সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সাফল্য বর্ণিত হল দুই বীরকন্যার মুখে— এই দৃশ্য ঐতিহাসিক হয়ে রইল। শত্রুপক্ষের আচরণের বিপ্রতীপে ভারতে নারীশক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুরুত্বকে অধিষ্ঠিত করল। কিন্তু একই সময়ে সমাজমাধ্যমে দেশের মনোজগতের যে ছবি বার বার চোখে পড়ল, তা মোটেই সুস্থ, স্বাভাবিক নয়। দৃষ্টান্ত: হিমাংশী নারওয়াল-ঘটনা। পহেলগাম-হামলার নিদারুণ অভিঘাতের প্রতীক রূপে আন্তর্জালে বহুচর্চিত এই সদ্যবিবাহিতার ছবি ছড়িয়ে প্রথমে অসীম বেদনাই ব্যক্ত করতে চেয়েছিলেন নেটনাগরিকরা। কিন্তু দু’সপ্তাহের মধ্যেই সেই সহানুভূতির জোয়ারের জায়গায় হঠাৎ ঘৃণার প্লাবন। অনলাইনে প্রবল কুৎসার মুখোমুখি তিনি। কারণ এই তরুণ গবেষিকা স্বামীর জন্মদিনে আয়োজিত এক রক্তদান শিবিরে শান্তির জন্য, কাশ্মীরি ও মুসলিমদের আক্রমণ না করার আবেদন করেছিলেন। হিমাংশী যত ক্ষণ ‘স্তব্ধবাক বিধবা’, বা স্বামীবিদায়ের সময় প্রবল আর্তকান্নায় ভেঙে পড়ছেন, তত ক্ষণ কোনও দ্বেষ নেই। কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি নিজের মতপ্রকাশ করে শান্তির ডাক দিলেন, তখনই তিনি আক্রমণের শিকার হয়ে উঠলেন। নারী তিনি, সুতরাং তাঁর অতীত নিয়ে কাটাছেঁড়া, চরিত্র ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলা চলল।
অল্পবয়সি মেয়েটির জীবনের কঠিনতম সময়ের বিচারে এ শুধু নিষ্ঠুরতাই নয়, গণহিংসাও। সমাজমাধ্যমকে যদি বিকল্প-পৃথিবী বা ছায়াবাস্তব রূপে দেখা যায়, তবে এই আক্রমণ একটি এলাকায় এক দল রাগী জনতা কর্তৃক এক জন নিরস্ত্রকে নিশানা করে পাথর ছোড়ার সঙ্গে তুলনীয়। পুরোটাই কিবোর্ড টিপে গড়ে তোলা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সত্যিই ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত হল একটি মানুষ। বার বার এমন ট্রোল বা সমবেত ঘৃণাবর্ষণের মুখে পড়ছেন মহিলারা। এ যেন প্রযুক্তির অস্ত্র হাতে প্রাগৈতিহাসিক নারীবিদ্বেষের আস্ফালন, খাপ পঞ্চায়েতের ডিজিটালাইজ়েশন। এবং সমাজমাধ্যমের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নিজেকে আড়ালে রাখার সুবিধা ও অ্যালগরিদম-এর অপপ্রয়োগ। বিতর্ক-বিবাদ পোস্ট-এর এনগেজমেন্ট বাড়ায়। কিছু ভুয়ো প্রোফাইল-এর সাহায্যে ছদ্ম-জনতা তৈরি করে মানুষকে ভুল বোঝানো যায়।
দেখা গিয়েছে, যাঁরা ট্রোল করেন তাঁরা সাধারণত শব্দের খোঁচায় ব্যক্তিগত আক্রমণ করেই মজা পান বেশি। এই বিকৃত প্রবণতা দমনে আইন থাকলেও প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনোভাবের দরুন অধিকাংশ ট্রোলই ছাড় পেয়ে যায়। ফলে এই অপরাধ-সংস্কৃতি এখন এক রকম সর্বজনগ্রাহ্যতা পেয়ে গিয়েছে। সমাজমাধ্যমে উপার্জনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আইনের এই ফাঁক দিয়েই ট্রোল থেকে রাজনৈতিক সুবিধার বন্দোবস্ত করছে আইটি সেলগুলি। নিজেদের মতাদর্শকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত করে বিরোধী স্বরকে কোণঠাসা করে দেয় তাদের ছদ্ম-সিপাইরা, যাদের চালনা করে কোনও রাঘববোয়াল। ট্রোল-বাহিনী নামিয়ে বিরোধী স্বর দমনের, নারী ও সংখ্যালঘুর অধিকার ও গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার এই খেলা চলছে পৃথিবী জুড়েই। ব্যাধি থেকে মুক্তির পথ প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা ও যথাযথ আইন। তবে, সমাজমাধ্যমের সত্য-মিথ্যা বিচার, বোধবুদ্ধি রক্ষার দায় নিতে হবে নাগরিকদেরও। নইলে এই সংবেদনশীল সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, অনলাইন সন্ত্রাসে ঘৃণার বিষ-বিস্ফোরণে জাতীয় সংহতির বিপদ আরও বাড়বে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)