সেন্সর কর্তা পহলাজ নিহালনি এই ছবিটা দেখার সময় নিজেই কোনও সাদা, বাদামি বা বেগুনি ধোঁয়া টানেননি তো? ‘উড়তা পঞ্জাব’ ছবিটা দেখার পর এই প্রশ্নের ঘোরেই মাথা ভোঁ হয়ে আছে।
এই ছবিটা ড্রাগ-আসক্তি প্রশ্রয় দেয় কী ভাবে ভাবলেন নিহালনি? যেখানে ড্রাগের নেশায় একটি ছেলে অচেতন, মুখে বমি ও মাছি লেপ্টে, হাতের নখ শুকিয়ে নীলচে! জেলখানায় অনেকের চোখের নীচে কালি! আলিয়া ভাট কোকেনের জন্য ছটফট করতে করতে ফের তাঁর অপহরণকারীদের পাল্লায় পড়ছেন এবং সেই অপহরণকারীরা তাঁকে ঠাণ্ডা মাথায় শরীর বিক্রিতে বাধ্য করছেন! শূন্য দৃষ্টি অসাড় আলিয়ার কোনও বোধ থাকছে না! সেই ছবি আর যাই হোক, অন্তত মাদকাসক্তিকে প্রশ্রয় দেয় না।
আর চণ্ডীগড়, তরণতারণ, জলন্ধর এই নামগুলিই বা উড়িয়ে দিতে বলেছিলেন কেন? ‘দিল্লি বেলি’ ছবিটায় যদি দিল্লিবাসীর আপত্তি না থাকে, প্রকাশ ঝা-র ‘গঙ্গাজল’, ‘শূল’ ইত্যাদি ছবি যদি বিহারের বাসিন্দারা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারেন, তা হলে পঞ্জাবের বাসিন্দাদের এত বালখিল্য গাম্বাট ভাবলেন কেন নিহালনি? নাকি গোটাটাই পঞ্জাব নির্বাচনের আগে অকালি ও বিজেপি দলকে তোল্লাই?
ছবিতে ড্রাগ-মাফিয়াদের আস্তানায় থাকা কুকুরটির নাম জ্যাকি চান। এই নির্দোষ মজাটাও সেন্সরকর্তার প্রাণে সয়নি। তিনি সিনেমার কুকুরের নাম বদলের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ভাল! বলিউডি ফিল্মের ভক্ত, মল্লিকা শেরাওয়াতের বন্ধু জ্যাকি চান এতে হয়তো মজাই পাবেন। কিন্তু ভারতীয় সেন্সর? তারা কি আশা করেছিল, ড্রাগ-মাফিয়ারা তাদের পোষা কুকুরকে সক্রেটিস বা ব্যাস বা বাল্মীকি নামে ডাকবে?
অভিষেক চৌবের পরিচালনায় এই ছবির শুরুও মারাত্মক! দূর থেকে স্কুটারের হেডলাইট, সীমান্তের ধারে অন্ধকার গমখেতে কথোপকথন। এক জন তিন কেজি হেরোইনের একটা প্যাকেট ছুড়ে দেয়। অতঃপর এই প্যাকেট ধরেই আগুপিছু, সমান্তরাল তিনটি কাহিনী।
প্রথম কাহিনীটি রকস্টার টমি (শাহিদ কপূর)-র। মাদকের নেশায় চুর হয়ে সে গান লেখে। ‘লাইফ হো জায়ে তো মারো টেন পাফ’ এ রকমই র্যাপ গানের উদ্দাম গতিমত্ততায় শাহিদের প্রথম প্রবেশ। ‘হায়দর’ ছবির পর এ একেবারে অন্য ধাঁচের শাহিদ। রক গায়ক ধুমকিতে ‘স্টোনড’ হয়ে থাকবেন, এ আর নতুন কথা কী? পহলাজ নিহালনি কি কখনও বিটল্স, রোলিং স্টোন-এর গান শোনেননি? এক বারও গুনগুন করেননি মিক জ্যাগার? কয়েক বছর আগে জিম মরিসনকে নিয়ে ‘ডোরস’ বা তারও বহু আগে ‘আ স্টার ইজ বর্ন’ গোছের ছবিও দেখেননি? রক স্টার হিসেবে শাহিদ তাঁর রাগ, নেশার ধুমকি সব কিছু নিয়েই চমৎকার।
বিহার থেকে পঞ্জাবের গমখেতে কাজ করতে গিয়েছিল একটি গরিব মেয়ে। আলিয়া ভট্ট। ছবিতে তার নাম বলা হয়নি। কিন্তু পঞ্জাবের সবুজ বিপ্লবের পিছনেও তো ছিল বিহার থেকে আসা এ রকমই সব পরিযায়ী কৃষিশ্রমিক! খেতে কাজ করতে করতে তিন কেজি সেই হেরোইনের প্যাকেট আচমকা আলিয়ার হাতে পড়ে। সে সেটি বেচে দেওয়ার চেষ্টা করে, তার পরই মাফিয়াদের খপ্পরে! নো মেক আপ লুকে আলিয়া। এবং চিত্রনাট্য এক জায়গায় মারাত্মক! মাফিয়া ডেরায় এক দিকে এক জনের মেরে হাত পা ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। পাশেই বৃদ্ধ মাফিয়া সর্দার ঠান্ডা স্বরে আলিয়াকে জিজ্ঞাসা করে, ‘পুত্তর, যদি না বেচার ইচ্ছে থাকে, তা হলেও তিন কোটি টাকার হেরোইন তিন কোটি টাকার চিতা (হেরোইন) ফেলে দিলি কেন? কোনও মারকাটারি ভায়োলেন্স নয়, ঠান্ডা স্বরের এই প্রশ্নটিই গা হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
পহলাজ, এই ছবিতে আপনি শুধু বেহেন**, মাদার** গোছের খিস্তিগুলিই শুনলেন? দেখলেন না নীল সমুদ্রে আলিয়ার সাররিয়াল ডুবে যাওয়া? মাফিয়ারা আলিয়াকে কোকেনের নেশায় বুঁদ করে খদ্দেরের সঙ্গে শুতে বাধ্য করে। জানলা দিয়ে দেখা যায়, দূরে গোয়ার বিজ্ঞাপন। আর আলিয়ার মনে হয়, নীল সমুদ্রের অতলে সে ডুবে যাচ্ছে, হাঁসফাঁস করতে করতে ফের ভেসে ওঠার চেষ্টা করছে।
সমান্তরাল তিন নম্বর গল্পের সুতোটা সরতাজ সিংহ নামে এক পুলিশ অফিসারকে নিয়ে। ট্রাকে করে ড্রাগ পাচার হয়, পুলিশ সেগুলি ছেড়ে দেয়। সরতাজ এ জন্য মাসে ১০ হাজার টাকা বখরা পায়। কিন্তু তার একমাত্র ভাই-ই নেশাসক্ত হয়ে পড়ে। সরতাজ তাকে প্রীত (করিনা কপূর) নামে এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। প্রীতের রিহ্যাবেই আছে তার ভাই। দীপক দোসানজি নামে এক নতুন অভিনেতার চমৎকার আন্ডারঅ্যাক্টিং এই সরতাজের চরিত্রে।
ছবি ঝুলেছে দ্বিতীয়ার্ধে এসে। প্রথমার্ধে টানটান চিত্রনাট্য। মাদকাসক্তি, পুলিশ ও রাজনীতিকদের যোগসাজসে সর্বত্র ড্রাগ ছড়িয়ে পড়া নিয়ে প্রায় ডকুমেন্টারি ধাঁচে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এল বিবেকের ডাক। শাহিদ কপূর ১৮০ কিমি সাইকেল চালিয়ে অচেনা গ্রামে মাফিয়াদের ডেরায় আলিয়াকে খুঁজে বের করলেন। তাঁর মতো রক স্টার ততদিনে নেশা ছেড়ে দিয়েছেন শুধুই আলিয়াকে দেখে। এই পর্বে শাহিদের কণ্ঠে শুধু ‘সেই মেয়েটির জন্যই আমি ড্রাগ ছেড়েছি,’ ‘আমি এখন শুধু নিজের জন্য দৌড়াই’ ইত্যাদি মেলোড্রামাটিক সংলাপের ছড়াছড়ি। সরতাজ ও প্রীত প্রায় হিন্দি ছবির নায়কনায়িকাদের ঢঙে মাফিয়াদের ডেরায় পৌঁছে য়ায়, কোন নেতা বেআইনি কোম্পানি খুলে মাদক পাচার করেন জেনে ফেলে। শেষে সরতাজের ড্রাগ-আসক্ত ভাইয়ের গুলিতে প্রীতের মৃত্যু। দ্বিতীয়ার্ধই এই ছবির মূল দুর্বলতা।
এই ছবির পরিচালক অভিষেক চৌবে এর আগে বিদ্যা বালন, নাসিরকে নিয়ে ‘ইশকিয়া’ ছবি করেছিলেন।। এ বারে তাঁর লক্ষ্য ছিল ছবিতে জীবনের দুঃসহ গাঢ় অন্ধকার আর হাল্কা কমেডি পাশাপাশি রেখে দেওয়া। মাফিয়াদের ডেরা থেকে স্কুটারে চেপে পালাতে পালাতে সরতাজ আর প্রীতের কথোপকথন এ রকমই মজার। কিংবা গমখেতের ধারে ভাঙা বাড়িতে আলিয়া আর শাহিদের কথোপকথন। শুকিয়ে কালচে হয়ে যাওয়া জীবন আর অশ্রুসিক্ত হাসাহাসি সেখানে একাকার। অমিত ত্রিবেদীর সুর করা গানগুলিও শুনতে ভালই লাগে।
সেই ভাল লাগার ধুমকিতেই একটা কথা জানতে ইচ্ছা করে। ছবিটা দেখতে দেখতে ঠিক কী টানছিলেন সেন্সরকর্তা?
আরও পড়ুন:
গণতন্ত্র এখন উড়তা পঞ্জাবের পাখায় সওয়ার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy