অবহেলায় গ্যারিঞ্চার স্মৃতিসৌধ। সামনেই পড়ে মরা মুরগি। পাও গ্রান্দে গৌতম ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
রোববার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ রিও থেকে পঞ্চান্ন কিলোমিটার দূরের গ্রামটায় যখন ঢুকছি, ভাবছিলাম গ্রামটার নাম এখনও বদলায়নি কেন? পাও গ্রান্দে-র নাম তো গ্যারিঞ্চা গ্রাম হওয়া উচিত।
রিও শহরটা গতকাল রাত থেকে আর্জেন্তিনা অধিগ্রহণ করে নিয়েছে। শুধু নীল-সাদা জার্সি। কোপাকাবানা তটে স্প্যানিশে বিশাল পোস্টার ঝোলানো মারাদোনা ফর প্রেসিডেন্ট। কিন্তু পুঁচকে এই গ্রামে কোনও মেসি নেই। কোনও আর্জেন্তিনা নেই। শুধুই ব্রাজিল আর তাদের ভালবাসার গ্যারিঞ্চা। যাঁকে আদর করে লোকে ‘লিটল বার্ড’ বলত।
গ্রামের প্রবেশমুখেই গ্যারিঞ্চার নামে প্রাইমারি স্কুল। তাঁর আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি। যার গায়ে লেখা: জন্ম ১৯৩৪, মৃত্যু ১৯৮৩। আর একটু এগোতেই গ্যারিঞ্চার নামে পানশালা। যার ওপর লেখা ‘কোপা দে মুন্দো’। এই বিশ্বকাপেই ঘটা করে ব্রাজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ার স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছে গ্যারিঞ্চার নামে। কলকাতায় বসে আমরা চিরকাল জেনে এসেছি, গ্যারিঞ্চা হলেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের মধু কবি। অসম্ভব প্রতিভাবান। অনেকে মনে করেন পেলের চেয়েও বড় প্লেয়ার। কিন্তু বিশৃঙ্খল জীবনের খাজনা গুনতে গিয়ে কখনও নিজের প্রাপ্য পাননি। সেই মানুষটার মৃত্যু পরবর্তী মূল্যায়ন শুরু হল দেশে বিশ্বকাপ হওয়ার সময়!
কিন্তু কে জানত, সেই মূল্যায়নের বহরটা গ্যারিঞ্চার বিখ্যাত বডি ফেন্টিংয়ের মতো! ডিফেন্ডাররা যা ভাবছে, শরীর ঠিক তার উল্টো দিকে ঘুরবে!
বার্বেডোজে হালফিলের ম্যালকম মার্শালের মার্বল খোদাই করা সমাধিক্ষেত্র বাদই দিচ্ছি। সেই ১৯১৫-এ মারা যাওয়া ভিক্টর ট্রাম্পারের সিডনিস্থিত সমাধিও আজ পরিষ্কার, সাফসুতরো। কলকাতায় মধু কবির শেষ শান্তিস্থলে ঢুকুন। পরিষ্কার করে লেখা দাঁড়াও পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!
তিষ্ঠ ক্ষণকাল এ সমাধিস্থলে!
জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম।
এখানে গ্যারিঞ্চার সমাধিটা কাঠের ওপর রং করা। রংটা আবার চটে গিয়েছে। ওপরে মলিন একটা লেখা, যা তর্জমা করে দিলেন সঙ্গে আসা দোভাষী কাম রিও-র পেশাদার ট্যুর গাইড। ‘লিটল বার্ড, অফুরন্ত আনন্দ দেওয়ার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা।’ কিন্তু এই কি কৃতজ্ঞতার ছিরি? অত সকালে রিও-য় ফুলের দোকান খোলেনি বলে একটা ফুলও আনতে পারিনি সঙ্গে করে। কিন্তু এনেই বা কী হত! এত নোংরা চার দিক।
সমাধির ঠিক পাশেই যেখানে আলাদা করে তাঁর জন্য মেমোরিয়াল হয়েছে, যার ছবি গুগল খুললেই পাওয়া যায়, সেখানে রাখা আছে হলুদ ব্রাজিলীয় জার্সি আর এক টুকরো কাগজ ওব্রিগার্দো। পর্তুগিজ ভাষায় ধন্যবাদ... নিজের শহরে বিশ্বকাপ শুরুর দিন এটা তো তাঁর জন্য থাকারই কথা!
ধুর ধুর! ঠিক ওখানেই যত রাজ্যের উচ্ছিষ্ট। দুর্গন্ধে পেটের নাড়িভুঁড়ি উঠে আসে। ওখানে দুটো মুরগি বলি দেওয়া রয়েছে, কোনও এক পরিবার বিদেহী আত্মাকে ডেকে আনতে চায় বলে। ঠিক পাশেই এলাকার মেয়রের মেমোরিয়াল দুর্দান্ত সাজানোগোছানো আর পরিষ্কার। কিন্তু তাঁর, গ্যারিঞ্চার বরাবরের যা ভাগ্য, মৃত্যুর একত্রিশ বছর বাদেও তা বদলায় কী করে? সমাধিস্থলে যাঁরা শবদেহ নীচে নামানোর কাজ করেন, সেই লোকটিও মুখ বিকৃত করে ফেললেন “ছি ছি, এখানেই এ সব করতে হল!”
একটু এগিয়ে সমাধি থেকে দুটো টার্ন নিয়ে গ্যারিঞ্চার আদি ভিটে।
প্রথম জীবনটা এখানেই কাটিয়েছেন এবং গুরুত্ব হিসেবে এত দিনে সরকার সংরক্ষিত হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। খাড়াই জায়গা। গাড়ি ছেড়ে হেঁটে উঠতে হয়। ওপরে পাহাড়। পাশ দিয়ে একটা ঝরনা কুলকুল বইছে। যেমন বইত গ্যারিঞ্চার অবিশ্বাস্য ফুটবল প্রতিভা। একটু এগিয়ে একটা নদী। এমন একটা পরিবেশে তো লোকে ভাবুক হবে, তার ভেতর প্রশান্তি আসবে, কবিতাবোধ না থাকলেও এসে হাজির হতে পারে। গ্যারিঞ্চা এত ভবঘুরে, প্লে-বয় আর মদখোর হলেন কেন?
কিন্তু এই মুহূর্তে তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ব্রাজিলীয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় জাদুকরের ভিটে এত হতচ্ছিন্ন আর পাঁজরা-বার করা কেন? গ্যারিঞ্চার একই সঙ্গে তো পেলে খেলতেন। যাঁর তিন মহাদেশে তিনটে বিলিয়ন ডলার দামি বাড়ি আছে।
কাকার আদি বাড়িটা যিনি দেখাশোনা করেন, সেই ভাইপো হোবার্তো উত্তেজিত ভাবে বললেন, “কন্ট্রিবিউশনে কাকার সঙ্গে পেলের কী তফাত বলুন তো! কাকা দুটো বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন দেশকে। আটান্নর ফাইনালে সুইডেন যখন এগিয়ে গেল, কাকার ড্রিবলেই খেলার গতি প্রথম ঘোরে। আর ১৯৬২-তে তো কাকা একাই জিতিয়েছিলেন। পেলের কোনও কন্ট্রিবিউশন নেই। ব্রাজিল ফুটবলের প্রাক্তনদের জিজ্ঞেস করুন, ওরা বলবে কাকা বেটার প্লেয়ার ছিলেন। অথচ সমাজ কত আলাদা মূল্যায়ন করল ওঁদের।”
হোবার্তো প্রথমে ইন্টারভিউ দিতেই চাইছিলেন না। ভাষা তো কিছুই বুঝছি না। হাত-পা নাড়া দেখে পরিষ্কার, খুব রেগে রয়েছেন। ট্যুর গাইড তর্জমা করলেন, “উনি বলছেন কথা বলে কী লাভ? বিদেশ থেকে কত সাংবাদিক আসে, দেখে। লেখে। আমাদের অবস্থা তো সেই একই থেকে যায়।”
হোবার্তো থাকেন পাশের বাড়িতে আর কাকার আদি ভিটে দেখাশোনা করেন। বাড়ির এমন জীর্ণ দশা, যেন তিনশো বছরের পুরনো। কেন জিজ্ঞেস করায় বললেন, “সারানোর টাকা নেই। কে দেবে? এই তো সরকার কাকার নামে স্টেডিয়াম করেছে। আমাদের একটা নেমন্তন্নর চিঠি অবধি কেউ পাঠায়নি। টিভি দেখে জেনেছি।” মেসিকে দেখতে যাবেন না? “টিকিট কোথায়! আমাদের কি কেউ খোঁজ নেয়?” কথা বলতে বলতে ক্রমশই অভিমানী হয়ে পড়ছেন হোবার্তো। টিনের চাল দেওয়া শতচ্ছিন্ন বাড়ির ভেতরটা ঝুলে ভরা। একটা স্টেশনারি দোকান চালান হোবার্তো। ডান দিকে একটা বড় চৌবাচ্চা। সেখানেও গরমকালে নানান সাঁতার ইভেন্ট করে আয় হয়। সুইমিং পুল বললেন, কিন্তু লম্বায় দশ মিটারের বেশি হবে না। চওড়ায় চার-পাঁচ মিটার। ওটা প্রকৃতিগত ভাবে চৌবাচ্চাই।
এত মলিন অবস্থা পরিবারের আর এই বাড়িটার। আপনারা ব্রাজিলীয় ফুটবল সংস্থাকে বলেন না কেন? বা পেলেকে? একই সঙ্গে ওঁরা আট বছর খেলেছেন। একই রকম বরেণ্য। অথচ পেলে তো ধনকুবের। “পেলে করবে সাহায্য? তা হলেই হয়েছে,” এ বার আরও রেগে গেলেন হোবার্তো। “জীবনে কাকার নামটাও ও উচ্চারণ করে না! কাকার কথা বরং বলে মারাদোনা। আর পেলে? কাকা যখন মৃত্যুশয্যায়, এক বার দেখতে অবধি আসেনি।” হোবার্তো গলা নামিয়ে এ বার বলতে থাকেন, “মানুষ অত স্বার্থপরও হতে পারে! বাবা বলতেন, আটান্নয় পেলে কমবয়সী ছিল বলে কাকা ওকে প্র্যাকটিসে আলাদা করে সময় দিতেন। আর সে-ই কিনা বেমালুম সব ভুলে গেল!”
গ্যারিঞ্চার যৌবনকালে কাটানো বাড়িটা কাছেই। আর সেটা অনেক ভাল। বাড়ির মালিক যে মাত্র ৪৯ বছর বয়সে সিরোসিস অব লিভারে মারা গিয়েছেন। কোনও টাকাকড়ি রেখে যাননি, সেটা বাড়ির বাইরেটা দেখে বোঝার উপায় নেই। শুনলাম স্থানীয় টিভি কোম্পানি গ্যারিঞ্চার ওপর ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করতে চেয়ে কিছু টাকা সাহায্য করেছিল। তারাই বাড়িটা ব্রাজিলীয় জার্সির হলুদ আর সবুজে রং করে দিয়েছে। বাড়ির এক দিকে গ্যারিঞ্চা মিউজিয়াম করেছেন নাতনি আই আলেকসান্দ্রা। সরু একটা ছয় বাই ছয় ফুট ঘরে ধরে রাখার চেষ্টা হয়েছে সেই মানুষটিকে, যাঁর সম্পর্কে বলা হয়, উচ্ছৃঙ্খলতম ফুটবলার হয়েও মানুষকে এত আনন্দ আর কেউ ফুটবল খেলে দিতে পারেনি।
“ফিফা বলুন, ব্রাজিল ফুটবল সংস্থা বলুন, বোটাফেগো ক্লাব বলুন, সবাই আজও ঠাকুরদাকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে। কিন্তু আমাদের জন্য কেউ কিছু করেনি। দেশে বিশ্বকাপ হচ্ছে, অথচ আমাদের কেউ একটা কার্ডও পাঠায় না। পেলের কাছে আশা করি না। ও এত স্বার্থপর যে, পরিবারকেই দেখে না। কিন্তু ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন কেন দেখবে না বলুন তো? দাদুর নামে স্টেডিয়াম বানাচ্ছো, তার মূর্তি গড়ছো, অথচ পরিবারকেই ডাকছো না?” উত্তেজিত ভাবে বলেন আলেকসান্দ্রা। ব্রাজিলীয় মিডিয়ার ওপরও তাঁর রাগ। “আইডলদের মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তো মিডিয়ার।”
এই জাদুঘর কেন রিও-য় করছেন না আলেকসান্দ্রা? অনেক বেশি দর্শক আসবে। টাকা রোজগারও বেশি হবে।
বললেন, “ক’দিন আগে ডাকাতি হয়েছে বাড়িতে। সেই ভাঙা দরজাটাই মেরামত করতে পারছি না তো রিও-য় মিউজিয়াম করব ঘর ভাড়া করে! কী যে বলেন!” জানালেন, দাদুর এত স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি আর সামলাতে পারছেন না। খরচে চালানোও যাচ্ছে না। কাগজে নাকি বিজ্ঞাপনও দিয়েছেন বাড়ি বিক্রি করে দেবেন বলে। চূড়ান্ত অর্থাভাব।
স্তম্ভিত হয়ে ভাবছি, কী কন্ট্রাডিকশন! দেশে যখন গ্যারিঞ্চার নামে ঘটা করে স্টেডিয়াম উদ্বোধন হয়েছে, ক’দিন বাদে সেখানে খেলা— সেখানে তাঁর আদি বাড়ি কিনা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অর্থাভাবে! কেউ খোঁজও রাখে না।
উঠে আসার আগে আলেকসান্দ্রা বললেন, “কিছু দিন না! দাদুর ওপর এত রিসার্চ করলেন। আমাদেরও তো কিছু প্রাপ্য হয়। দরজাটা অন্তত সারাই।”
এমন প্রস্তাবের জন্য তো তৈরি হয়ে যাইনি। স্থানীয় কারেন্সিতে ৫০ রিয়াল দিতে পারি তাঁকে। ভারতীয় মুদ্রায় এক হাজার একশো টাকা মতো। তিনি কি নেবেন?
“নিশ্চয়ই নেব,” জানালেন নাতনি।
বেরিয়ে আসার পরেও মনটা খচখচ করতে লাগল, মাত্র এক হাজার একশো টাকা গ্যারিঞ্চার মতো জিনিয়াসের দাম হতে পারে? নাকি এটাই গ্যারিঞ্চার নিয়তির দুষ্টচক্র যে, সমাধিতে শুয়েও তুমি কখনও নিজের প্রাপ্য পাবে না! তুমি বরাবরের বঞ্চিত —বঞ্চিত আর হতভাগ্যই থাকবে...
গ্যারিঞ্চার গ্যালারি থেকে
আনন্দবাজার এক্সক্লুসিভ
ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy