অবসান: দিল্লির বিড়লা হাউস-এ শয়ান গাঁধীজির নিষ্প্রাণ দেহ। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮। নিজস্ব চিত্র
সেই ৩০ জানুয়ারি উনিশশো আটচল্লিশ থেকে ১৫ নভেম্বর, উনিশশো ঊনপঞ্চাশ। মহাত্মার বুকে বুলেট ফুঁড়ে যাওয়া এবং ঘাতক নাথুরাম গডসের ফাঁসির মধ্যে প্রায় দুই বছরের সময়-ব্যবধান ভুলে গিয়ে যদি কল্পনা করি, গাঁধী নাথুরাম গডসের ফাঁসির খবরটা নিজের কানেই শুনছেন? কী বলতেন তিনি? ভাবতে অসুবিধে নেই, কেননা, তিন দশকেরও বেশি যে কথা তিনি একনাগাড়ে বলে গিয়েছেন, এর আগের বছরও তাঁর উপর প্রাণনাশের চেষ্টার পর তিনি আততায়ী বিষয়ে যা বলেছিলেন, জীবনের অন্তিম মুহূর্তের নিজের বুকের উপর চারটি বুলেট তাঁর সেই ভাবনাচিন্তা পালটে দিত বলে মনে হয় না।
বলতেন তিনি, গডসেকে ক্ষমা করো, আমি ওকে ক্ষমা করেছি।— ‘আমি বুঝতে পারি, মন্দ কাজের জন্য শাস্তি না দিলে সমাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে,’ কিন্তু ‘তবু বলব আমাদের উচিত ওদের মন পালটানোর জন্য চেষ্টা করা। শাস্তি দেওয়া নয়।’ ‘ওয়ান উড প্রে ফর দেয়ার রিফরমেশন, বাট নট ফর দেয়ার পানিশমেন্ট।’ নিজের ঘাতককে তাই ঘৃণা করতেন না তিনি, ‘এমপ্যাথি’ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতেন কেন, কোথা থেকে তার মনে জন্মাল বুলেটের মতো এই তীব্র ঘৃণা।
ঘৃণা জিনিসটা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবতেন তিনি, ভাবাতে চাইতেন। ‘ওরা ভাবে জাতীয়তাবাদের জন্য ঘৃণা করাটা জরুরি। ভুল ভাবে ওরা। আমি ওদের দোষ দিচ্ছি না, ওদের জন্য আমার কষ্ট হয়, কারণ বুঝতে পারি ওরা একটা ভুল ভাবনার চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে।’ তাই, ‘ওদের’ প্রতি, আমাদেরও প্রতি, তাঁর বার বার প্রশ্ন: আমি যা ঠিক বলে মনে করি, আমার নিজেরই বাবা মা ছেলে মেয়ে যদি সেটা না করে, যদি কোনও ভুল করে, আমি কি তাকে ‘ঘৃণা’ করব, না কি তাদের বোঝানোর চেষ্টা করব? নিজের লোকের ক্ষেত্রে যদি তা-ই করি, অন্যের ক্ষেত্রেও সেই এক কাজ তবে করব না কেন? তাদের ততটা আপন ভাবতে পারব না কেন? আমার ঘাতক যদি ভুল করে থাকে, তাকে ঘৃণা করে দূরে ঠেলব কেন? এই ভাবে ‘ঘৃণা’, অর্থাৎ আরও ঠিক করে বলতে গেলে, ‘অ-ঘৃণা’ ছিল গাঁধীজির মত ও আদর্শের একটা প্রধান স্তম্ভ।
কথাটা সামান্য নয়। কেননা সেই কালান্তক তিরিশে জানুয়ারি তাঁর অপর দিকে যিনি ছিলেন, সেই নাথুরাম গডসের মত ও আদর্শে আবার এই ‘ঘৃণা’ বিষয়টির একটা গুরুতর ভূমিকা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। গডসে নিজে বলে গিয়েছেন সে কথা। তিনি যে কোনও সমাজবিরোধী খুনি ছিলেন না, শিক্ষিত সংস্কৃত ‘উচ্চ’বংশজাত চিৎপাবন মরাঠি এই ব্রাহ্মণ একটি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, যার নাম ছিল ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। রাষ্ট্র, হিন্দুত্ব ইত্যাদি নিয়ে অনেক লেখা আছে তাঁর। কেন গাঁধীকে ‘মারতে হল’, একাধিক বার সে কথা বলে গিয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের পর দিল্লির পার্লামেন্ট স্ট্রিটের থানায় তাঁকে আটক রাখার সময় গাঁধীর ছেলে দেবদাস গিয়েছিলেন সেখানে। চিনতে পেরে গডসে তাঁকে ডেকে অতি-ভদ্র ভাবে বলেছিলেন, ‘আপনি আজ পিতাকে হারিয়েছেন, আপনার কষ্ট আমি বুঝতে পারছি’: ‘আই অ্যাম মাচ গ্রিভড অ্যাট দ্য বিরিভমেন্ট দ্যাট হ্যাজ বিফলেন ইউ।’ কিন্তু কোনও উপায় ছিল না তাঁর, কেননা গাঁধীর থেকে ভারতের তিরিশ কোটি হিন্দুকে বাঁচানোর ‘এটাই একমাত্র পথ’। হত্যা, এবং হত্যার জন্য প্রয়োজনীয় ঘৃণা, তাতেই তাঁর বিশ্বাস, সেটাই তাঁর যুক্তি। অপরাধবোধ নেই তাঁর, কেননা সেই ঘৃণা কোনও ‘ব্যক্তিগত’ বিষয় নয়। এ ঘৃণা ব্যক্তিগত-র চেয়ে অনেক বড়: সমাজ-গত, ধর্ম-গত।
গডসে— গডসেরা— বলবেন, যে মুহূর্তে ঘৃণাকে এই ভাবে বড় করে দেখা যায়, ঘৃণা যেন কেমন ‘মহৎ’ হয়ে ওঠে। বলবেন, কোনও ক্ষুদ্র সংকীর্ণ সাংসারিকতা থেকে তার উৎপত্তি নয়, দেশকে বাঁচানোর নামে, জাতিকে নবজীবনদানের নামে সেই ঘৃণার বিকাশ, সেখানেই তার ‘মহত্ত্ব’। গডসেই বুঝিয়ে দেন, কত প্রবল হয়ে উঠতে পারে সেই মহত্ত্বের দায়বোধ, যাতে তিনি নিজে যেচে হাতে নেন মহাত্মাকে খুন করে দেশ ও ধর্মকে বাঁচানোর কাজটি। হঠাৎ আবেগের বশে তো এ কাজ করেননি তিনি। ভেবেচিন্তে, অনেক ‘সাধনা’র পথ বেয়ে এখানে পৌঁছেছেন। নেহাত ‘ফ্যানাটিক’ বলে গডসের ‘সাধনা’কে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়, তলিয়ে দেখা উচিত। যেমন দেখেছিলেন সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক আশিস নন্দী, সেই সত্তরের দশকে তাঁর ‘দ্য ফাইনাল এনকাউন্টার: দ্য পলিটিক্স অব দি অ্যাসাসিনেশন অব গাঁধী’ প্রবন্ধটি লেখার সময়। কিংবা সম্প্রতি যে-ভাবে দেখেছেন ফয়সল দেবজি, গাঁধীর উপর তাঁর ‘দি ইমপসিবল ইন্ডিয়ান’ বইয়ে ‘আ নেশন মিসপ্লেসড’ অধ্যায়টি লেখার সময়।
দুটি লেখার শিরোনামই আজকাল নতুন করে ভাবায়। সত্যিই, ফাইনাল এনকাউন্টার-ই বটে। গাঁধী আর গডসে সে দিন কেবল দুই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে তো পরস্পরের সামনাসামনি হননি। তাঁরা ছিলেন দুটি আলাদা চিন্তাধারার দুই পরাক্রান্ত প্রতিনিধি। গডসে বা তাঁর সহযোগী নারায়ণ আপ্টেরা বলবেন, ওই দুই ধারার মূল দ্বন্দ্বটা হল ‘মুসলিম তোষণবাদ’ আর ‘হিন্দুত্ব রক্ষা’র মধ্যে। আর দেবদাস গাঁধীরা বলবেন, দ্বন্দ্বটা ধর্মনিরপেক্ষতা (সেকুলারিজম) ও ধর্মান্ধতা (ফ্যানাটিসিজম)-র মধ্যে। কিন্তু দ্বন্দ্বটাকে আমরা যদি এ সব বড় আদর্শ-উদ্দেশ্য-তত্ত্বের চক্করে না ফেলে দুটো আলাদা মানস-জগতের মধ্যে দেখতে চেষ্টা করি, তা হলে স্পষ্ট হবে যে, এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে গাঁধীর ‘অ-ঘৃণা’র মানসজগৎ, অন্য দিকে গডসের সেই ‘বড় ঘৃণা’র মানসজগৎ। এক জন প্রশ্ন করেন, ‘ইজ হেটরেড এসেনশিয়াল ফর ন্যাশনালিজম?’ অন্য জন আত্ম-বিশ্লেষণ করেন, তাঁর মতো ‘ডিউটিফুল সন অব মাদার ইন্ডিয়া’র প্রথম কর্তব্য ‘দ্য সো-কলড ফাদার অব দ্য নেশন’-এর জীবন শেষ করে দেওয়া। দুই মানসিকতা পরস্পরের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে ঝকঝকে যুযুধান: তাদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়া হয় না, হওয়ার কথাও নয়, দুই পক্ষই অন্য পক্ষকে ‘আ নেশন মিসপ্লেসড’ মনে করে।
কেবল অহিংসা দিয়ে বোধহয় গাঁধীর এই ‘অ-ঘৃণা’কে পুরোটা বোঝা যায় না। অহিংসার ‘অ-সাধারণ’ আদর্শ ছাড়াও একটা খুব সাংসারিক ভালবাসার ‘সাধারণ’ আদর্শ গাঁধীর এই অ-ঘৃণার মধ্যে কুলুকুলু বয়। তাই বার বার সংসারের উদাহরণ তাঁর কথায়। পুত্র কন্যা ভুল করলে তাদের যেমন শুধরে দাও, অন্যদেরও তাই করো, দূরে ঠেলো না, সকলকে একটা ‘আপন’ বৃত্তের মধ্যে নিয়ে এসো। সেই আপন বৃত্তে এমন লোকও থাকতে পারে, যাকে তত ভালবাসতে পারো না। কিন্তু ভাল না বাসার মানেই কি ঘৃণা করা? এ-ই কি আমরা শিখি সংসারে? না। ভালমন্দ সবাইকে পাশে নিয়ে চলতে শিখি। তবে দেশ বা সমাজেও তাই নয় কেন?
গাঁধীর বিরুদ্ধে চরম অভিযোগ, তিনি আজীবন মুসলিমদের ‘তোষণ’ করেছেন। গাঁধী কিন্তু নিজেকে মনে করতেন ‘সনাতন হিন্দু’, হিন্দুত্বের আদর্শেই তাঁর চির-আস্থা। এই দুই বিপরীতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আসল কথাটা কী? আসল কথা, গাঁধীর জীবনে ধর্ম— হিন্দুধর্ম— সত্যিই ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ ছিল হিন্দু অনুশাসন, এমনকী সংস্কারও। তিনি মনে করতেন, হিন্দু মুসলমানের একসঙ্গে একপাতে খাওয়া অসম্ভব। মনে করতেন, হিন্দু মুসলমান আন্তঃ-বিবাহ মানা যায় না, যদিও পরে তিনি এই মত পালটান। কিন্তু এ সবের জন্য মুসলমানদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসতে তাঁর আটকায়নি, মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অনশন করতে আটকায়নি, দাঙ্গার মধ্যে মুসলমান আতিথ্য নিয়েছেন কত বার। কেনই বা নয়? নিজের ছেলেকে খুব ভালবাসি, খুব বিশ্বাস করি, তাই বলেই কি তার এঁটো খেতেই হবে? ছেলে ভুল করছে, তাই বলে কি বিপদে তার কাছে গিয়ে আশ্রয় নেব না? এ সব বাহ্যিক রীতি-পদ্ধতির সঙ্গে ভালবাসা বা মনের টানটাকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না: তাঁর সকাতর অনুরোধ। ধর্মের আসল কথাটা ওখানেই— মনের টান। সকলকে নিয়ে বাঁচা। সকলকে আপন ভাবা। তাই নিজের ধর্ম অন্যের ধর্ম সবই তাঁর কাছে ‘আপন-করা’র অঙ্গন, ‘পর-করে-দেওয়া’ যুদ্ধক্ষেত্র নয়। নিজের ধর্মের সঙ্গে আত্ম-সমালোচনার স্বরে কথা বলেন তিনি, আরও উদার হতে বলেন। অন্য ধর্মের সঙ্গে কথা বলেন যখন, সেই উদার মনকে পৌঁছে দিতে চান তাদের কাছে। তাদের ধর্মকে ছোট করা বা ভুল ধরা তাঁর কাজ নয়। নিজ ধর্মই হোক, পরধর্মই হোক, তিনি শুধু চান ‘টু মেক হিম (অর হার) আ বেটার ফলোয়ার অব হিজ (আর হার) ওন ফেথ।’
‘অ-ঘৃণা’ এবং ‘এমপ্যাথি’, এটাই তবে গাঁধীজির ‘ফেথ’ বা ধর্মেরও মূল কথা, তাঁর ‘ন্যাশনালিজম’ বা জাতীয়তাবাদেরও মূল আদর্শ। যে ধর্ম বা যে জাতীয়তাবাদ এই ‘এমপ্যাথি’র বদলে ‘কনফ্লিক্ট’ বা দ্বন্দ্বকে প্রাধান্য দেয়, তার কাছে অবশ্যই গাঁধী অতি বিষময় প্রভাব, পৃথিবী থেকে তাঁকে সমূলে সরিয়ে দেওয়াই মঙ্গল।
গাঁধী-গডসে অতীত। কিন্তু তাঁদের সেই ‘ফাইনাল এনকাউন্টার’ আজও ঘটমান বর্তমান, তীব্র বেগে বহমান। ধর্ম, জাতি, রাজনীতির নামে যে ঘৃণা নিজেকে ‘মহৎ’ মনে করে, সে আজ আরওই তৎপরতার সঙ্গে সবাইকে বোঝাতে উদ্যত যে, ‘এমপ্যাথি’র পথটা মহৎ নয়, বৃহৎও নয়, কেবল বোকামি আর দুর্বলতা, এবং অনেক সময়, আরও খারাপ, ‘বানিয়া’-সুলভ চতুরতা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy