‘স্বতঃস্ফূর্ত’: বাবরি মসজিদের গম্বুজে উঠে তাণ্ডব। ফাইল চিত্র
যথেষ্ট প্রমাণ নেই। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় লালকৃষ্ণ আডবাণীদের বেকসুর খালাসের পিছনে এই যুক্তি শুনে হেসে বাঁচেন না হাজারিলাল। বুক ঠুকে বলছেন, “করসেবায় ছিলাম। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদে চড়াও হয়েছি। নিজে হাতে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছি একের পর এক গম্বুজ। জামিনে ছাড়া পাওয়ার আগে ১৪ দিন জেল খেটেছি তার জন্য। ওই দিন ওখানে কী হয়েছিল, তা দেখেছে সারা দেশ। সুতরাং, প্রমাণ না-থাকাটা বিষয় নয়। আমরা যে কোনও অন্যায় করিনি, সেই কথাই আজ প্রমাণিত!”
বিতর্কিত জমিতে রামমন্দির গড়তে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ যদি অযোধ্যার করসেবকপুরমে খুশির হাওয়া এনে থাকে, এ দিনের রায় সেখানে ‘অন্যায় দোষারোপ’ থেকে স্বস্তি এনে দিল।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ধর্ম নির্বিশেষে অধিকাংশের প্রথম উত্তর, রামমন্দিরের শিলান্যাস সারা। আর পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কী? কিন্তু নাম না-লেখার শর্তে সামান্য খোঁচানোর পরে সেই তাঁরাই বলছেন, “দিনের আলোয় চড়াও হয়ে মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। হাত গুটিয়ে বসে থাকল পুলিশ-প্রশাসন। লাখখানেক জনতার তাণ্ডব চলল শহর জুড়ে। গোষ্ঠী সংঘর্ষে প্রাণ হারালেন হাজার দুয়েক মানুষ। এই পুরো ঘটনার সূত্রপাত যেখান থেকে, সেখানে কাউকে দোষী খুঁজে পাওয়া গেল না?”
অনেকের প্রশ্ন, পূর্ব পরিকল্পিত না-হলে দিন পনেরো আগে থেকেই লক্ষ লক্ষ লোক অযোধ্যার মতো ছোট শহরে এসে উপস্থিত হল কী ভাবে? অত করসেবকদের জন্য ‘পুরি-সব্জি’ আসত কোথা থেকে? কেন তাদের থাকার জায়গা জোগাত মঠ-মন্দির?
আরও পড়ুন: বিশ্বাস ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠিত: আডবাণী
তিন দশক আগে চোখের সামনে মসজিদ ধ্বংস হতে দেখা হাজি মেহবুব মুষড়ে পড়া গলায় বললেন, “আদালত যা করেছে, নিশ্চয় ঠিকই করেছে। কিন্তু এত লোক বুক বাজিয়ে মসজিদ ‘শহিদ করার’ কথা বলেন। কল্যাণ সিংহ, উমা ভারতীরা এত দাপটের সঙ্গে এত বার বলেছেন ওই দিনের কথা। তবু যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেল না!” তাঁর পড়শির বক্তব্য, “সুপ্রিম কোর্টের মতো এই রায়কেও স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু দোহাই, অনুভূতির কথা জিজ্ঞাসা করবেন না।”
দিনভর সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঘুরপাক খেল ‘রসিকতা’— “তা বেশ। সিবিআইয়ের আদালতই জানাল, ২৮ বছরে যথেষ্ট প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি সিবিআই। ‘দৈব দুর্বিপাকেই’ মসজিদ গুঁড়িয়ে গিয়েছে হয়তো!” গোষ্ঠী সংঘর্ষে প্রিয়জন হারিয়েছেন যাঁরা, তিন দশক পেরিয়েও তাঁরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত রইলেন কি?
আরও পড়ুন: নিশানায় ‘তোতা’ সিবিআই
প্রায় মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে প্রশ্নটা উড়িয়ে দিলেন বিনয় কুমার রাই, ওম প্রকাশ, হাজারিলালরা। তাঁদের পাল্টা বক্তব্য, “শ্রীরামচন্দ্রের জন্মস্থানে তাঁর মন্দির ভেঙে বিদেশি শাসকের গড়া মসজিদ। সেটা পরাধীনতার চিহ্ন নয়? ১৯৯০ সালে করসেবকদের উপরে মুলায়ম সিংহের সরকার গুলি চালানোয় লাল হয়ে গিয়েছিল সরযূ নদীর জল। সেই মৃত্যুর সংখ্যার হিসেব রেখেছে কে?” তাঁদের পাল্টা দাবি, “বহু বছরের পুরনো, নড়বড়ে কাঠামো। কিছু ইট বার করে সামান্য ধাক্কা দিতেই পড়ে গিয়েছিল হুড়মুড়িয়ে। ভেঙেছিলাম বলেই কিন্তু বিবাদ নিষ্পত্তি হল। নইলে রামমন্দির বিতর্ক জিইয়ে থাকত আজও।”
ঘটনার আগের দিন, ৫ ডিসেম্বর লখনউয়ের জনসভায় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বলেছিলেন, “আদালত ভজন-কীর্তন বন্ধ করতে বলেনি। কিন্তু সেটা করতে বসার জন্য আগে জমি সমান করা জরুরি।” লালকৃষ্ণ আডবাণীর বক্তব্য ছিল, “(মন্দির নির্মাণের) সঙ্কল্পপূরণের জন্য যে কোনও ত্যাগ করতে রাজি।” ৬ ডিসেম্বর ঘটনাস্থলের অদূরে বাঁধা মঞ্চ থেকে প্রথমে মৃদু আপত্তি করলেও, পরে ‘এক ধাক্কা অউর দো, বাবরি মসজিদ তোড় দো’র মতো স্লোগান তুলতে দেখা গিয়েছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি নেতাদের। তবু প্রমাণ নেই?
উত্তরে একাধিক করসেবকের দাবি, সে দিন যে আবহ তৈরি হয়েছিল, তাতে নেতাদের কথায় কান দিতে রাজি ছিলেন না কেউ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল দ্রুত।
সেই সময়ের কথা উঠলে, মেহবুব এক কথায় বলেন, “জঙ্গলরাজ।” হয়তো কাকতালীয়। কিন্তু হাজারিলালের বক্তব্য, “সত্তরের দশকে এ তল্লাট জঙ্গল ছিল। দোকান ছিল হাতে গোনা। খেতে পেতেন না অনেক সাধু। এখন অযোধ্যা মন্দিরে ছয়লাপ। প্রায় চার লক্ষ দোকান। জঙ্গল মে হি মঙ্গল হো গয়া ভাইয়া!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy