Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
রিচার্ড অ্যাটেনবরো ১৯২৩-২০১৪

ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে বানিয়েছিলেন ‘গাঁধী’

যুদ্ধ, রক্ত, মৃত্যু বড় কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। হয় তো সে কারণেই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অহিংসার আদর্শ এত মুগ্ধ করেছিল তাঁকে। না হলে কেন তীব্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘গাঁধী’ ছবিটি বানানোর জন্য জীবনের কুড়িটা বছর দিয়েছিলেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো? প্রযোজক নেই, একটার পর একটা বাধা, তবু টলেননি। অবশেষে সাফল্য এসেছিল। আটটি অস্কার ও বহু সম্মান। রিচার্ড হেসে বলেছিলেন, “এ ছবির জন্য বাড়িও বন্ধক রাখতে হয়েছিল।”

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। —ফাইল চিত্র

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। —ফাইল চিত্র

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:৩৪
Share: Save:

যুদ্ধ, রক্ত, মৃত্যু বড় কাছ থেকে দেখেছিলেন তিনি। হয় তো সে কারণেই মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর অহিংসার আদর্শ এত মুগ্ধ করেছিল তাঁকে। না হলে কেন তীব্র প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ‘গাঁধী’ ছবিটি বানানোর জন্য জীবনের কুড়িটা বছর দিয়েছিলেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো? প্রযোজক নেই, একটার পর একটা বাধা, তবু টলেননি। অবশেষে সাফল্য এসেছিল। আটটি অস্কার ও বহু সম্মান। রিচার্ড হেসে বলেছিলেন, “এ ছবির জন্য বাড়িও বন্ধক রাখতে হয়েছিল।”

দুর্দান্ত সাফল্যের পরে সামান্য প্রতিক্রিয়া এমনই ছিলেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো। তাই বোধহয় এই পরিচালক, প্রযোজক তথা অভিনেতার মৃত্যুর খবরও খুব সাধারণ ভাবেই জানিয়ে দিলেন তাঁর ছেলে মাইকেল। রবিবার রাতে খবর এল, প্রয়াত রিচার্ড। বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। এটুকুই। কেন, কী ভাবে, কিছুই জানা গেল না। আর পাঁচ দিন পরে একানব্বইতে পা দিতেন এই ব্রিটিশ তারকা।

জীবনের শুরুটা অবশ্য মোটেও তারকাসুলভ ছিল না। তিন ভাইয়ের সব চেয়ে বড় রিচার্ড লেখাপড়ায় ভাল ছিলেন না। তবে অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিল ছেলেবেলা থেকেই। অল্প বয়সে নাটকে হাতেখড়ি হয়েছিল। লন্ডনের মঞ্চে নিয়মিত অভিনয়ও করতেন। দিব্যি চলছিল সব। কিন্তু সে জীবনে ছেদ পড়ল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। পাইলট হিসেবে ব্রিটেনের ‘রয়্যাল এয়ার ফোর্স’ (আরএএফ)-এ যোগ দিলেন তরুণ রিচার্ড। বোমারু বিমান ইউরোপকে কী ভাবে ক্ষতবিক্ষত করছে, তা ক্যামেরাবন্দি করাই ছিল তাঁর কাজ। যুদ্ধের ভয়াবহতা সে সময়ই টের পান তিনি। গাঁধীর সঙ্গে ‘পরিচয়’ হতে তখনও বহু দেরি। সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ও ভবিষ্যতের গর্ভে।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই ব্রিটেনে বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় অবশ্য পরিচিতি মেলে ষাটের দশকে। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পেল “দ্য গ্রেট এস্কেপ।” এক ব্রিটিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রিচার্ড। সেই অফিসারের পরিকল্পনায় জার্মানির ক্যাম্পে আটক যুদ্ধবন্দিরা কী ভাবে পালিয়েছিলেন, সেটাই ছবির গল্প। ‘ওয়ার ফিল্ম’-এর ইতিহাসে আজও খুবই জনপ্রিয় ছবিটি। দুর্দান্ত অভিনয় রিচার্ডের। একের পর এক ‘দ্য ফ্লাইট অব দ্য ফিনিক্স’, ‘দ্য স্যান্ড পেবেলস’, এবং ‘ডক্টর ডুলিটল’। মারকাটারি অভিনয় একের পর এক সম্মান এনে দিল তাঁর ঝুলিতে। তবে শুধু সাফল্যই নয়। যে চার্লি চ্যাপলিনকে দেখে অভিনয়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন, তাঁর জীবনী নিয়ে তৈরি ‘চ্যাপলিন’ মুখ থুবড়ে পড়ে। রিচার্ডের জীবনের সব চেয়ে বড় ‘ফ্লপ’।

এই সাফল্য-ব্যর্থতার সঙ্গেই চলছিল ‘গাঁধী’ ছবির প্রস্তুতি। ১৯৬২ সালে রিচার্ডকে ছবিটি বানানোর অনুরোধ জানিয়ে ফোন করেছিলেন লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশনের কূটনীতিক মতিলাল কোঠারি। সে সময় অবশ্য গাঁধীজির সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতেন না রিচার্ড। তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁকে দু’টি বই পড়তে বলেছিলেন মতিলাল। পড়া শেষ হতে না হতেই লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেনের (ভারতের শেষ ভাইসরয়) মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন উত্তেজিত রিচার্ড। নেহরু সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালে তাঁর মৃত্যু হলে আটকে যায় ছবির কাজ। এর মাঝেই পরিচালক ডেভিড লিন জানান, গাঁধীজিকে নিয়ে তিনিও একটি ছবি করতে চলেছেন। বিষয়টি নিয়ে রিচার্ডের সঙ্গে কথাও হয় তাঁর। কিন্তু তার পর অন্য ছবিতে কাজ শুরু করে দেন ডেভিড। সে সময় মতিলালেরও মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে জোড়া বাধা।

দমেননি রিচার্ড। সিদ্ধান্ত নেন নিজেই প্রযোজনা করবেন ছবিটি। সে জন্য গাড়ি, মূল্যবান আসবাব বিক্রি করে দেন। বাড়িও বন্ধক রাখেন। সাহায্যের হাত বাড়ান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। তত ক্ষণে অবশ্য অনেকটা সময় চলে গিয়েছে। তার পর গাঁধী চরিত্রের জন্য বেন কিংসলের নির্বাচন, শু্যটিংয়ের আয়োজন এবং শু্যটিং সব মিলিয়ে ছবি শেষ হতে হতে আশির দশকের শুরু। তখনও অনেকে কটাক্ষ করে চলেছেন, ধুতি পরা হাতে লাঠি এক বৃদ্ধের কাহিনি দেখতে কেউ আসবে না। কান দেননি রিচার্ড।

ভাগ্যিস দেননি! ১৯৮২ সালে মুক্তি পেল ‘গাঁধী’। তুমুল প্রশংসা, অবিশ্বাস্য সাফল্য। প্রযোজনার কুড়ি গুণ অর্থ আয় করেছিল ছবিটি। দুনিয়া নতুন করে চিনল গাঁধীজিকে। রিচার্ড চিনলেন ভারতকে। সেই শুরু। যত দিন শরীর দিয়েছে, তত দিন পর্যন্ত ভারতীয় হাইকমিশনের নানা অনুষ্ঠানে হাজির থেকেছেন রিচার্ড।

তবে ‘গাঁধীর’ আগেই সত্যজিৎ রায়ের ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’তে (১৯৭৭) তাঁকে দেখেছিল ভারত। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিটিশ জেনারেল জেমস আউট্রামের চরিত্রে তাঁর অভিনয় ভোলার নয়। ভারতের সঙ্গে এ ভাবেই জড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাই বোধহয় ব্যতিক্রমী ভাবে এক ব্রিটিশ অভিনেতার মৃত্যুতে এতটা শোকাহত বলিউড। অনিল কপূর, অনুপম খের থেকে শুরু করে ‘গাঁধী’তে কাজ করা অলোক নাথ পর্যন্ত অনেকেই টুইটারে শোকপ্রকাশ করেছেন।

শোকাহত স্টিভেন স্পিলবার্গও। ১৯৯৩ সালে এই হলিউড পরিচালকের ছবি ‘জুরাসিক পার্ক’-এই ফের দেখা যায় রিচার্ডকে। হাসিতে শিশুসুলভ সারল্য, ধবধবে সাদা চুল-দাড়ির সেই ‘জন হ্যামন্ড’কে আজও দেখে মুগ্ধ হন আবালবৃদ্ধবনিতা। তাঁর তৈরি ‘জুরাসিক পার্ক’-এই তো দাপিয়ে বেরিয়েছিল দানবীয় ডাইনোসররা। ছিলেন জুরাসিক সিরিজের পরের ছবি ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এও। একটা প্রজন্ম, যারা ‘গাঁধী’র পরিচালককে চেনে না, তাদের কাছে অ্যাটেনবরো মানে জুরাসিক পার্কের জন হ্যামন্ডই। হাসিখুশি, সরল এক মানুষ। ব্যক্তিজীবনেও সরল সোজাই ছিলেন। বলতেন, “আমি মহান পরিচালক হতে চাই না। শুধু গুছিয়ে গল্প বলতে চাই।”

জীবনের গোটাটাই অবশ্য গল্পের মতো সুন্দর কাটেনি। ২০০৪ সালের সুনামিতে এক মেয়ে ও নাতনিকে হারিয়েছিলেন রিচার্ড। প্রায়ই আক্ষেপ করতেন, “ওদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারিনি। আসলে জীবনে কাজই ছিল একমাত্র অগ্রাধিকার।”

ভুল বলেননি রিচার্ড। কাজ নিয়ে পাগলামি না থাকলে কেউ কি নিজের বাড়ি-ঘর বন্ধক রেখে ছবি বানাতে পারেন? দুর্দান্ত সাফল্যকে অভ্যর্থনা জানাতে পারেন সামান্য হাসি দিয়ে? বাধার পাহাড় পেরিয়ে গল্প বলতে পারেন এত সুন্দর করে?

নীরব বিদ্রোহের নাম রিচার্ড অ্যাটেনবরো যে।

অন্য বিষয়গুলি:

richard attenborough death srabani basu gandhi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE