১৯৫০। জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়ে ছিল সে দিন। ব্যাস এটুকুই ক্লু। হরিয়ানার অম্বালার মধ্যবিত্ত পঞ্জাবি পুরী দম্পতির সে দিনই ছেলে হয়েছিল। নাম রাখলেন ওম।
ছেলেটা বড় হচ্ছে। ডাল-রুটি খেয়ে তাগড়াই হচ্ছে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে গোল বাধল। বার্থ সার্টিফিকেট চাই যে! কিন্তু সে তো নেই। কবে হয়েছে ছেলে? প্রথমে সেনাবাহিনী ও পরে রেলে কাজ করা বাবা আর গৃহবধূ মা ওই একটাই ক্লু দিতে পারলেন। সে দিন বড্ড ঠাণ্ডা পড়েছিল। কিন্তু এ ভাবে কি খাতায়-কলমে কাজ সম্ভব? একটা ডেট তো চাই। অতশত ভাবার সময় নেই তখন। তাই তাড়াহুড়োয় স্কুলে ভর্তির খাতায় কাকা ওমের অফিশিয়াল জন্মদিন লিখলেন ৯ মার্চ, ১৯৫০।
একটু একটু করে বুঝতে শিখল ছেলে। না! বার্থ সার্টিফিকেট নেই কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করেনি সে। বরং মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতেই একদিন জেনে নিল, তার জন্মের দু’দিন আগেই ছিল দশেরা। হিন্দুদের বড় উত্সব। দূরের মাঠে রাবণ পোড়া দেখতে গিয়েছিল সকলে দল বেঁধে। কিন্তু ভারী চেহারা নিয়ে মা যেতে পারেননি সে দিন। তার দু’দিন পরেই তো ছেলে হল!
পাওয়া গেল আরও একটা ক্লু। মুম্বই গিয়ে ওম খোঁজ করে দেখলেন, ১৯৫০-এ দশেরা পড়েছিল ১৬ অক্টোবর। মায়ের গল্প অনুযায়ী, তার দু’দিন পর অর্থাত্ ১৮ অক্টোবর তাঁর জন্ম। সেই থেকে নিজেই অফিশিয়ালি বদলে ফেললেন জন্মতারিখ।
স্নাতক হওয়ার পর তখন থিয়েটারই ধ্যান-জ্ঞান ওমের।
মুম্বই যাওয়ার আগের জার্নিটাও খুব একটা সহজ ছিল না। হরিয়ানার জল-হাওয়ায় বড় হওয়া ওম নিজের মধ্যে অভিনয়ের স্বপ্নের ওমে তা দিয়েছিল গোপনে। কিন্তু তা বাড়িতে বোঝানো বেশ কঠিন ছিল। তবে বাবা-মা ছেলেকে কোনও কাজেই বাধা দেননি। প্রথাগত পড়াশোনা শেষ করে পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক হলেন। তার আগে পেরোলেন ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামার হার্ডল। সেখানে তাঁর এক অভিন্নহৃদয় বন্ধু জুটল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরেনি। ৬৬ বছর বয়সে গত বৃহস্পতিবার রাতেও যিনি শুটিং করেছেন চেনা মেজাজে, শুক্রবার সকালে আর চোখ খুলবেন না, এটা ভাবতেই পারছেন না ওমের ১৯৭৩-এর ব্যাচের সেই বন্ধু নাসিরুদ্দিন শাহ। নাসির একবার বলেছিলেন ‘‘ও তো ভিলেন পুরী।’’ আর আজ ওমের চলে যাওয়ার পর বললেন, ‘‘১৯৭০ থেকে ওকে চিনি। একসঙ্গে এতগুলো দিন। থিয়েটারে ওর অভিনয়ে ম্যাজিক দেখেছিলাম আমি। এখন শান্তিতে ঘুমোক। ওর চলে যাওয়াটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তো বটেই, আমার মনে হয় দেশের ক্ষতি।’’
১৯৭৬ সালে মরাঠি ছবি ‘ঘাসিরাম কোতওয়াল’ দিয়ে বড় পর্দায় প্রবেশ ওমের। ১৯৮০ সালে ‘আক্রোশ’ ছবির জন্য পান ফিল্মফেয়ারে সেরা সহ-অভিনেতার পুরস্কার। ১৯৮২ এবং ১৯৮৩ সালে ‘আরোহণ’ ও ‘অর্ধ সত্য’-এর জন্য সেরা অভিনেতা হিসাবে পান জাতীয় পুরস্কার। হিন্দির পাশাপাশি মালয়ালম, পঞ্জাবি, কন্নড়, উর্দু, মরাঠি, তেলুগু ভাষার ছবিতেও অভিনয় করেছেন। ব্রিটিশ, আমেরিকান ও পাকিস্তানের বেশ কিছু ছবিতেও তাঁর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। কাজ করেছিলেন হলিউডের একাধিক ছবিতেও। কখনও কমেডি, কখনও ভিলেন, কখনও ক্যামিও, আবার কখনও বোল্ড সিন— নিজেই একটা ইন্সটিটিউট হয়ে উঠেছিলেন ইন্ডাস্ট্রিতে।
আরও পড়ুন: ‘ওম পুরী বেঁচে থাকবেন তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই’
প্রথম বিয়ে ১৯৯১-তে। অভিনেতা অনু কপূরের বোন সীমা কপূরকে বিয়ে করেন ওম। আট মাসের মধ্যেই ভেঙে যায় সে সম্পর্ক। দ্বিতীয় বিয়ে ১৯৯৩-তে। বিয়ে করেছিলেন সাংবাদিক নন্দিতা পুরীকে। তাঁদের একটি ছেলেও আছে, ঈশান। ২০০৯-এ ওমের বায়োগ্রাফিও লেখেন নন্দিতা। ‘আনলাইকলি হিরো’ সে সময় বেশ জনপ্রিয় হয়। যদিও ২০১৩ সালে আলাদা হয়ে যান তাঁরা। সেই বিচ্ছেদ নিয়ে জলঘোলাও কম হয়নি। ওমের বিরুদ্ধে গার্হস্থ্য হিংসার অভিযোগ করেছিলেন নন্দিতা। তবে আজ সকালে ওমের চলে যাওয়ার খবরে নিজেকে কার্যত গৃহবন্দি করে ফেলেছেন নন্দিতা।
শুক্রবার সকালে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক থামিয়ে দিল ওমের ৬৬ বছরের জীবন। ওমের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অশোক পণ্ডিত এই খবর কনফার্ম করার তাঁর আন্ধেরির বাড়িতে প্রথম পৌঁছন অনুপম খের। পরে টুইট করেন, ‘‘বিছানায় ওমের শান্ত অবস্থায় শুয়ে থাকাটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ইনিই সেই বিখ্যাত অভিনেতা। মারাত্মক শক এটা। ৪৩ বছর ধরে ওমকে চিনি। আমার কাছে তিনি শুধু একজন বড় মাপের অভিনেতাই নন, তিনি দয়ালু আর খুব বড় মাপের মানুষও বটে।’’
তখন সুখের সময়। নন্দিতার সঙ্গে ওম।
বরাবরই স্পষ্টবক্তা ছিলেন ওম। মুখ খুলেছেন বিভিন্ন ইস্যুতে। সমালোচিতও হয়েছেন বহুবার। ২০১৫-এর শেষ দিকে অসহিষ্ণুতা প্রসঙ্গে আমির খানকে একহাত নিয়েছিলেন। সে সময় কিরণ নাকি ভারতে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন। সে কথা আমির সর্বসমক্ষে বলার পর সোজাসাপ্টা ওম বলেছিলেন, ‘‘আমিরের কথায় আমি শকড। ও আর কিরণ এ ভাবে ভাবে নাকি? এ তো একেবারেই মেনে নেওয়া যায় না।’’ এই মন্তব্যের পর সমালোচিত হয়েছিলেন বিভিন্ন মহলে। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসেনি ব্যক্তি ওমের।
পেশাদার জীবনে যত ছোট জায়গাই হোক না কেন নিজের সেরাটুকু দিয়েছেন সবসময়। আবার ব্যক্তি জীবনেও কখনও ‘পিকচার পারফেক্ট’ মন্তব্য করার দায় ছিল না তাঁর। গোটা ইনিংসটাই ঝোড়ো ব্যাটিং করেছেন। ব্যাটিং করেছেন নিজের শর্তে।
আরও পড়ুন, কালও শুটিং করেছেন, হার্ট অ্যাটাকে হঠাত্ই চলে গেলেন ওম পুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy