‘সিক্রেট সুপারস্টার’-এ আমির খান।
সাত সকালে সিনেমা দেখে হল থেকে বেরতে বেরতে দর্শকদের মুখে একটাই কথা- আমির সব সময়েই ফ্রেশ কিছু উপহার দেন। দারুণ সিনেমা। দীপাবলির সকালে এ ছবি দেখার পর বুকভরা প্রশান্তি নিয়ে সকলে ঘরের পথ ধরেন। এই একটা, একটাই মাত্র ঘরের গল্প বলেন আমির। নারীবাদের যে সব তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চার সঙ্গে আসলে এই ঘরগুলোর দূরত্ব এখনও মেটেনি, সেই কথাগুলোই খুব সরল পপুলার মোড়কে হাসি-কান্না-রাগে ভিজিয়ে দর্শককে বলতে চায় ‘সিক্রেট সুপারস্টার’। দেখা যাচ্ছে পিকে, দঙ্গল থেকে এই সিনেমা— সামাজিক জটিল তাত্ত্বিক সমস্যাকে জনপ্রিয় পরিসরে এনে ফেলার স্টাইল নিয়েছে আমির খানের প্রযোজনা। এবং তিনি তাতে অত্যন্ত সফল। তিনি এবং অবশ্যই কিরণ রাও জানেন তাঁর কোন ফিল্মের দর্শককুলের রেঞ্জ কতটা, কতটা কথা কী ভাবে বললে তাঁদের কাছ অবধি পৌঁছনো যাবে। অথচ কনটেন্ট এবং ফর্মের ব্যাপারে সৎ থেকেও নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করতে তেমন কম্প্রোমাইজ করতে হবে না। এই ছবিতে কাজ হারাতে বসা তাঁর মিউজিক কম্পোজারের চরিত্র শক্তিকুমারের একেবারে উল্টো রকম বাস্তবের আমির কনটেন্টের বাজারটাও বোঝেন অত্যন্ত চমৎকার।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: নিউটন, এই ছবি শেষ হয়, ফুরিয়ে যায় না
এই ছবির ন্যারেটিভ অত্যন্ত সরল। ইউএসপি আসলে প্রত্যেক ছোট বড় অভিনেতার অসাধারণ সাবলীল অভিনয় আর গান। খুব রক্ষণশীল মুসলমান পরিবারের কিশোরী নয় ইনসিয়া। কিন্তু বাবার ‘পুরুষালি’ শাসনে বাঁধা বাড়ির সমস্ত সদস্য। সেই বাবার অত্যাচারেই দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ইনসিয়ার বড় গাইয়ে হওয়ার স্বপ্ন কী ভাবে শেষ পর্যন্ত সফল হল, এটাই ছবির প্রতিপাদ্য। পরিচালক-কাহিনিকার অদ্বৈত চন্দন খেললেন এই সিক্রেট এবং সুপারস্টার শব্দ দু’টি নিয়ে। এখানে মনে পড়তে পারে জাফর পানাহির ‘অফসাইড’ ছবির কথা। কিছু মেয়ে সেখানে মাঠে ফুটবল খেলা দেখার তাড়নায় একের পর পুরুষতন্ত্রের বিধি-নিষেধ ভাঙতে থাকে। এই ছবিতেও গান গাইবার স্বপ্নের পিছনে ছুটতে ছুটতে আসলে ইনসিয়া আরও বড় কোনও বাঁধন, পিছুটান ভাঙতে থাকে। যদিও এখানে ইনসিয়া বিশেষ প্রতিভাধর বলেই এত রকমের সুযোগ এত সহজে পেয়ে যায়। ইরানের মেয়েরা খেলা দেখতে চায়, ইনসিয়াও যদি শুধুই গান শুনতে চাইত, তা হলে তার লড়াই কত দূর দেখানো সম্ভব হতো, আমরা জানি না। অবশ্য এ ছবি অত কিছু জানানোর দাবিও করে না। আমরা আন্দাজ করতে পারি, কাহিনির শেষে কী হবে, কিন্তু কী ভাবে শেষটা হচ্ছে, সেটা দেখার জন্য অদ্বৈত আমাদের উৎসুক করে রাখেন। হেমন্তী সরকারের স্মার্ট এডিটিং শেষ অবধি টানটান করে বেঁধে রাখে গোটা ছবি। যদিও প্রথম হাফ যতটা সাবলীল, উপসংহারে পৌঁছনোর তাড়ায় ছবির সেকেন্ড হাফ তুলনায় সচেতন।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ঘুরে দাঁড়ানোর উড়ান ধরলেন দেব
দঙ্গলের মতো বাস্তব ঘটনাভিত্তিক না হওয়ায় এই ছবির গল্পে কল্পনার সুযোগ প্রবল। সেই স্বপ্নের সত্যিটাকে পরিচালক সুন্দর ব্যবহারও করেছেন। ফলে ইউটিউবে এক দিনে ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়া বা ইনসিয়ার বাবা ছাড়া বাদবাকি সমাজ অত্যন্ত ভাল সহৃদয়—এটা কল্পনা করতে কোথাও অসুবিধা হয় না। কারণ, পরিবারের ভেতরে বাবার শাসনের অত্যাচার সহজবোধ্য করতে গেলে বাকি সমাজের একটা সুন্দর বাইনারি খাড়া করতে হবে। বাবার বা সমাজের চরিত্রের জটিলতা এই ছবির বাঁধুনি হয়তো আলগা করে দিতে পারত। বাবা ফারুখ মালিকের ভূমিকায় অর্জুন রাজ অনবদ্য নিয়ন্ত্রিত অভিনেতা। ইনসিয়ার মা নাজমা এই ছবির অন্যতম ভরকেন্দ্র। মেহের বীজের নিপুণ অভিনয় সেই কেন্দ্র এতটুকু নড়তে দেয়নি।
আরও পড়ুন, মুভি রিভিউ: ভেজাল মশলা দিয়ে রান্না ‘আ জেন্টলম্যান’
‘সিক্রেট সুপারস্টার’ ছবির একটি দৃশ্য।
ইনসিয়া, তার ভাই গুড্ডু (কবির সাজিদ), তার বন্ধু চিন্তন পারেখ (তীর্থ শর্মা)— এক সঙ্গে এত জন দক্ষ খুদে অভিনেতাকে অদ্বৈতর এই প্রথম ছবির সম্পদ। ইনসিয়ার ভূমিকায় জাইরা ওয়াসিমকে দঙ্গলের আগেই আবিষ্কার করেছিলেন অদ্বৈত। ঐ ছবির জন্য তাঁর ছবির কাজ পিছিয়ে যায়। কিন্তু দু’টি ছবিতেই দু’রকমের চরিত্রে জাইরা নিজেকে প্রমাণ করে ফেলেছে। তার ওই নিষ্পাপ মুখে এত রকমের আবেগ খেলা করতে পারে! হিন্দি হিট ছবিতে চুল ছেঁটে মেয়ে কুস্তিগীরের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য কাশ্মীরের সমাজ জাইরাকে নিয়ে ইন্টারনেট ট্রোল শুরু করে। প্রায় একই রকম ভাবে ২০১৩ সালে কাশ্মীরে ইসলামি মৌলবাদীদের হুমকিতে ‘প্রগাশ’ নামে রক ব্যান্ড ভাঙতে বাধ্য হয় তিন কিশোরী। দঙ্গল ছবির ভিতরেও মফসসলের মেয়ে কুস্তিগীর গীতাকে সমাজ ট্যারা চোখে দেখে। বাস্তবে বা ছবিতে জাইরার এর আগের লড়াইগুলো ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে। এই ছবিতে সেটাই হয়েছে পরিবারের পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে। এখানে খুব নিপুণ ভাবে মুসলমান পরিবারটিকে স্থাপন করা হয়েছে গুজরাতের প্রেক্ষাপটে। এবং এই কৈশোর গুজরাতের সেই প্রজন্ম, যারা দ্বিধাহীন ভাবে সম্প্রদায় ভুলে হাসে-খেলে-অভিমান করে। তারে জমিন পর, পিকে বা দঙ্গলের ‘নায়ক’ আমির খান এই ছবিতে নিজেকে ভরকেন্দ্র থেকে যতটা সম্ভব দূরে রেখেছেন। তিনি এখানে কেবল পাশে থাকেন। শক্তিকুমার শেষ অবধি খুবই ভাল এবং অত্যন্ত মজার একটি চরিত্র। কিন্তু ওই যে বলেছিলাম, ইনসিয়ার বাবা ছাড়া অন্য আর সব চরিত্রই তাঁর মতো সদয় এবং বড্ড ভাল। কিশোরীর গলায় নতুন প্রজন্মের জন্য অমিত ত্রিবেদীর মতো ফ্রেশ গান এই মুহূর্তে ক’জনই বা বাঁধতে পারেন! কৌসর মুনিরের লিরিকও মানানসই। জাইরার লিপে মেঘনা মিশ্রর গানও খুব সুন্দর মিশেছে। সব মিলিয়ে, আরও একবার মেয়ে সন্তানদের সঙ্গে পরিবার এবং সমাজের সম্পর্ক নিয়ে তামাম দর্শককে ভাববার, মত বিনিময়ের পরিসর তৈরি করে দেয় এই ছবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy