ছবি: সুব্রত চৌধুরী
এ লেখা মোর শূন্য দ্বীপের সৈকততীর,/ তাকিয়ে থাকে দৃষ্টি-অতীত পারের পানে।/ উদ্দেশহীন জোয়ার-ভাটার অস্থির নীর—/ শামুক ঝিনুক যা পায় তাই কুড়িয়ে আনে।— সৌমিত্র আর আমার অশীতিপর জীবনে, যার এক জন স্রষ্টা আর এক জন দ্রষ্টা, এ পঙ্ক্তিগুলোর গূঢ় তাৎপর্য ক্রমেই ধরা পড়ছে। তবে গৌরবের কথা, দীর্ঘকালের দ্রষ্টা হিসেবে এখন মনে হচ্ছে, আমার এই অভিনেতা বন্ধু তার চলিষ্ণু জীবনধারায় শুধু শামুক-ঝিনুক কুড়োয়নি, বেশ কিছু মণিরত্নও তার জীবনপাত্রে উজ্জ্বল হয়ে আছে। যার যৎসামান্য খানিকটা আমরা পেয়ে এসেছি, পেয়ে চলেছি এখনও, রজতপটে ও মঞ্চে। পুরোপুরি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে তার অনেকান্ত বৈচিত্রে, কথালাপে, উচ্চকিত হাস্যে, রসরসিকতায় কিংবা আত্মবিশ্লেষণে ক’জনই বা পাওয়ার সামর্থ্য রাখে?
যখন পুরোপুরি অভিনয় জগতে সে আসেনি, আমাদের সঙ্গে পড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের এমএ ক্লাসে, নিবিড় আবেগে কবিতা লেখে, তখন এক দিন গিরিশচন্দ্র ঘোষের দুটি অবিস্মরণীয় বচন শুনিয়েছিল। তার একটি: ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়’ আগেও শুনেছি, কিন্তু আর একটি মোক্ষম উক্তি: ‘লোকে কয় অভিনয় তত নিন্দনীয় নয়,/ নিন্দার ভাজন শুধু অভিনেতাগণ।’ দ্বিতীয় অবলোকনটি গিরিশ-যুগে হয়তো নির্মম পরিহাসময় সত্য ছিল কিন্তু গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যখন সৌমিত্র শিশির ভাদুড়ির সাহচর্যে ও মনন-চিন্তনে নিত্য সমৃদ্ধ হয়ে ভেবেচিন্তে তখনকার রীতিমত অনিশ্চিত জীবিকার ভবিতব্যে নিজেকে সমর্পণ করেছিল, তখন কেউ কি ভাবতে পেরেছিল যে, তার অভিনয়জীবন ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে কত স্তরান্বিত, প্রতিভা বিস্ফুরণে সন্দীপ্ত আর সুঠাম? আমরা তার চার পাশের বেশ ক’জন সহপাঠী যখন তখনকার সময়ের অনেকটা নিশ্চিন্ত জীবিকা অধ্যাপনার মসৃণ পথে পা রেখে আত্মতৃপ্ত, তাকে তখন চঞ্চল করে তুলেছে প্রগাঢ় কোনও সৃজনচেতনা— যা মধ্যবিত্ত গড়পড়তা সংবেদনকে ছিন্ন করার সাহস রাখে। এ সাহস সে পেল কোথা থেকে, ভাবলে তখন যতটা চমৎকৃত হয়েছিলাম, এখন তলিয়ে বুঝি, সমকালীন অনেকের চেয়ে সৌমিত্রের আত্মপ্রস্তুতি, স্বপ্ন দেখার সাহস আর উদ্বৃত্ত জীবনীশক্তি অনেক অনেক বেশি ছিল। পারিবারিক সংস্কৃতি, আবৃত্তি ও গান শোনা, বাড়িতে মঞ্চ বেঁধে ঘরোয়া নাটক, শিক্ষানুরাগ, দেশপ্রীতি আর অবিচল মানবতার স্বপ্ন তাকে যে স্থিরলক্ষ্য দিশা দিয়েছিল, তার সঙ্গে পরে কলেজ স্তরে জেগে ওঠে দুর্মর পঠনস্পৃহা, সাহিত্যমগ্নতা, দু-এক জন অধ্যাপক আর সহপাঠীর অমলিন সঙ্গ-সংস্পর্শ। সেই দুর্লভ উপকরণগুলি তাকে এতটাই স্বয়ম্ভর ও আত্মশক্তি দেয় যে, আসন্ন এমএ পরীক্ষার প্রস্তুতিতে তার সহপাঠীরা যখন পর্যুদস্ত, তখন সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নাট্যদল গড়ে, পরিচালনা ও প্রধান ভূমিকাভিনেতা হয়ে দিব্যি চলে গেল দিল্লিতে, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় নাটক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। তাতে তার নাটকই সেরা হল এবং সে হল সেরা অভিনেতা। স্বপ্ন কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের কঠোর ব্যবহারিকতার শিক্ষা তখনই, সেই কুড়ি-বাইশ বছরেই আয়ত্ত হয়ে গেল।
অভিনয় কলা যে নবতর সমাজে ততটা আর নিন্দনীয় থাকল না, সে কথা তত দিনে প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। শিশির যুগ পেরিয়ে নতুন মঞ্চ স্বপ্নে এবং স্বতো-নিরীক্ষায় শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্তের ব্যক্তিত্বে ও সংগঠনে। তার গায়ে গায়ে নবতরঙ্গের চলচ্চিত্র এসে যাবে সত্যজিৎ আর ঋত্বিকের আত্মপ্রত্যয়ী অন্তর্দীপ্তিতে। এসে যাবেন তপন সিংহ। সৌমিত্রও বেতারের সংক্ষিপ্ত জীবিকা ছেড়ে যে রজতপটকে আশ্রয় করবে অচিরে, তার জন্য টালিগঞ্জ মুখিয়ে ছিল। এ হল তার ভাগ্যের আর সংকল্পের সঙ্গে কাকতালে বাঁধা। আমার মনে হয়, বাংলা ফিল্মে রাধামোহনের পরে সৌমিত্র সবচেয়ে উদাহরণীয় মননসমৃদ্ধ অভিনয়শিল্পী এবং সব অর্থে তাঁর মতোই শিক্ষিত ও ধীমান। তবে সেই সঙ্গে সৌমিত্রের অভিনেতা-সত্তার অন্তর্গঠনে কাজ করেছে সচেতন রবীন্দ্রপাঠ আর কবিতাচর্চা। সেই ১৯৫৭-’৫৮ সাল বরাবর বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণে ঘোরতর উত্তমকুমারীয় পেশাদারিত্ব ও গ্ল্যামারের পরিপার্শ্বে সুদর্শন সুকুমার সৌমিত্র ছিল ব্যতিক্রমী রকমের চিন্তক আর বিশ্লেষণপ্রবণ মানসের অধিকারী। ভাগ্য এটাও যে পর পর তিনটে সফল ও শিল্পসম্মত ফিল্ম (‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’, ‘পরশপাথর’) বানাবার পর সত্যজিৎ রায় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে যখন ‘অপুর সংসার’ ছবিতে হাত দিলেন, তখন আর এক অন্বেষী ও প্রত্যয়ী, শিক্ষোৎসুক ও জিজ্ঞাসু যুবককে হাতে পেয়ে গেলেন। স্টুডিয়োয় তার স্বচ্ছন্দ ও অনাড়ষ্ট অভিনয় দেখে তপন সিংহ সৌমিত্রকে কাস্ট করলেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’-এ। এর পরে চলে আসবে আমার কত কালের বন্ধুর ঊর্ধ্বাভিসারের ক্রমবিকাশ।
আর আমি হব তার মুগ্ধ দ্রষ্টা। কত রকম চরিত্র, কত বিচিত্র মেক-আপ, কত ভাবে নিজেকে কাটাছেঁড়া করা। সে এক দিন পরিহাসের ভাষায় আমাকে মজা করে বলেছিল, ‘জানিস তো, সবাই জিজ্ঞেস করে আর ক’টা ছবিতে নামলেন? এ এক অবাক জগৎ, যেখানে যতখানি নামা যায় আসলে ততখানি ওঠা।’ ঝকঝকে হাসির অনুপান মিশিয়ে সে নিজেকে টিপিকাল কৃষ্ণনাগরিক পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত করে নিল।
সৌমিত্রের মধ্যে অভিনয় জগতের সমান্তরালে জাগরূক ছিল এক আদর্শ ভাবনা উদ্রেককারী পত্রিকা সম্পাদনার অভিলাষ। বিএ আর এমএ ক্লাসে তার ঘনিষ্ঠতম সহপাঠী বন্ধু তথা পাড়ার প্রতিবেশী নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে যৌথ সম্পাদকতায় ১৯৬১ থেকে প্রকাশিত ‘এক্ষণ’ আলোড়ন তুলেছিল। সে পত্রিকার লেটারিং-এ প্রতি সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়ের আলাদা আলাদা বিস্ময়কর মৌলিক ক্যালিগ্রাফি এখনও শিল্পোৎসুকদের আলোচ্য, এ ব্যাপারে ষোলো আনা কৃতিত্ব সৌমিত্রের। অথচ নির্মাল্যর সঙ্গে সেই বহু দিনের অত্যাগসহন বন্ধুত্ব থেকে সৌমিত্র কোনও সংগত কারণে সরে আসে, যদিও করে না একটুও অভিযোগ অপপ্রচার। এর কারণ তার অন্তর্গত স্বভাব সৌজাত্য আর সংবরণ প্রবণতা।
আরও পড়ুন:‘মিথ্যে কথা বলা যাবে না পয়লা বৈশাখে’
আশ্চর্য যে এখনকার সৌমিত্র, তার তিরাশিস্পর্শী বয়সে, একই রকম দীপ্যমান আর হাস্যোজ্জ্বল। সে তার কথিত ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়’ এমন পূর্বজ প্রবচনটি নিজেই মিথ্যা প্রমাণ করেছে। বুঝতে পারি, তার এই অস্খলিত শারীরশোভার পিছনে কতটা সক্রিয় তার আপন কর্ম সম্পর্কে নিয়ত নিষ্ঠা ও মনের অনুশীলনের দৈনন্দিন। কঠিন আত্মনিয়ন্ত্রণ, সদানিরীক্ষারত অনুসন্ধিৎসা, নিয়মিত লেখা আর পাঠাভ্যাস তাকে রক্ষাকবচ দিয়েছে। সংবেদনপূর্ণ তার জীবনপর্যটনের মূলে আছে কবিতা আর রবীন্দ্রচর্চা— বরাবর। পাশাপাশি প্রয়োজনে ও অন্যের অনুরোধে বিপুল সংখ্যক গদ্য লিখতে হয়েছে। ছাত্রবেলায় আমাদের সঙ্গে অকুণ্ঠ আবেগে গানে গলা মেলাত। আর শেষ বয়সের খুশখেয়ালে পরের পর ছবি এঁকে চলেছে।
এ দেশে বা বিদেশে এমন কোনও অভিনেতা (নাটকে বা চলচ্চিত্রশিল্পে) আছেন কি, যাঁর এত পরিমাণ নাট্যাভিনয়, পরিচালনা ও এত সংখ্যক চিত্রাভিনয়ের সঙ্গে রেখে যেতে পেরেছেন দুই খণ্ডে ১৭টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত ৯১৬ পৃষ্ঠায় বিন্যস্ত ‘গদ্যসংগ্রহ’ এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত একটানা প্রকাশিত ১২টি কাব্যগ্রন্থের সংকলন ‘কবিতা সমগ্র’? যার মধ্যে মৌলিক ১২টি কাব্যের অন্তর্গত অজস্র কবিতা ছাড়াও রয়েছে খলিল জিব্রানের কাব্যানুবাদ, যার নাম ‘দ্রষ্টা’ এবং রয়েছে দুটি বই, যার একটার নাম ‘নাতি-নাতনির ছড়া’, অন্যটা ‘ছড়া সমগ্র’। এই পরিমাণে লেখনী-শিল্পে মশগুল থাকা— এত আনন্দমগ্নতা আর আত্ম-আস্বাদনের তৃপ্তি সৌমিত্রকে নিশ্চয়ই সব রকম সময়ের বিষ থেকে বাঁচিয়েছে, আক্রান্ত হতে দেয়নি এ কালের ব্যাধি বিচ্ছিন্নতাবোধ সংক্রামে।
ভাগ্যের কথা যে, দেশের সারস্বত সমাজে, মেট্রোপলিটন মনের ভিড়ে, রাজনীতির অবস্থানে, ব্যক্তিগত নীতিবোধে সৌমিত্র স্বস্থ থাকতে পেরেছে। আরব সাগরের তীরের সচ্ছল সমারোহপূর্ণ দেদীপ্যমান ফিল্মি দুনিয়া তাকে আহ্বান করলেও সে নিজের ঘাঁটি আগলে রয়ে গেছে। তার ফলে এই অন্ত্যবয়সেও তাকে নিয়মিত কাজ করতে হয়, জীবিকাশ্রয়ী হতে হয় বাধ্যত। মুম্বই ফিল্ম বিষয়ে নিজেই কবুল করেছে, ‘সেই আমলের বাংলা ছবির উৎকর্ষের কারণে আমি ওই সব ভয়ংকর ছবিতে অভিনয় করা ভাবতে পারিনি। টাকা ছাড়া ওই সব ছবির আর কিছু দেওয়ার ছিল না। যৌবনের নির্বুদ্ধিতার বশে ভাবতাম, অর্থই অনর্থের মূল। এখন যখন জীবিকার তাগিদে একই ধরনের নিকৃষ্ট বাংলা ছবিতে অভিনয় করি, তখন মাঝে মাঝে অতীতের এই সিদ্ধান্তের জন্য আক্ষেপ করি। বম্বে গেলে নিশ্চিতভাবে আরও আরামে জীবন কাটাতে পারতাম।’
সৌমিত্র যে স্বতন্ত্র ভাবে বাংলা ও বাঙালির হয়ে থাকল, তা আমাদের গর্ব আর গৌরবেরই বিষয়। কলকাতার মতো বড় শহর তার নিজেকে বিচ্ছুরিত করবার যথার্থ আনুকূল্য করেছে। নিজেই সে লিখেছে— ‘ছেলেবেলার ছোট্ট মফস্বল শহর ছেড়ে বড়ো শহরের দিকে চলে এলাম। রবীন্দ্রনাথের শহর, মাইকেলের শহর, বিদ্যাসাগর-বিবেকানন্দের শহর, সুভাষচন্দ্রের শহর ছোট, চেনা পরিবেশের থেকে মুক্ত করে বড়ো পৃথিবীর দিকে মনকে ঠেলে দিল।’ শিশিরকুমার ভাদুড়ীর মতো মেধাবী বিদ্বান ও নাটকে পারদর্শী ব্যক্তিত্বের নিত্য সান্নিধ্য এবং তার পিঠোপিঠি সত্যজিৎ রায়ের মতো ভুবনায়নচেতনাসম্পন্ন শিল্পকুশলী রূপতাপসের সঙ্গ ও স্নেহ দিয়ে সে নিজেকে বড় মাপের গ্রহিষ্ণু আধারে পরিণত করে নিতে পেরেছে।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেধাবী ও জিজ্ঞাসু মননের মূলে আছে বিশ্লেষণপ্রবণ আর্ত আত্মজিজ্ঞাসা। সমতল থেকে অবতল পর্যন্ত প্রসারিত মানবসমাজ সম্পর্কে তার কৌতূহল অপার। তার সবচেয়ে বড় ক্ষোভ এটা যে, ‘আমাদের এই বাংলার একটা যথাযথ অভিনয় শিক্ষার প্রতিষ্ঠান আজও নির্মিত হল না।’ এর পিঠোপিঠি তার আত্মপক্ষের উজ্জ্বল স্বীকারোক্তি হল, ‘আমার সর্বাঙ্গীণ অভিনয়-ধারণার মধ্যে মাতৃভাষার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, খুবই জরুরি। বাংলা ভাষার প্রতি আমার আকর্ষণ, ভালোবাসা ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা অভিনেতা হিসেবে আমাকে সম্পূর্ণ করে। বলতে পারি বাংলা ভাষার নির্ভুল উচ্চারণ ও অর্থদীপ্ত ব্যবহার আমার অভিনয়ের মেরুদণ্ড।’ তার অন্তর্দাহ ও বিশ্বাস এই যে, ‘অধিকাংশ তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি ভালো করে বাংলা ভাষাটাই আর বলে না। নিজেদের মনের ভাব, ইচ্ছে, আবেগ প্রকাশ করার জন্য তাদের হিন্দি ও ইংরেজি ভাষার শব্দ ব্যবহার করতে হয়। তাদের চেয়ে অনেক সৎ অভ্যাসে বাংলা বলে খেটে-খাওয়া দীনদরিদ্র মুটে-মজুররা, মাথায় বোঝা নিয়েও তারা নিজেদের মতো করে যে ভাষা ব্যবহার করে, সেটা বাংলা ভাষা। আমি তাদের কাছেই শিক্ষা নেব এবং আমৃত্যু বাংলা ভাষাই বলব।’
রুপালি পরদার সোনালি নটের বাণী নয়, সন্তপ্ত এক বঙ্গসন্তানের একান্ত গোপন অশ্রুপাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy