বিগতকাল: দেশবাসীর সামনে সামাজিক উন্নতির পথরেখা তুলে ধরছেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। পাঞ্চেত বাঁধ উদ্বোধন, ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৯
প্র ধানমন্ত্রী তখন অটলবিহারী বাজপেয়ী। সংসদে ওঁর ঘরে গিয়ে একদিন বললাম, আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগ দিয়েছি। চোখ পিটপিট, মুখে স্মিত হাসি। বললেন, ‘‘আনন্দবাজার? বহুত আচ্ছা। বাজার মে রহো অউর আনন্দিত রহো!’’
রসিক মানুষের সঙ্গে রসিকতা করার সুযোগ ছাড়িনি। বললাম, ‘‘আনন্দিত তো সব সময় থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু বাজারে থাকার মানে কী?’’ বাজপেয়ী বললেন, ‘‘হমারা ভারত এক বাজার হৈ। হিন্দু মুসলিম ইশাই। কত জাত, কত ভাষা। কত তরিতরকারি, কত রকমের খাবার। সব কিছুর মধ্যে থাক। সব কিছু উপভোগ কর।’’
বাজপেয়ী জওহরলাল নেহরু নন। আজ এত বছর পর মানুষটা বেঁচে আছেন কিন্তু কথা বলতে পারছেন না। কার্যত মানুষকে চিনতেই পারছেন না। ইতিহাসে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ধারাবাহিকতা রক্ষার দায়িত্বও থাকে ইতিহাসের। নেহরু থেকে বাজপেয়ী রাজনৈতিক পটভূমি বদলেছে অনেক। তবু এনডিএ-র বাধ্যবাধকতাই হোক, অথবা বাজপেয়ীর মানসিকতাই হোক, ভারতের রাজনৈতিক অভিমুখের এ ভাবে বাঁক পরিবর্তন হয়নি। সে দিনও নেহরুর ভারতের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ছিল বাজপেয়ীর ভারতে। বাজারে তখনও ছিল আমিষ নিরামিষ নানা খাবার। এ ভাবে সমস্ত কসাইখানা বন্ধের হুমকি দেয়নি তাঁর দলের সরকার। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, আজকের ‘সাইবার-হিন্দু’ প্রধানমন্ত্রীর ভারত যেন সরাসরি নেহরুর ভারতের সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছে।
নেহরু বলেছিলেন, ভারতের গণতন্ত্রের যাত্রা সবে শুরু। ভবিষ্যৎ রচনার গুরু দায়িত্ব আমাদের কাঁধে। আজ উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের পর মোদী বলছেন, ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে দেবেন এক আধুনিক ভারত। কিন্তু কেমন মোদীর সেই ভারত?
বিজেপি এখন বাজপেয়ীর বিজেপি থেকে মোদীর বিজেপি যুগে প্রবেশ করেছে। আডবাণী রামমন্দির আন্দোলনের মাধ্যমে বিজেপি-কে ২ থেকে ৮৫টি আসনের দলে পরিণত করেছিলেন। মোদী ও সঙ্ঘ পরিবারের মনে হয়েছে এনডিএ ক্ষমতায় না থাকার জন্য জোট ধর্মের বাধ্যবাধকতা আর বাজপেয়ীর ‘ভুল দলে ঠিক লোকের’ থাকার ভাবমূর্তির জন্য বিজেপি-র নিজস্ব ভোট কমেছে। অতএব মোদী ফিরেছেন কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদের পন্থায়। নেহরুবাদের জংশন থেকে ভারতকে মেন লাইন থেকে কর্ড লাইনে নিয়ে যেতে চাইছেন তিনি।
আসলে এও এক ইতিহাসের সমাপতন। উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে নেহরুকে বোঝার জন্য শ্রেষ্ঠ উপাদান হল মুখ্যমন্ত্রীদের লেখা তাঁর সমস্ত চিঠি। প্রধানমন্ত্রী নেহরু মুখ্যমন্ত্রীদের বলেছিলেন, ‘মুসলিম তোষণ কখনওই কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নয়। এটি অপপ্রচার। কিন্তু দেশভাগের পর দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান সমাজ যাতে কোনও আতঙ্ক নিয়ে এ দেশে বসবাস না করেন, সেটাও দেখা দরকার। বিশেষত আপনারা দেখছেন জিন্না নিজেই বলেছেন, সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা এখন সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ সে দেশে। এ অবস্থায় ভারতীয় মুসলমানরা যদি নিজেদের ধর্মকে রক্ষা করতে না পরে তবে বিপদ কিন্তু হবে ভারতের ভবিষ্যৎ রচনায়।’ নেহরু সরাসরি আরএসএসের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, জার্মানির নাৎসি কার্যকলাপ মধ্যবিত্ত অশিক্ষিত মানুষদের নাৎসি বাহিনীকে আকৃষ্ট করেছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশটাই বড় বিপদে পড়ল। মুসলিম-তোষণ নয়, কিন্তু নেহরু মুসলিম সত্তাকে হিন্দুআর্যসত্তায় মিশিয়ে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন।
মনে পড়ে, ১৯৮৮-৮৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে কালকা মেলে কলকাতা যাচ্ছিলাম বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে। ট্রেনে হিন্দু-মুসলমান বিষয়টি নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল সে দিন। বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ শব্দটির চেয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শব্দটিই আমার বেশি পছন্দ। তার কারণ হিন্দু জাতীয়তাবাদ বললে মানুষ আমাদের ভুল বোঝেন।’ এমন নয় যে বাজপেয়ী আরএসএস ছিলেন না। বাজপেয়ী ছাত্রজীবনে বামপন্থী ছিলেন কিন্তু পরে ১৯৩৯ সাল থেকে তিনি গ্বালিয়রে আরএসএস-এর শাখায় যেতেন। কিন্তু তিনি ট্রেনের নন-ভেজ থালি খেতে খেতে এও বলেছিলেন, ‘আমরা মুসলমানবিরোধী কেন হব? মুসলমানরা তার ধর্মীয় সত্তা বজায় রাখবে। নমাজ পড়বে। মসজিদে যাবে। মক্কা গিয়ে হজ করবে। আমরা শুধু চাই এ দেশের মুসলমান ভারতীয় হবে।’ অবশ্য বাজপেয়ী এ সব বললেও সঙ্ঘের ডিএনএ-তে সংখ্যালঘুবিদ্বেষ চির কালই ছিল। হিন্দুকুশ থেকে বঙ্গোপসাগর হিন্দুজাতি একত্ববাদী রাস্তায় প্রতিষ্ঠা করা। গোহত্যারোধ থেকে ভারতীয় মুসলিমের স্বকীয় সত্তাকে হিন্দু সত্তার মধ্যে বিলীন করার তত্ত্ব তো নতুন নয়।
কিন্তু নেহরুর ভারতের বদলে মোদীর আধুনিক ভারত কোনটি? ২০১৪ সালে ভোট প্রচারের সময় শুধু হিন্দুত্ব নয়, গোধরার স্মৃতিকে পিছনে ফেলে মোদী দেশের আর্থিক উন্নয়ন দুর্নীতিমুক্ত এক শক্তিশালী রাষ্ট্রগঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। উত্তরপ্রদেশে জয়লাভ এবং যোগীর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মনে হচ্ছে উন্নয়ন নয়, উগ্র হিন্দুত্ব সাবেকি সঙ্ঘ লাইনই মোদীর যাত্রাপথ।
আসলে ভৌগোলিক দিক থেকে একত্রিত ভূখণ্ড যখন রাজনৈতিক সচেতনতার মাধ্যমে সামাজিক রাষ্ট্র গঠন করে, তখনই এক রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠে। নেহরু নানা স্তরে খণ্ডবিখণ্ড এক সমাজের দায়িত্ব নিয়ে তাকে একত্রিত করেন। যেখানে তামিল ই ভি রামস্বামীর বিজাতীয়করণের মাধ্যমে অতীত আর্যাবর্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তামিল দ্রাবিড় সত্তা প্রতিষ্ঠার দাবি, আবার অম্বেডকরের মতো নাস্তিক-বৌদ্ধর দলিত সত্তার স্বাধিকারের দাবি, আছে শক্তিশালী কেন্দ্র গঠনের প্রচেষ্টা।
নেহরু জীবনীকার জেফ্রি টাইসন বলেছেন, নেহরু মানুষটা যদি অন্য রকমের হতেন তা হলে ভারতও অন্য রকম হয়ে যেত। মোদী মানুষটি নেহরু নন। বাজপেয়ী নন। এমনকী আডবাণীও নন। নেহরুকে এক বার প্রশ্ন করা হয় ভারতের প্রধান সমস্যা কী? তিনি বলেছিলেন, এ দেশে ৩৬ কোটি মানুষ। তাই সমস্যাও ৩৬ কোটি। প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব স্বকীয় সমস্যা আছে এ দেশে। মোদী এই ভিন্নতায় বিশ্বাস করেন না। তিনি এমন মেলাতে চান যেখানে বিবিধ সমস্যার তিনি নিজেই এক অখণ্ড সমাধান। সর্বরোগহরা বটিকা।
মোদীর ভারতে দারিদ্রমোচনের পপুলিজম যা-ই থাকুক, মোদীর ভারত প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধতার পথ। নেহরুর ভারত সে দিন হাঁটছিল প্রগতির পথে। আর আজ মোদীর ভারত হাঁটছে পিছনের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy