তিনিও গত বছর বলেছিলেন, “ফ্রেডকে কিন্তু তা হলে বলি দেওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে। তিকিতাকা খেলার যোগ্যতা ওর নেই।”
শেষ পর্যন্ত এটাই দাঁড়াল যে, তিকিতাকা সাময়িক স্পেনের সঙ্গে বিদায় নিয়েও সেই থেকে গেল! বিশ্বে যখনই কোনও কোচ অসম্ভব ট্যালেন্টেড একটা দল নিয়েও দেখবেন স্রেফ শরীরে বিপক্ষের কাছে মার খাচ্ছেন, বা উচ্চতায়, আবার তিকিতাকা মন্ত্রের শরণ নেবেন তিনি।
জাভি-ইনিয়েস্তারা তত দিনে নির্ঘাত টিভি বক্সে হঠাৎই আবিষ্কার করবেন বহু দিনের সাথী আবার আসিছে ফিরিয়া!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy