Advertisement
১৮ মে ২০২৪
Movies and Society

মায়া অন্তঃসলিলা

হামফ্রে বোগার্টের হলিউড-খ্যাত কাসাব্লাঙ্কা ছবি নিয়ে ইটালীয় চিহ্ন-তাত্ত্বিক উমবের্তো একো লিখেছিলেন, সেই সিনেমাই ‘কাল্ট’ হয়ে যায়, যার সংলাপ মুখে মুখে ঘোরে বা মনে গেঁথে থাকে।

সোনার কেল্লা ছবির একটি দৃশ্য।

সোনার কেল্লা ছবির একটি দৃশ্য। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৪ ০৮:৪৮
Share: Save:

সময়ের সঙ্গে দৃষ্টি বদলে যায়। সিনেমা, সাহিত্য, ছবিকে আমরা আজ যে ভাবে দেখি, অর্ধশতাব্দী পরেও কি সে ভাবেই দেখব? না কি লুকিয়ে থাকবে অন্য কোনও সামাজিক অবলোকন? ৫০ বছর পর সম্প্রতি মহানগরের প্রেক্ষাগৃহে বড় পর্দায় সত্যজিৎ রায়ের সোনার কেল্লা ছবির বিশেষ প্রদর্শন নাগরিক বাঙালিকে এই সব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। এই ছবির জনপ্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন নেই। কিন্তু জনপ্রিয়তা আর ধ্রুপদীয়ানার মধ্যে একটা বড় পরিসর আছে, বাঙালি সেই পরিসর সহজেই মুছে দিতে পারে, এ-হেন আত্মতৃপ্তির উদ্গার তুলেও লাভ নেই। ঘরে বাইরে ছবি তৈরির সময় সলমন রুশদি স্বয়ং সত্যজিতের সাক্ষাৎকার নিতে এসে বলেছিলেন, সোনার কেল্লা তাঁর অন্যতম প্রিয় ছবি। সত্যজিৎ অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘বলেন কী! ছবিটা নিয়ে লোকে কথাবার্তা বিশেষ বলে না।’ তাঁর জন্মদিনের পূর্বলগ্নে, মে দিবসে এই ছবির বড় পর্দায় তুমুল করতালিধন্য হয়ে ফিরে আসায় তাই সত্যজিৎ-প্রতিভার পাশাপাশি আছে বাঙালির বদলে যাওয়া দৃষ্টিকোণ। ১৯৭৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল। সে বছরেই মুক্তি পেয়েছে মৃণাল সেনের কোরাস, তরুণ মজুমদারের ঠগিনীফুলেশ্বরী। উত্তমকুমার অভিনীত তিনটি ছবি: যদুবংশ, বিকেলে ভোরের ফুল ও শক্তি সামন্তের পরিচালনায় অমানুষ। টালিগঞ্জের ফিল্মি কেল্লা তখন নিজের জোরেই দর্শকধন্য হত। ৫০ বছর পর আজ মনে হয়, রুশদিকে বলা সত্যজিতের ওই উক্তি স্রেফ আলোচনাহীনতার আক্ষেপ নয়, তাঁর কর্মক্ষেত্র টালিগঞ্জের আত্মশক্তির পরোক্ষ স্বীকৃতি।

এই চালচিত্রে সোনার কেল্লা-র বিশেষ ভূমিকা কোথায়? উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল শারদীয় দেশ পত্রিকায়, ১৯৭১ সালে, ছবি তৈরি হয় তিন বছর পরে। হামফ্রে বোগার্টের হলিউড-খ্যাত কাসাব্লাঙ্কা ছবি নিয়ে ইটালীয় চিহ্ন-তাত্ত্বিক উমবের্তো একো লিখেছিলেন, সেই সিনেমাই ‘কাল্ট’ হয়ে যায়, যার সংলাপ মুখে মুখে ঘোরে বা মনে গেঁথে থাকে। জটায়ু এ ছবির নায়ক নন ঠিকই, কিন্তু আজও প্রথম আবির্ভাবে তাঁর ‘তং মত করো’ বা শেষে কুকরি নিতে ছুটে এসে ‘এটা আমার’— বাঙালি ভুলতে পারে না। কিংবা হাওড়া স্টেশনে অ্যাডভেঞ্চার শুরুর সুরেলা মূর্ছনা? গত কয়েক দশকে বারংবার বিভিন্ন ফেলুদা ছবিতে বাজতে বাজতে সেও তো আজ প্রায় অনন্য— শুনলেই বোঝা যায় কোন বাঙালির সুর। এখানেই ‘কাল্ট’, এখানেই ‘ক্যারিশমা’। কিন্তু, ফেলুদা-ভক্ত এবং জটায়ু-রসিকরা অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না যে, এটুকুই সব নয়। গোয়েন্দা কাহিনির পরতে পরতে নিহিত আছে গভীর অথচ সহজ, সকৌতুক কিন্তু সস্নেহ সমাজ-দর্শন। মুকুলের বাবা কলেজ স্ট্রিটের বইবিক্রেতা, গোয়েন্দা ফি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তবু ফেলুদা তোপসেকে নিয়ে রওনা হয়— অচেনা ছয় বছরের বাচ্চার পিছনে দাগি অপরাধীরা, ফলে তারও দায়িত্ব আছে বইকি। মুকুলের ইংরেজি-দুর্বল বাবার হয়ে টেলিগ্রাম পাঠান দোকানের নিয়মিত ক্রেতা, সিটি কলেজের এক অধ্যাপক। গাড়িচালক সিংজির ট্যাক্সির টায়ার রাস্তায় ফুটিফাটা, তবু টায়ার সারিয়ে তিনি আপন আগ্রহে সোনার কেল্লা-য় পৌঁছে যান, কোনও স্বার্থ ছাড়াই। বিভিন্ন স্তরের চেনা, অচেনা মানুষের প্রতি মানুষের এই সহমর্মিতা থেকেই কি সোনার কেল্লার পরের ছবিটাই জনঅরণ্য? এ-ছবির আগের বছরেই তৈরি হয়েছিল মনুষ্যসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের অশনি সঙ্কেত!

ইতিহাস বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে দু’টি ছবি তৈরি হয়। সত্যজিতের সোনার কেল্লা এবং ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। রাজনীতি? বটেই তো! কিন্তু অন্য রাজনীতি। পরের পঞ্চাশ বছরে শব্দটার খোলনলচে বদলে গেল। আর এখন— দূরদর্শন এবং অন্যত্র বারংবার দেখানো হয় সোনার কেল্লা। কোথায় গেল দেবী? কিংবা অরণ্যের দিনরাত্রি-তে হতদরিদ্র চৌকিদারের ঘরের সামনে শর্মিলা ঠাকুরের আর্তি: ‘এত অসুখ, জানতেন?’ মায় দূরদর্শনও আজ দেখায় না তাদেরই জন্য তৈরি সদ্‌গতি। মানবিকতাবোধের রাজনীতিতে দীপ্ত সত্যজিৎ আজ শাসকের কাছে অস্বস্তিকর, হয়তো বা বিপজ্জনক। বরং তাঁকে বারংবার দেখিয়ে দেখিয়ে কিশোর ছবির স্রষ্টা করে তোলাই নিরাপদ। এই বঙ্গেও তাঁর নামকরণ করা নন্দন আজ শুধুই মাল্টিপ্লেক্স। ছকবাঁধা কার্য-কারণবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না থাকলে কি অন্তিম পর্বে পৌঁছেও কুসংস্কারের রাজনীতি নিয়ে ছবি করা যায়? বড় পর্দা মনে করাল, অনুভূতিপ্রবণ এই মানবিক রাজনীতিকে বাদ দিয়ে দেখা যাবে না সোনার কেল্লা। তা হলে সেটি তাৎপর্যহীন ফিল্মি কেল্লা হয়েই থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Satyajit Ray Sonar Kella
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE