Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
এখন ইয়েচুরির মতো নেতাকে সংসদে খুব প্রয়োজন ছিল

সত্য, কী বিচিত্র দল এই সিপিএম!

জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করার বিরোধিতা, সেও এক ভুল। রাজ্যে সরকার গঠনে রাজি, অথচ কেন্দ্রে সরকারে যাব না, সংসদীয় ব্যবস্থায়, ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলব না’-র এ এক বকচ্ছপ রণকৌশল। এর পর পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদ। প্রতিবাদ ঠিক ছিল। কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহার!

কেন্দ্র-সর্বস্ব: আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বৈঠকে (বাঁ দিক থেকে) বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য; জুলাই ২০১৬

কেন্দ্র-সর্বস্ব: আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বৈঠকে (বাঁ দিক থেকে) বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরি, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য; জুলাই ২০১৬

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৭ ০৭:১০
Share: Save:

দে খা যাচ্ছে, ভারতীয় কমিউনিস্টরা এক দিক দিয়ে বেশ ঐতিহাসিক: ঐতিহাসিক ভুলের মিছিল তৈরি করার ক্ষেত্রে। ১৯৭৯ সালে মোরারজি সরকার তৈরি হয় জরুরি অবস্থার প্রতিবাদে। সিপিএম এক জুলাই মাসে মোরারজির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শুধু ভোটই দেয়নি, চরণ সিংহকে সমর্থনও করেছিল, যাঁর পিছনে ছিল ইন্দিরা গাঁধী ও কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থন। এই অবস্থান নিয়ে দলের মধ্যে তোলপাড় হয়। ১৯৮২ সালে বিজয়ওয়াড়ায় পার্টি কংগ্রেসে জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পশ্চিমবঙ্গকে জানিয়ে দেয়, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি অনুসারে জাতীয় বিষয়ে নেওয়া কেন্দ্রীয় লাইনকে চ্যালেঞ্জ করার অধিকার রাজ্যের নেই। এই ঘটনা দলের ‘জুলাই সংকট’ বলে পরিচিত। সে দিন ইন্দিরার সমর্থনে বিরোধী ঐক্য ভাঙ্গা ছিল সিপিএম-এর মহাভুল।

জ্যোতিবাবুকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করার বিরোধিতা, সেও এক ভুল। রাজ্যে সরকার গঠনে রাজি, অথচ কেন্দ্রে সরকারে যাব না, সংসদীয় ব্যবস্থায়, ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলব না’-র এ এক বকচ্ছপ রণকৌশল। এর পর পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদ। প্রতিবাদ ঠিক ছিল। কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহার!

মনমোহন সিংহ তখন প্রধানমন্ত্রী। আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁর বাসভবনে মুখোমুখি প্রকাশ কারাটের। পাশের সোফাতেই উপবিষ্ট সীতারাম ইয়েচুরি। সে দিন কারাট প্রণববাবুকে জানিয়ে দেন, ইউপিএ সরকার যদি পড়ে যায় তো যাক, কিন্তু পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করতেই হবে। এটি মতাদর্শের প্রশ্ন। প্রণববাবু সে দিন কারাটকে বলেন, ‘আপনি সমর্থন প্রত্যাহার করে দিল্লিতে সরকার ফেলে দিতে পারেন। কিন্তু এর ফলে বিধানসভা ভোটে রাজ্যের মানুষ আপনাদের সরকারকে ফেলে দিতে পারে। সেটার জন্যও প্রস্তুত থাকবেন।’ কট্টরবাদী কারাট বলেছিলেন, ‘ভোটের হারজিত বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু মতাদর্শগত প্রশ্নে আপস করা যাবে না।’ এর পরের ইতিহাস তো জানা। এ রাজ্যে সিপিএম এমন ভাবে পরাস্ত হল যে, সেই সংকট থেকে আজও তারা বেরোতে পারেনি।

জুলাই মাসটা ভারতীয় কমিউনিস্টদের সংকটের মাস। পরমাণু চুক্তির প্রতিবাদে সমর্থন প্রত্যাহার হয় ৮ জুলাই। এ বারও সেই জুলাই মাসে সীতারাম ইয়েচুরিকে নিয়ে মহাভুল। দলের সাধারণ সম্পাদকের ক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে দু’বারের পর তৃতীয় বারের জন্য রাজ্যসভার প্রার্থী করা যাবে না। কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে সীতারামের রাজ্যসভার প্রার্থী হওয়ার যুক্তির বিরুদ্ধে ছিল পলিটব্যুরোর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য। কেরল ও ত্রিপুরার নেতারা রাজ্যস্তরে কংগ্রেস-বিরোধিতায় অটল আর পশ্চিমবঙ্গের নেতারা মমতা-বিরোধিতায় কংগ্রেস-সিপিএম জোট রাখার পক্ষে। তবে শুধু রাজ্য স্তরে নয়, জাতীয় স্তরে ২০১৯ সালের আগে দুর্বল বামশক্তির থাকা উচিত ছিল কংগ্রেসের সঙ্গেই, এই অভিমত সীতারাম ও পশ্চিমবঙ্গের বহু নেতারই। সীতারামকে প্রার্থী না হতে দিয়ে কারাট ও কেরল লবি আবার একটা ঐতিহাসিক ভুল করলেন।

সীতারাম ইয়েচুরি রাজ্যসভায় থাকতে না পারার বিষয়টি নিছক ব্যক্তিগত বিষয় নয়। দলের নাক কেটে সীতারামের যাত্রাভঙ্গে যাদের লাভ হল তাদের নিয়ে আলোচনা অর্থহীন। কিন্তু বিজেপির মোকাবিলায় রাজ্যসভায় বিরোধী রাজনীতিকে দুর্বল করা কোনও উত্তম রণকৌশল হতে পারে না।

ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অবক্ষয়ের নানা কারণ। একটি কারণ হল কমিউনিস্ট পার্টি তাদের দলকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে অবজ্ঞা করে এসেছে। নাগরিক সমাজের গুরুত্ব বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। প্রসঙ্গত, মনে করা যেতে পারে আন্তোনিও গ্রামশির কথা। মুসোলিনির কারাগারে বন্দি থাকার সময় তিনি একটি মৌলিক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সচেষ্ট হন। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব থাকা সত্ত্বেও বামপন্থীরা, বিশেষত কমিউনিস্টরা, ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে ঠেকাতে ব্যর্থ হল কেন? ‘হেজেমনি’ কিংবা সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার এবং সরাসরি দমনের পার্থক্য নির্দেশ করেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, শ্রমজীবী মানুষের পার্টিকে শিখতে হবে হেজেমনি নিয়ন্ত্রণের কাজটা। একমাত্র তা হলেই সব রকম বঞ্চিত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার হদিশ তারা পাবে। ডমিনেশন বা জোর খাটিয়ে কাজ হবে না। ইতালিতে বামপন্থীরা ‘হেজেমনিক’ হয়ে উঠতে পারেনি, তাই মুসোলিনির ক্ষমতায় আসার পথ সুগম হয়। এ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে ডমিনেশন-কেন্দ্রিক সমাজতন্ত্র গড়ে ওঠে। এ দেশেও একই সমস্যা। তত্ত্বগত ভাবে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিবিড়, কিন্তু বাস্তবে গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে এক পরাক্রমশালী পার্টিতন্ত্র পশ্চিমবঙ্গে গড়ে উঠেছে। মানুষের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে পার্টি।

আজ যখন গোটা দেশে কমিউনিস্ট প্রভাব কমছে, ভোটের ফলাফলেও সাফল্য অদৃশ্য বহু দিন, তখন সীতারামের মতো এক ব্যক্তিত্বকে সংসদে ব্যবহার করাটা ২০১৯-এর আগে অনেক বেশি জরুরি ছিল। এই সহজ সত্যটি সাধারণ মানুষ বুঝলেও পার্টি বুঝতে পারল না কেন? পার্টি ও গণতন্ত্র কি তবে পরস্পরবিরোধী ধারণায় পরিণত হয়েছে? সংসদীয় দলগুলির মধ্যে সমন্বয়, বিরোধী জোট গঠন, এ সব সংসদের বাইরে বিপ্লবী গণপার্টির কাজ নয়। তাই সংসদকে শুয়োরের খোঁয়াড় মনে করার থেকেও বেরোনোর সময় এসেছে।

পুচলাপল্লি সুন্দরাইয়া যিনি কমরেড পি এস বলেই বেশি পরিচিত ছিলেন, তিনি সিপিএম দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ১৯৬৪ সাল থেকে ’৭৮ সাল পর্যন্ত। ’৫২ সালে তিনি রাজ্যসভায় মনোনীত হন। তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর প্রথম সংসদীয় নেতা। সেই সময় থেকেই সিপিএম সংসদীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ বৈপ্লবিক রাস্তা পরিত্যাগ করে। এই ব্যবস্থার মধ্যে থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে তা বদলের রণকৌশল গ্রহণ করে। এই মতাদর্শ থেকেই সিপিএম নকশাল রাজনীতির বিরোধিতা করে। পশ্চিমবঙ্গ কেরল ত্রিপুরায় সরকার গঠনে উদ্যোগী হয়। ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট নেতারা বুঝতে পারলেন, গোটা দুনিয়া জুড়েই বৈপ্লবিক পরিবর্তনের রাস্তার বদলে সংসদীয় রাস্তাই গৃহীত হচ্ছে। পারি কমিউনের ব্যর্থতার পরও মার্ক্স বলেছিলেন, সাংগঠনিক ব্যর্থতা আসে যদি আন্দোলন মানুষের সঙ্গে যুক্ত না হয়। তাই জনগণ বিচ্ছিন্ন দলতন্ত্র নয়, চাই মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে গণতন্ত্রের রাস্তায় হাঁটা। জলের মধ্যে মাছের বসবাস গণতন্ত্রের ব্যবস্থাতেই সত্য হয়ে উঠতে পারে।

১৯৫২ সালের নির্বাচনে গোটা দেশে ৪৯টি আসনে লড়ে ১৬টি আসন পেয়েছিল বামেরা। পশ্চিমবঙ্গে জিতেছিল ৫ জন। এমনকী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর দক্ষিণ পূর্ব কলকাতার আসনটিতে উপনির্বাচনে সাধন গুপ্ত জিতেছিলেন। তখন সংসদীয় ব্যবস্থায় কংগ্রেস বিরোধী জোট গঠনের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল সিপিএম।

আজ যখন গোটা দেশে কমিউনিস্টরা ভারতীয় মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, যখন ভাবার সময় এসেছে উনিশশো কুড়ির দশকের ভারতে আরএসএস ও কমিউনিস্ট পার্টি দুটি সংগঠনেরই জন্ম হওয়া সত্ত্বেও কেন আজ এক পক্ষ গোটা দেশ জুড়ে তার দাপট দেখাচ্ছে, আর অন্য পক্ষ কেন পিছিয়ে পড়ছে। ভাবার সময় এসেছে কমিনটার্নের শাখা হতে গিয়ে কমিউনিস্টরা কি ‘ভারতীয়’ কমিউনিস্ট হয়ে উঠতে পারেনি? বিজেপি যখন তাদের দলের সভাপতি অমিত শাহকে রাজ্যসভায় নিয়ে আসছেন, তখন সিপিএম তার দলের কান্ডারি সীতারাম ইয়েচুরিকে সংসদ ছাড়া করছে! সত্য, কী বিচিত্র এই দল!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE