লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদ্যাপনের ভাষণে ইন্দিরা গান্ধী যখন বলছিলেন গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে পৌঁছে যাওয়ার কথা, ১৯৭৫-এর ২৫ জুন তখনও তিন বছর দূরে। গণতন্ত্রের প্রতি ভরসা রাখার কারণ বিলক্ষণ ছিল তাঁর— ‘বৃদ্ধতন্ত্র’-কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দল ভেঙে নতুন দল গঠন করে আগের বছরই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে ফিরেছেন তিনি। তাঁর জনপ্রিয়তার পারদ তুঙ্গস্পর্শী হল ডিসেম্বরে, যখন পাকিস্তানকে পর্যুদস্ত করল ভারতীয় সেনা। তত দিনে ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্তকরণ সম্পূর্ণ, বিমা ক্ষেত্রকেও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হবে বছরের শেষে— সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটার গতি ক্রমবর্ধমান। ১৯৭১-এর নির্বাচনের ‘গরিবি হটাও’ স্লোগানটির মহিমাও সম্পূর্ণ মুছে যায়নি তখনও। এমন একটি মুহূর্ত থেকে ইন্দিরার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের যাত্রা দৃঢ়তর ও বেগবান হতে পারত। অথচ, পরের কয়েক বছরে ভারত হাঁটল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। বিভিন্ন রাজ্যে কংগ্রেস সরকারের দুর্নীতি প্রকট হতে আরম্ভ করল— তার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ প্রকটতর হল। গুজরাতে কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী চিমনভাই পটেলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় জনতার ঢল নামল। বিহারেও সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হল প্রবল বিক্ষোভ। রেলকর্মীদের ধর্মঘটে স্তব্ধ হয়ে গেল ভারতের জীবনরেখা। ক্ষমতার শীর্ষে দেখা গেল আর এক অ-পূর্ব দুর্নীতি— কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভারতে ছোট গাড়ি তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেলেন প্রধানমন্ত্রীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী। এবং, যাবতীয় প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছাপিয়ে বারে বারেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল মানুষের আর্থিক দুরবস্থার কথা।
গণতান্ত্রিক সাফল্যের শীর্ষ থেকে কী ভাবে স্বৈরাচারের অতলে পৌঁছে যাওয়া যায়, প্রথম বার তা দেখল ভারত। বিভিন্ন প্রশ্নে মানুষের ক্ষোভ যত স্পষ্ট হল, গণতন্ত্রের পথ থেকে তত বেশি বিচ্যুত হতে লাগলেন ইন্দিরা গান্ধী। জরুরি অবস্থা ঘোষণা তার তুঙ্গমুহূর্ত, কিন্তু সেখানে পৌঁছতে ইন্দিরাকে পেরোতে হয়েছিল পর পর অনেকগুলি ধাপ। ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’ তৈরি যেমন। দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের বিচারপতিরা যেন রাজনৈতিক ও আদর্শগত ভাবে সরকারের সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রাখেন, তা নিশ্চিত করার এই ভয়ঙ্কর প্রকল্প সম্বন্ধে আইনজ্ঞ এ জি নুরানি বলেছিলেন, গণতন্ত্রের পক্ষে এই প্রচেষ্টা কতখানি মারাত্মক, তা এখনই কেউ বুঝছেন না। অন্য দিকে, কংগ্রেসের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের আর অস্তিত্ব ছিল না— ইন্দিরা ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয়, এবং সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মতো কতিপয় ধামাধরা নেতা, কংগ্রেসের যাবতীয় সিদ্ধান্তের অধিকারী ছিলেন। শাসক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের অভাব ঘটলে, দু’এক জন ব্যক্তি অমিত শক্তিধর হয়ে উঠলে দেশের উপরে তার কী প্রভাব পড়তে পারে, ১৯৭৫ তার প্রথম উদাহরণ।
আজকের শাসক দল বিজেপি জরুরি অবস্থা জারির অর্ধশতককে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছে— কিন্তু এই ঘটনা থেকে যে শিক্ষাগুলি গ্রহণ করা প্রয়োজন ছিল, তার কোনওটাই করছে কি? গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলিকে পৃথক এবং স্বাধীন থাকতে দেওয়ার গুরুত্ব বিজেপি বোঝে কি? জরুরি অবস্থার সময় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় যে হস্তক্ষেপ হয়েছিল— এবং, কুলদীপ নায়ারের মতে, শুধু ঝুঁকতে বলাতেই অধিকাংশ সাংবাদিক যখন হামাগুড়ি দিতে আরম্ভ করেছিলেন— আজকের ভারতে তার পুনরাবৃত্তি স্পষ্ট নয় কি? একটি-দু’টি ব্যতিক্রম ছাড়া জরুরি অবস্থায় সংখ্যালঘুদের উপরে আলাদা করে কোনও নিপীড়ন হয়নি। আজকের ভারত সম্বন্ধে সেটুকু বলারও অবকাশ নেই। জরুরি অবস্থা দেখিয়েছিল, গণতান্ত্রিক সাফল্য থেকে কত দ্রুত স্বৈরশাসনের অন্ধকারে পৌঁছে যাওয়া যায়। যাঁরা সমারোহ করে জরুরি অবস্থা জারির দিনটিকে সংবিধান দিবস হিসাবে পালন করছেন, তাঁরাও সেই অন্ধকারেরই পথিক হলে ক্ষুদ্র রাজনীতি ভিন্ন আর কিছু পড়ে থাকে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)