পরিচালনার কাজে ব্যস্ত কঙ্কনা।
ডব্লিউ বি জে ৩০২৬। অ্যাকোয়া সবুজ অ্যাম্বাসেডার ছুটছে জঙ্গুলে পথ ধরে। ম্যাকলাস্কিগঞ্জ আর কত দূর? রাস্তার ধারে মাইলফলক বলছে, ৪.৬৭ কিলোমিটার। ‘.৬৭’…এমন অদ্ভুত রুট নির্দেশ? না! এখন আর আপনি দেখতে পাবেন না। তবে ১৯৭৯-এর ভারতে এমন মাইলফলক চোখে পড়ত হামেশাই। লেন্সে চোখ রেখে সেই সময়টাকেই বড়পর্দায় তুলে এনেছেন কঙ্কনা সেনশর্মা। মুক্তি পেল পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবি ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’।
১৯৭৯। সে বছরই জন্মেছিলেন কঙ্কনা। তখনকার বিহার, অধুনা ঝাড়খণ্ডে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের বাড়িতে শেষ গিয়েছেন বছর ছ’য়েক বয়সে। ঠাকুরদা, ঠাকুমার কাছে মাঝেমধ্যে বেড়াতে যাওয়া মা-বাবার সঙ্গে। অন্ধকার জমাট বাঁধলেই গা ঘেঁষে বসত গল্পরা। ভুতুড়ে পরিবেশ যোগ্য সঙ্গত দিত তাতে। তবে সে স্মৃতি খুব একটা পোক্ত ছিল না কঙ্কনার। মা-বাবা-দিদির থেকে শোনা গল্প বরং ভরসা জুগিয়েছিল। প্রত্যেক পরিবারে কিছু বিচিত্র চরিত্রের মানুষ থাকেন। থাকে তাদের নিয়ে গড়ে ওঠা কাহিনি। আর হাতে ছিল বেশ কয়েক বছর আগে বাবা মুকুল শর্মার লেখা একটা গল্প। সেখান থেকেই ছবির ভাবনারা দানা বাঁধে। ১৯৭৯ সালের ভারতের পটভূমিতে ফ্যামিলি ভ্যাকেশন, বন্ধুত্বের গল্প, একাকীত্বের বারোমাস্যা, রোম্যান্স নিয়ে গড়ে ওঠে কঙ্কনার প্রথম ছবি ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’।
আরও পড়ুন, ‘মায়ের সঙ্গে তো তুলনা হবেই, ওটা নিয়ে ভাবি না’
শুরুরও একটা শুরু থাকে। কঙ্কনার লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের জগতের সঙ্গে পরোক্ষ পরিচিতি জন্ম থেকেই। মা অপর্ণা সেন একদিকে সংসার সামলেছেন। অন্যদিকে শুটিং। এ দৃশ্য তো তাঁর চিরকালের চেনা। তাই ছ’বছরের ছেলে হারুনকে সামলে পরিচালনার কাজ করতে কোনও অসুবিধে হয়নি।
শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ে ডেবিউ ১৯৮৩-এর ‘ইন্দিরা’। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিনয়ে আসা পরিচালক সুব্রত সেনের হাত ধরে ২১ বছর বয়সে। তাঁর ‘এক যে আছে কন্যা’তে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ। সেটা ২০০১। ‘এক যে আছে কন্যা, সাধারণ মেয়ে তবু সাধারণ না…’ ছবির গানের কথা কঙ্কনার পারফরম্যান্সকে যথার্থতা দিয়েছিল। সেরা অভিনেত্রীর সম্মান এসেছিল ‘বেঙ্গলি ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ডস’-এর পক্ষ থেকে। ২০০২-এ মুক্তিপ্রাপ্ত অপর্ণা সেনের পরিচালনায় ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’-এ এল সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার। এরপর একটার পর একটা মনে রাখার মতো চরিত্র। ‘তিতলি’, ‘পেজ থ্রি’, ‘ফিফটিন পার্ক অ্যাভিনিউ’, ‘ওমকারা’, ‘দোসর’, ‘লাইফ ইন না মেট্রো’, ‘আ যা নাচলে’, ‘ফ্যাশন’, ‘ওয়েক আপ সিড’, ‘গয়নার বাক্স’, ‘শেষের কবিতা’— তালিকাটা দীর্ঘ। প্রচলিত নায়িকা নন, অভিনেত্রী কঙ্কনাকে ভালবেসেছেন দর্শক। সেখান থেকে এ বার পরিচালনায় হাতেখড়ি।
আরও পড়ুন, ৩২ বছরের এক ছেলের ‘মা’ অপরাজিতা!
না! ঠিক হাতেখড়ি বোধহয় বলা চলে না। ২০০৬। ‘নামকরণ’ নামে একটা শর্টফিল্ম পরিচালনা করেছিলেন কঙ্কনা। সে সব দিনের কথা শেয়ার করছিলেন ‘নামকরণ’-এর অন্যতম অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘ওই ছবিটার সময় বন্ধুসুলভ আড্ডা হত। তখন কিন্তু শর্টফিল্ম নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। ছোট ছবির পিছনেও ওর যা সিনসিয়ারিটি দেখেছিলাম সেটা সম্মান করার মতো।’’ আর ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’? স্পেশাল স্ক্রিনিং দেখে উচ্ছ্বসিত সুদীপ্তা বললেন, ‘‘ছবিটা দেখে আমি পুরো বোল্ড আউট হয়ে গিয়েছি। এটা যদি ডেবিউ ফিল্ম হয়, তা হলে স্কাই ইজ দ্য লিমিট।’’ মুগ্ধ ‘নামকরণ’-এর আর এক অভিনেত্রী বিদীপ্তা চক্রবর্তীও। পছন্দের অভিনেত্রী, পছন্দের মানুষ কঙ্কনাকে নিয়ে বিদীপ্তার মত, ‘‘ছবিটা দেখার পর আমি এখনও ঘোরের মধ্যে রয়েছি। সিনেমা এমনই হওয়া উচিত। আমরা এমনটাই দেখতে চাই। নিখুঁত একটা কাজ। নতুনদের দিয়ে কী সুন্দর অভিনয় করিয়ে নিয়েছে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার-এ ও আমার সহ অভিনেত্রীও বটে। নামকরণ-এ ওকে পরিচালক হিসেবে পেয়েছি। দারুণ বুদ্ধিমতী কঙ্কনার ভিসুয়াল সেন্স দেখার মতো। রিনাদির ব্যাটন ও যে সফল ভাবে বয়ে নিয়ে যাবে প্রথম ছবিতেই সেটা প্রমাণ করেছে।’’
‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’ ছবির একটি দৃশ্য।
অপর্ণা সেনের সঙ্গে কঙ্কনার তুলনা হওয়াটা কি স্বাভাবিক?
১৬ বছরে সত্যজিত্ রায়ের ‘তিনকন্যা’ দিয়ে বড়পর্দায় অভিনয়ে হাতেখড়ি হয়েছিল অপর্ণার। একখাতে চলতে চলতে ৩৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম পরিচালনা ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’। মেয়ে কঙ্কনার এখন ৩৮। মা-ও প্রথম ছবি তৈরি করেছিলেন ইংরাজিতে। মেয়েও একই পথের পথিক। ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’ ম্যানিলা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দ্য গ্রাঁ প্রি (দ্য গোল্ডেন ইগল) পুরস্কার জিতে নেয়। মুক্তির আগেই ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’-এর জন্য নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন কঙ্কনা। ছবিটি প্রশংসিত আরও বেশ কয়েকটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। ফলে তুলনা আসাটা যেন স্বাভাবিক। বাবা-মা স্বনামধন্য হলে সন্তানদের ওপর যেমন প্রত্যাশার চাপটা একটু বেশিই থাকে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। এই তুলনাটা কী ভাবে ম্যানেজ করছেন? কঙ্কনার সপাট জবাব, ‘‘তুলনা তো চিরকালই হচ্ছে। আমি যখন অভিনয় করতে এলাম তখনও মায়ের সঙ্গে তুলনা হয়েছে। ওটা তো বাইরের লোকেরা করে, করুক। ওটা নিয়ে ভাবি না।’’
আরও পড়ুন, ‘সংসার ছেড়ে চলে যাব ভেবেছিলাম’
ঠিক একই সুর শোনা গেল নাটক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব সোহাগ সেনের গলায়। অপর্ণা সেনের বন্ধু সোহাগ কঙ্কনাকে দেখেছেন ছোট থেকেই। অপর্ণার প্রায় প্রতিটি ছবিতে প্রথম থেকে শেষ যুক্ত থাকেন তিনি। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ওয়ার্কশপ করানোর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। সেই সূত্রে কঙ্কনাকে চোখের সামনে তৈরি হতে দেখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কঙ্কনাকে ইন্টেলিজেন্ট বললে কম বলা হবে। আমি বলব জ্ঞানী। যখন যেটা করেছে, তখন সেটাতেই সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছে। ছবিটা দেখে মনে হয়েছে এটা একমাত্র কঙ্কনাই পারে। ওর অভিনেত্রী থেকে পরিচালকের জার্নিটা এককথায় ব্রিলিয়ান্ট। আর তুলনা? সে তো হবেই। এমন মায়ের এমন মেয়ে। তুলনা আসাটা স্বাভাবিক। সেটা আমার ধারণা ও নিজেও জানে। কিন্তু ও বদার করে না। আমার ছবিটা দেখে ব্যক্তিগত ভাবে ওর পরিচালনাটা অনেক ডিরেক্ট লেগেছে। ছবিটার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই। কোথাও এক্সট্রা কিছু নেই। আর রিনাকে কোথাও কোথাও একটু অর্নামেন্টাল লাগে।’’
অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম থেকেই নিজেকে আলাদা ভাবে তুলে ধরেছেন কঙ্কনা। ইন্টেলেকচ্যুয়াল ঘরানাকে যেন কোথাও রিপ্রেজেন্ট করেছেন। অপর্ণা কিন্তু আপাদমস্তক সেই ঘরানার নন। প্রথম দিকের বেশ কিছু ছবিতে তিনি নায়িকা। অন্যদিকে কঙ্কনার পথটা প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমী। কিন্তু পরিচালনা? সেখানে কতটা আলাদা হতে পারলেন তিনি? ১৯৮১-তে দাঁড়িয়ে ‘৩৬ চৌরঙ্গি লেন’-এ নতুন বিষয় নিয়ে কাজ করেছিলেন অপর্ণা। প্রথম ছবিতে কঙ্কনা নতুন কী দেখাবেন দর্শককে?
আরও পড়ুন, ‘মা’ হয়ে কেমন লাগছে? শেয়ার করলেন মিমি
১৯৭৯-এর ম্যাকলাস্কিগঞ্জের গল্প বুনেছেন তিনি। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকার গল্প, সকলের সামনে ‘হেরো’ প্রমাণিত হওয়ার গল্প, না-পারার গল্প, একাকীত্বের গল্প। একদিকে সে সময়ের ম্যাকলাস্কিগঞ্জের অ্যাংলো ইন্ডিয়ানরা। অন্যদিকে আদিবাসী সমাজ। গা ছমছমে নির্জনতা, ঝিঁঝিঁর ডাক, ছুটির মজা, প্ল্যানচেট, কুয়াশামাখা ভয় কি কোথাও ফিরিয়ে আনে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র স্মৃতি? সে তুলনা মুলতুবি থাকাই শ্রেয়। কারণ, কঙ্কনা স্বতন্ত্র। ছবিতে নস্টালজিয়ায় ভর করে সম্পর্কের পোস্টমর্টেম করেছেন তিনি। তা হলে গঞ্জে কার মৃত্যু হচ্ছে? তার উত্তর রয়েছে ছবির পরতে পরতে। মায়ের মতো ব্যতিক্রমী বিষয় নয়। বরং নিজের ছোটবেলার মনকেমন, গঞ্জের মানুষ, স্মৃতিতে থাকা গল্প নিয়েই প্রধান চরিত্রের একাকীত্বকে জীবন্ত করেছেন পর্দায়।
ছবির প্রধান চরিত্র বিক্রম মাসি।
প্রথম পরিচালনার আগে মায়ের কাছ থেকে টিপস নিয়েছিলেন? মুচকি হেসে কঙ্কনা বললেন, ‘‘ঠিক টিপস বলব না। তবে প্রচুর কথা হয়েছে মায়ের সঙ্গে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে আলোচনা করতাম। মা কিন্তু একদিনও শুটিংয়ে যায়নি।’’ মেয়ের প্রথম ছবি দেখে গর্বিত অপর্ণা। স্পেশাল স্ক্রিনিংয়ের পর বললেন, ‘‘ওই সময়টার রেফারেন্সগুলো ও খুব ভাল রেখেছে ছবিতে। আর আলাদা করে কোনও পরামর্শ নয়। এটা তো একটা জার্নি। ও ছোট থেকে এত গল্প শুনেছে, যে ছবি তৈরিটা একটা প্রসেস।’’
আরও পড়ুন, ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা সবাই একে অন্যের পিঠ চুলকোচ্ছি
অভিনয় থেকে পরিচালনার জার্নিটা ফিল্মের ইতিহাসে নতুন নয়। সূত্র ধরিয়ে দিলেন চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘সারা পৃথিবীতে এখনও ছবি পরিচালনাটা পুরুষতান্ত্রিক। যদিও বাংলা ছবিতে একটা আলাদা ঘরানা রয়েছে। মহিলারা পরিচালক হিসেবে এলে এমন কিছু বিষয় দেখান, যেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। অন্দরমহলের একটা ভিন্ন রূপ, অন্য ধরনের জগত্…। আর অভিনয় থেকে পরিচালনায় আসার উদাহরণও রয়েছে। কানন দেবীর ‘আঁধারে আলো’, অরুন্ধতী দেবীর ‘ছুটি’— দুটোই জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি। তা ছাড়া মঞ্জু দে-র ‘অভিশপ্ত চম্বল’, অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ও উল্লেখের দাবি রাখে। সম্প্রতি ‘নির্বাসিত’ পরিচালনা করেছেন চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিও অভিনেত্রী থেকে পরিচালকের আসনে বসেছেন। সেই পথেই এলেন কঙ্কনাও।’’
ছবির প্রচারে কলকাতায় কঙ্কনা।
সত্যজিত্ রায়-সন্দীপ রায়, যশ চোপড়া-আদিত্য চোপড়া, মহেশ ভট্ট-পূজা ভট্ট— পর পর দু’টো প্রজন্মের পরিচালনায় আসার ইতিহাসে এ যেন এক নতুন সংযোজন। অপর্ণা সেন-কঙ্কনা সেনশর্মাও ঢুকে পড়লেন এই ক্লাবে। নতুন জার্নি শুরু হল। পরেরটা কবে? প্রশ্নটা ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’-এর সহ প্রযোজক অভিষেক চৌবের সামনে করা হলে কঙ্কনাকে থামিয়ে তিনি বলে উঠলেন, ‘‘ও ভীষণ অলস। আমরা তো বলি স্ক্রিপ্ট লিখতে। বাট শি ইজ আ ভেরি লেজি রাইটার।’’ মুচকি হেসে কঙ্কনার জবাব, ‘‘সবে তো একটা হল, এখনও পরেরটা নিয়ে কিছু ভাবিনি।’’ মাকে নিয়েও এখনও কোনও চরিত্র ভাবেননি বলে জানালেন।
আরও পড়ুন, ‘ঋদ্ধিকে আমি হিংসে করি’
সোহাগ সেন শেয়ার করছিলেন, ‘‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, তুমুল প্রশংসা কোনও কিছুতেই যেন আলাদা করে উচ্ছ্বসিত হয় না কোকো। ও ভীষণ সিম্পল।’’ সোহাগের সেই দেখাটাই যেন সত্যি হতে চলেছে। খুব সাধারণ ভাবে পরিচালনার লড়াইতে মাঠে নেমে পড়লেন এক অন্য ঘরানার পরিচালক। অন্তত দর্শকদের একটা বড় অংশ তেমনটাই মনে করছেন।
ছবি: ইউটিউবের সৌজন্যে, নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy