—প্রতীকী চিত্র।
এই বার আর পাঁচ নয়, সাত লক্ষ কোটি ডলার। অর্থ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ সাত ট্রিলিয়ন ডলার বা সাত লক্ষ কোটি ডলারে পৌঁছে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণেও স্বভাবতই এই ‘তথ্য’টি উল্লেখ করলেন। এই হিসাবটি পৃথিবীর মতোই— তাতে বারো আনা জল। ২০২৩ সালে ভারতের জিডিপি ছিল ৩.৭ লক্ষ কোটি ডলারের কাছাকাছি। সাত বছরে সাত ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছতে গেলে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ৯.৫ শতাংশের বেশি হওয়া প্রয়োজন। কোন জাদুবলে তা অর্জন করা যাবে, অর্থমন্ত্রী বা তাঁর উপদেষ্টা সে কথা জানাননি। তাঁরা অর্থনীতিকে ভোটের প্রচারের অস্ত্র বানিয়েছেন, তার বেশি কিছু নয়। কিন্তু, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে, প্রদীপের দৈত্য এসে সত্যিই ২০৩০ সালে ভারতের জিডিপি-কে সাত ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেল, তাতেই বা কী? জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বছরে এক শতাংশ ধরলে সাত বছর পরে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৩ সালের ২৬০০ ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৪৬০০ ডলারের সামান্য বেশি। তাতেও ভারত নিম্নমধ্য আয়ের দেশই থাকবে। অন্যান্য কিছু দেশের সঙ্গে তুলনা করলে ছবিটি স্পষ্ট হবে। যে দু’টি দেশকে টপকে ভারত বিশ্বের ‘তৃতীয় বৃহত্তম’ অর্থব্যবস্থা হবে বলে প্রধানমন্ত্রী আত্মগর্বে ডগমগ, ২০২৩ সালে সেই জার্মানি ও জাপানের মাথাপিছু জিডিপি ছিল যথাক্রমে ৫২,৮০০ ও ৩৩,৯৫০ ডলার। অর্থাৎ, ২০৩০ সালে যে আয়ে পৌঁছতে ভারতকে প্রদীপের দৈত্যের কাঁধে চড়তে হবে, সেই মাথাপিছু আয় আজকের জার্মানির মাথাপিছু আয়ের বারো ভাগের এক ভাগ নয়। ভারতের ব্রিকস জোটসঙ্গী ব্রাজ়িলের ২০২৩ সালে মাথাপিছু জিডিপি ১০,৪১২ ডলার; চিনের ৫৪৫১ ডলার। বছরে ৯.৫ শতাংশের ম্যাজিক বৃদ্ধি অর্জন করতে পারলেও ২০৩০ সালে ভারত মাথাপিছু জিডিপি-র হিসাবে সেখানে দাঁড়াবে, আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন।
এই নিম্নমধ্য আয়ের চক্র ছেড়ে বেরোনোর পথ কী, সে বিষয়ে সম্প্রতি কলকাতায় দু’টি পৃথক সভায় ভারতের দুই প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা রঘুরাম রাজন ও কৌশিক বসু কার্যত এক কথা বললেন। দু’জনেরই মত, ভারতকে যদি উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে উঠতে হয়, তার একটিই পথ— শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের খাতে উন্নতির জন্য সর্বশক্তিতে ঝাঁপানো। ভারতকে বুঝতে হবে যে, তার জোর কোথায়। গোটা দুনিয়ায় যে কৃত্রিম মেধানির্ভর চতুর্থ শিল্পবিপ্লব চলছে, তার পুরোভাগে রয়েছেন বেশ কিছু ভারতীয়, কিন্তু ব্যবসায়িক উদ্যোগের নিরিখে এই ক্ষেত্রটিতে বড় মাপের ভারতীয় সংস্থা নেই বললেই চলে। তার বড় কারণ, রাষ্ট্রীয় স্তরে ভারত চেষ্টা করছে উৎপাদন-শিল্পে শক্তি অর্জন করার, মেক ইন ইন্ডিয়া ইত্যাদি যার প্রমাণ। দুই অর্থশাস্ত্রীই স্মরণ করিয়ে দিলেন, উৎপাদনের জাহাজ বহু পূর্বেই সাগরে ভেসে গিয়েছে, ভারতের আর তাতে চড়ার উপায় নেই। যে-হেতু এ দেশে মজুরির হার এখনও অনেক দেশের তুলনায় কম, তাই সেই সস্তা শ্রমের ভরসায় বড় জোর উৎপাদনের জোগানশৃঙ্খলের সর্বনিম্ন স্তরে নিজের জায়গা করে নিতে পারে ভারত— কিন্তু, উন্নত অর্থব্যবস্থা হয়ে ওঠার খোয়াব অধরাই থাকবে। বরং, জোর দেওয়া প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃত্রিম মেধানির্ভর আধুনিক ক্ষেত্রগুলিতে। তাতে যেমন লগ্নি চাই, তেমনই শিক্ষাব্যবস্থাকেও হয়ে উঠতে হবে উদ্ভাবনী শক্তিতে বলীয়ান। এক দিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নতুন যুগের সৃষ্টিশীলতায় দীক্ষা নিতে হবে, ঠিক তেমনই একেবারে বনিয়াদি স্তর থেকে শিক্ষাকে বাঁধা গতের বাইরে এনে ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীন ভাবে ভাববার অবকাশ ও শিক্ষা দিতে হবে। সর্ব স্তরের শিক্ষাকেই রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা অতি প্রয়োজনীয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পুরোভাগে থাকার সুযোগ ভারতের সামনে এসেছে। তাকে কাজে লাগানোর ক্ষমতা দেশের নেতৃত্বের আছে কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy