হে রাম!: রামনবমীর মিছিল। এবং একেবারে শহর কলকাতার মাঝখানে। মানিকতলা, ৫ এপ্রিল ২০১৭। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
অতএব রাম নাম ‘সত্য’ হল! রাজ্য রাজনীতির ময়দানে রাম-মাহাত্ম্যের এ হেন বিস্ফোরণ সম্ভবত কখনও দেখা যায়নি। অযোধ্যাপতি রামচন্দ্র বিজেপি আরএসএস-এর ঘরের লোক। তাঁকে সামনে রেখে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। দেশে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বদলেছে বার বার। বিশেষত হিন্দি বলয়ে মাথাচাড়া দিয়েছে বিদ্বেষের বিষবাষ্প। ২০০২’এ গুজরাতের দাঙ্গায় সরকারি হিসেবেই প্রাণ গিয়েছে ৮০০ মুসলিম ও ৩০০ হিন্দুর। এমন আরও কত কী! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে সশস্ত্র ‘রাম কহো’ নিনাদ কখনও এই রূপ পায়নি। এ বার তা-ও দেখা গেল।
আর শুধু দেখাই নয়। রামের নাম নিয়ে হুঙ্কার এবং পাল্টা হুঙ্কারে এটাও স্পষ্ট হল যে, বিরোধী বিজেপি ও শাসক তৃণমূল সবার কাছেই এখন রাম নাম পরম সত্য। লড়াই এ বার রামের সঙ্গে রামের।
উত্তরপ্রদেশে বিপুল জয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি এবং তার নেপথ্য নিয়ন্ত্রকেরা যে দেশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কাজে আরও বেশি করে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা নিয়ে খুব সংশয় ছিল না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ তাঁদের অন্যতম টার্গেট, সেটাও মোটামুটি জানা। এখন মোদীর সঙ্গে মমতার বৈঠকের পরে কোনও ‘ট্র্যাক টু’ বোঝাপড়ার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা চলতেই পারে। তবে সাধারণ বুদ্ধিতে মনে হয়, মমতা বর্তমানে যে রাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছেন, তাতে ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ‘মধুর’ হওয়া কঠিন।
কারণ, ২০১৬ বিধানসভার তুলনায় ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই রাজ্যে তাদের শক্তি বাড়াতে পারে। অপটু সিপিএম এবং অথর্ব কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী রাজনীতির ময়দানটা ক্রমশই যেন বিজেপি’র জন্য ফাঁকা করে দিচ্ছে। এটা যত হবে, ততই বেশি করে ‘রামভক্ত’দের হাতের অস্ত্র চমকাবে। রাজ্যের এখানে ওখানে নানা রকম প্ররোচনামূলক ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সম্প্রীতির বাতাবরণ বিষাক্ত করার চেষ্টা চলবে। সেই সব কার্যকলাপের একটা প্রভাব যে ভোটের মেশিনে পড়বে না— কে বলতে পারে! আর তাতে ‘লাভ’ যা হবে তা মূলত বিজেপি’র।
মমতার মতো বিচক্ষণ, বাস্তববাদী নেত্রী এটা বোঝেন না, তা তো নয়। ফলে তাঁর পক্ষে রাজ্যে ৩০ শতাংশের মতো সংখ্যালঘু ভোট যত দূর সম্ভব বুক দিয়ে আগলে রাখার কোনও বিকল্প নেই। সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ ইতিমধ্যেই তৃণমূলের করায়ত্ত। সিপিএম এবং কংগ্রেসের ডুবন্ত নৌকো থেকে আরও কিছুটা মমতার তরীতে গিয়ে ভিড়লে স্বাভাবিক ভাবেই তৃণমূল নেত্রী আরও বেশি ‘সংখ্যালঘু ত্রাতা’ হয়ে উঠবেন। তাই বিজেপি-র সঙ্গে যোজন-দূরত্ব তাঁকে রাখতেই হবে। এর সঙ্গে কোনও লাঞ্চ-ডিনার বা একান্ত বৈঠক আপাতভাবে সম্পর্কহীন বলেই মনে হয়। এটা অবশ্যই চেনা ছক।
কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে যে ‘রাম-রাজনীতি’ পশ্চিমবঙ্গকে গ্রাস করেছে, তাকে অচেনা বিপদের ইঙ্গিত বললে বোধ হয় ভুল হবে না। রামের নামে রাম-দা উঁচিয়ে, কপালে রক্ততিলক কেটে, মাথায় ফেট্টি বেঁধে রাস্তায় রেরে করে বেরিয়ে যাঁরা সপ্তাহখানেক রাজ্য জুড়ে ‘রামনবমী’ পালন করছেন এবং সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলছেন, ‘বেশ করছি। ফের করব...’, তাঁদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। উঠছেও।
এই রামবাহিনী রাজ্যের শাসক দলকে এক অদ্ভুত ফাঁদে ফেলেছে। রোজ দা-কাটারি-তরোয়াল নিয়ে একাধিক জায়গায় মিছিল বের করছে। সরকার ওই সব মিছিল বন্ধে নির্দেশ ও গ্রেফতারের হুঁশিয়ারি দেওয়া সত্ত্বেও, খুব সহজবোধ্য কারণে তা আটকানোর চেষ্টা হচ্ছে না। জোর করে আটকাতে গেলে পরিস্থিতি কোথায় গড়াবে, অনুমানের অপেক্ষা রাখে না। ফলে এক দিকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি, অন্য দিকে সশস্ত্র ‘রাম-নিনাদ’ ও পাল্টা হুমকি সমানে চলেছে! অর্থাৎ, বিজেপি দেখাতে পারছে তাদের ‘লক্ষ্যে’ তারা সফল। সরকারকে তারা ‘রাম-প্যাঁচে’ ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে এ এক বেনজির প্রবণতা।
এমন পরিস্থিতিতে যে কোনও শাসকেরই বিব্রত হওয়ার কথা। মমতাও নিশ্চয়ই কিছুটা অস্বস্তিতে। তাই আপাতত তাঁরও ‘অস্ত্র’ রাম। বার বার বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁকে বলতে হচ্ছে, ‘রাম কারও একার নন।’ রাম দিয়ে রাম-কাঁটা তোলার এই কৌশলে তৃণমূলের অনেক নেতা-মন্ত্রীও শামিল। রাম মিছিলে তাঁদের অনেককে দেখা যাচ্ছে। হয়তো বা চাপে পড়ে। কারণ আগে কখনও এটা দেখা যায়নি।
এই ভাবেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে হঠাৎ যেন হু হু উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাজ্য রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠছেন রাম। লড়াই রামের সঙ্গে রামের! এক কথায়, ‘ওদের রাম’ বনাম ‘আমাদের রাম’।
রামের ওরা-আমরা ভেদরেখাটা বঙ্গভূমে এত কাল খুব মোটা দাগেই চেনা যেত। উত্তর ভারতে রাম এবং রামভক্ত হনুমানের পুজো যেমন সর্বজনীন, এ রাজ্যে তেমন নয়। বাংলায় রাম আদতে পুরাণের নায়ক। এখানে বাঙালির ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় রাম পূজন, হনুমানচালিশা পাঠের আয়োজন ব্যাপক হারে দেখা যায়নি। অধিকাংশ রাম মন্দির, হনুমান মন্দির আজও অ-বঙ্গভাষী এলাকায় কেন্দ্রীভূত। বাঙালির রামনবমীও মূলত অন্নপূর্ণা-বাসন্তী পুজোর পরিসরেই পালিত হয়ে এসেছে। আলাদা করে রামনবমীর উৎসব বাঙালি পালন করেনি।
কিন্তু গত কয়েক বছরে, প্রধানত বাবরি-কাণ্ডের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে বাঙালির সামাজিক জীবনেও নীরবে কিছু বদল ঘটে গিয়েছে। আর তা বেশি হয়েছে শহর এলাকাগুলিতে সাধারণ শিক্ষিত, মধ্যবিত্তদের মধ্যে। অনেক বাঙালি এখন হনুমান মন্দিরে সাপ্তাহিক পুজো চড়ান। হনুমানচালিশা পাঠ করেন। অন লাইনে ‘হনুমান কবচ’ অর্ডার দেন। অনেকেই নজর করেছেন, হনুমান কবচের বিজ্ঞাপনে মুখ হয়ে উঠেছেন বাংলা সিনেমার পরিচিত নায়ক-নায়িকারা। অর্থ সহজ। বাঙালির ঘরে হনুমানজির ‘মার্কেট’ আছে!
এই রকম আবহে এ বারের রামনবমী পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে ‘ব্যবহৃত’ হল, তাতে বিতর্ক তৈরি হলেও বিরোধিতার অবকাশ ছিল কম। বীরভূমের কেষ্ট মণ্ডলের মতো তৃণমূল নেতারা তো অনেক জায়গায় হনুমান পুজোও করেছেন। সব মিলিয়ে বিস্তৃত হচ্ছে রামের রাজ্যপাট। কারও স্বাধীন ধর্মাচরণ নিয়ে অবশ্যই কোনও কথা হতে পারে না। কে রামের পুজো করবেন, কে হনুমানের বা দুর্গা-কালি-শিব-নারায়ণের, সে সব সম্পূর্ণত তাঁদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু যা ভেবে দেখার, তা হল রামের পুজো ঘিরে অস্ত্রের ঝনঝনানি এবং সরকারি নির্দেশকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার হিম্মৎ!
এখানেই শেষ হওয়ার নয়। হয়তো শুরু! বিষবৃক্ষ এক বার ডালপালা ছড়ালে পরিণতি শুভ হয় না। অঙ্কুরেই বিনাশ করা শুভবুদ্ধির কাজ। রাম-রহিমের রাজনীতি থেকে মুক্ত ছিল আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। সেই গর্বেও কি এ বার কালির ছিটে লাগবে? রাজনীতির কারবারিরা একটু ভেবে দেখুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy