আজ শ্রীশ্রীমা সারদার ১৬৪তম জন্মতিথি
নিজের গর্ভজাত সন্তান না থাকায় স্বামী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি মৃদু অভিযোগও করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জানিয়েছেন, কালে কালান্তরে, বহু ‘ছেলে’র ‘মা’ ডাক শুনে ক্লান্ত হতে হবে তাঁকে। পালন করতে হবে মাতৃত্বের প্রভূত দায়িত্ব। মহাসমাধির আগে শ্রীরামকৃষ্ণ উদ্যানবাটীর জানলা দিয়ে কলকাতার দিকে অঙ্গুলিসংকেত করে সমস্যায় ‘কিলবিল’ করা মানুষের দেখভালের ভার অর্পণ করেছিলেন সারদামণির উপর। ১৮৭২ সালে, জ্যৈষ্ঠ অমাবস্যার কালীপুজোর রাতে সারদাকে ষোড়শী রূপে পুজো করে, তাঁর মধ্যের শক্তির জাগরণ ঘটিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। মার কাজে, মননে-চিন্তনে সেই শক্তিরই প্রকাশ।
সেই রূপ প্রচ্ছন্ন রেখেছেন সারদা। এক বার মাত্র বলেছেন, ‘লোকে বলে কালী’: নিরুপায় হয়েই মৃদু স্বরে স্বরূপ ব্যক্ত করেছেন। এই শক্তিই তাঁকে লোকজননী, সঙ্ঘজননী, দেশজননী, বিশ্বজননী করেছিল। অথচ তিনি সহজ সরল মাটির কন্যা। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় ‘রূপ ঢেকে আসা’।
মানুষের কষ্ট তাঁকে পীড়া দিত। জমিদারের পীড়নের বিরুদ্ধে চাষির মেয়েদের প্রতিরোধ গড়তে প্রেরণা দিয়েছেন। খরাক্লিষ্ট গ্রামবাসীদের তীব্র দুঃখ তাঁকে জর্জরিত করেছিল, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর প্রাত্যহিক জীবন-ছন্দ। সন্তান অভুক্ত থাকলে ‘মা’ কি খেতে পারেন? শ্রীরামকৃষ্ণের ‘মাতৃভাব’-এর দীপ্ত প্রকাশ তাঁর মধ্যে। সঙ্ঘজননী রূপেও শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তাঁর প্রার্থনা— ‘তোমার নামে যারা বেরুবে তাদের মোটা ভাত-কাপড়ের অভাব যেন না হয়।’ সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পর বিবেকানন্দ বলেছেন, শ্রীশ্রীমা আমাদের শুধুই গুরুপত্নী নন ভাই, তিনিই রক্ষাকর্ত্রী, পালনকারিণী, সঙ্ঘজননী। ত্যাগীদের শৃঙ্খলায়-সংযমে-নির্দিষ্ট লক্ষ্য উত্তরণে নিয়মিত দৃষ্টি দিয়ে মা উৎসাহিত করেছেন। সতর্ক ও শাসন করেছেন। স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশে বারাণসী ও কঙ্খলে সেবার উদ্দেশ্যে হাসপাতাল হওয়ার সময় সন্ন্যাসীর সেবাদর্শ নিয়ে দ্বন্দ্ব হলে শ্রীমা সেবাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। মায়াবতী আশ্রমে সাধনা নিয়ে দ্বন্দ্বের নিরসন করে, অদ্বৈত ভাবের সাধনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সঙ্ঘজননী রূপে বেলুড় মঠকে রক্ষা করেছেন। কারমাইকেলের কাছে সারদানন্দ ও জোসেফিন ম্যাকলাউডকে পাঠান, যাতে ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিষ্ঠান গণ্য করে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করা হয়। সারদাদেবী জানান, ‘মা’ বলে যারা আসে তাদের সকলকেই তিনি আশ্রয় দেন। কে স্বদেশি, কে বিদেশি: তা তাঁর জানা নেই।
স্বামী বিবেকানন্দের পাশ্চাত্যে ভাবপ্রচারের সূত্রে মার্গারেট নোবল, জোসেফিন ম্যাকলাউড, সারা ওলি বুল, সিস্টার ক্রিস্টিনসহ অগণন ভক্ত মাতৃসমীপে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা এ দেশের সংস্কৃতির পরিচয় তাঁর কাছে পেয়েছেন, তাঁর প্রেরণাতেই সমাজশিক্ষায় এগিয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, ‘মাতৃভাব সবচেয়ে শুদ্ধভাব।’ সারদাদেবী সেই মাতৃভাবের প্রতিমূর্তি। সন্তানের জন্ম দিলেই জননী হওয়া যায় না। ‘জননী’ হয়ে উঠতে হয় সত্তার নানা স্তর পেরিয়ে। সন্তানের সার্বিক কল্যাণে শ্রীমা সদাতৎপর। ভক্ত সন্তানদের পথশ্রমের শ্রান্তি লাঘবের জন্য চান চা-পান করাতে, তাই গ্রাম ঘুরে ঘুরে দুধ সংগ্রহ করেছেন। পছন্দ মনে রেখে সামান্য আয়োজনেই তৈরি করেছেন খাবার, ভ্রাতৃবধূর আঁতুড়ে পৌঁছে দিয়েছেন অতি যত্নে রান্না করা বলকারক ঝোল। দূরের ভক্তদের পথের খাবার বেঁধে দিয়েছেন, সঙ্গে দিয়েছেন খরচ বাঁচিয়ে জমানো চার পয়সা। রক্তের সম্পর্কে নয়, মাতৃভাবের টানেই সবাই আপন।
সহনশীলতা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যে সয়, সেই রয়/ যে না সয়, সে নাশ হয়।’ অভিভাবকসুলভ দূরদর্শিতায় ভক্তকে সামান্য মিথ্যে বলার মনস্তাপে চাকরি ছাড়তে না করেছেন, কারণ তখন তাকে অভাবের তাড়নায় আরও বড় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হতে পারে। দক্ষ পরিচালন শক্তি নিয়ে বলেছেন, ‘যখন যেমন, তখন তেমন, যাঁকে যেমন, তাঁকে তেমন।’ শুনতে সহজ হলেও এ ভাবনা সোজা নয়।
আজ ভোগসর্বস্বতায় আমরা জীবনের ‘প্রচুর ভাঁড়ার’ খুঁজে ফিরছি, ত্যাগে, সহজ সারল্যে যে আনন্দ, তাকে ভুলতে বসেছি। হতাশা-বিষণ্ণতায় অস্থির হয়ে ত্যাগ করছি সদ্যোজাত সন্তানকে, কখনও বা উদ্দাম ভোগলালসায় অভ্যস্ত করে তাকে ছুড়ে দিচ্ছি নির্মম পৃথিবীতে।
সারদাদেবী নির্বাসনার কথা বলেছেন। বলেছেন, ‘জগতের কেউ পর নয়।’ এই সকলের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখা, আপন করে নেওয়াই প্রকৃত শিক্ষা। অদ্বৈতবাদের এই ধারণার মধ্য দিয়েই শিখিয়েছেন জাতপাত ও অর্থের ভেদবৈষম্যের ঊর্ধ্বে ওঠা সম্ভব। ‘অপরের দোষ নয়, দোষ দেখবে নিজের’: নিজ স্বভাবের মূল্যায়ন ও পরিমার্জনাই আত্মগত সংকট থেকে আমাদের নিস্তার দিতে পারে। মা সারদা তাঁর ঐশীবোধ, অপার জ্ঞান ও অতলান্ত ভালবাসা ছড়িয়ে দিয়ে যে পথে সন্তানদের এগিয়ে দিতে চেয়েছেন, আজও তা অনুসরণ ছাড়া আমাদের মুক্তি নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy