Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

ছি! কী ঘেন্না, কী ঘেন্না!

পরিবেশ নিয়ে অনেক কথা, বিস্তর প্রকল্প। কিন্তু কন্ডোম এবং স্যানিটারি ন্যাপকিন, এই দুটি জিনিস ব্যবহারের পরে কোথায় কী ভাবে ফেলা উচিত, তা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা কারও নেই। অথচ বিপুল পরিমাণে এই বর্জ্যগুলি পরিবেশের বিরাট ক্ষতি করে চলেছে। ধরুন, ছুটিতে আয়েশ করে সমুদ্রতটে বেড়াতে গেছেন। জলের ভেতরে লুটোপুটি খাচ্ছেন মজায়। হঠাৎ দেখলেন, আপনার দিকে উঁচু হয়ে ধেয়ে আসছে কিছু। ঠাহর করে দেখলেন, ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন আর কন্ডোমের স্তূপ! ঠিক কেমন লাগবে আপনার?

সংহিতা সান্যাল
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

ধরুন, ছুটিতে আয়েশ করে সমুদ্রতটে বেড়াতে গেছেন। জলের ভেতরে লুটোপুটি খাচ্ছেন মজায়। হঠাৎ দেখলেন, আপনার দিকে উঁচু হয়ে ধেয়ে আসছে কিছু। ঠাহর করে দেখলেন, ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন আর কন্ডোমের স্তূপ! ঠিক কেমন লাগবে আপনার? কিংবা ধরুন, কোথাও একটা মাটি খুঁড়ে ফোনের লাইন বসানো হবে। কিছু দূর খুঁড়তেই শুধু স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্লাস্টিক। তারা মাটির স্তর আটকে রেখেছে। বৃষ্টির জল পর্যন্ত ঢুকছে না। টিউবওয়েলের পাইপ আটকাচ্ছে এই প্লাস্টিক, খেতের মাটিতে বোঝাই, আপনার বাড়িতে উঠোনে বাগানে সর্বত্র।

দুঃস্বপ্ন? গা ঘিনঘিনে একটা ব্যপার? দৈনন্দিন অভ্যাস আমাদের খুব শিগগিরই এ-রকম একটা পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কৃষ্ণনগরের কিছু স্কুলছাত্রীর করা একটা ছোট্ট সমীক্ষা এমনই ইঙ্গিত দিয়েছে।

স্যানিটারি ন্যাপকিনের ওপরটা তুলোর হলেও নীচের অংশটা আঠা লাগানো প্লাস্টিক। আর সেটা বায়োডিগ্রেডেবল নয়, সোজা বাংলায় পচে নষ্ট হয়ে যায় না। থেকে যায়। বছরের পর বছর, অবিকৃত অবস্থায়। এই শহরেই বহু মানুষ সেগুলোকে কমোডে ফ্লাশ করে দেন। এই ন্যাপকিনের দলা গিয়ে জমে সংলগ্ন পাইপে, তার পর মেশে নিকাশি প্রণালীতে। শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়ে জলে। সরকার প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণের জন্য এত কড়া কড়া পদক্ষেপ নিচ্ছেন, লোকে চাল ডাল কিনতে মুদির দোকানে প্যাকেট পায় না, অথচ আমরাই বেশ যত্ন নিয়ে প্রতি মাসে প্লাস্টিক দূষণ করে চলি!

শহরের তুলনায় আরও ভয়াবহ অবস্থা গ্রাম আর মফস্‌সলে। সেখানে মিউনিসিপ্যালিটির গাড়িও আসে না। যে সমবায় ভাগাড়ে আনাজের খোসা বা কাঁটা ফেলা যায়, সেখানে মেয়েদের এই ‘লজ্জাজনক’ জিনিস ফেললে ছিছিক্কার পড়ে যাবে না? যেখানে অন্তর্বাস মেলতে হয় শাড়ির নীচে, সেখানে স্যানিটারি ন্যাপকিন সূর্যের আলো দেখতে পাবে না এটাই তো স্বাভাবিক। অনেকেই ব্যবহৃত ন্যাপকিন বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে দেন। তাতে কী পরিমাণ বায়ুদূষণ হয় তা অনুমান করতে বিজ্ঞানী হতে হয় না। আর অন্যেরা? মাটি খুঁড়ে চাপা দিয়ে দেন! নদীতে ফেলে দেন! অন্যত্র ফেললে কুকুরে টেনে আনবে, সে আরও নোংরা ব্যাপার। দিনের পর দিন ধরে মাটির নীচে আর জলে জমে চলেছে এই ব্যবহৃত ন্যাপকিন।

আর জমছে কন্ডোম। ন্যাপকিন তাও মেয়েদের লজ্জার জিনিস, কন্ডোম তো পুরুষের বিজয়নিশান! ক’জন পুরুষ আছেন যাঁরা ব্যবহারের পর কন্ডোম ডাস্টবিনে ফেলেন? জানলার বাইরে, অন্ধকার রাস্তায়, সিগারেটের প্যাকেটে ভরে ড্রেনে, যেখানে ইচ্ছে ফেলে দেন। ওটা রাবারের তৈরি এবং একই ভাবে সঠিক ডিসপোজাল দাবি করে। ওর ওপর বৃষ্টির জল পড়ে, সেই জল আটকে যায়। ওর ওপর অন্যান্য আবর্জনা জমে এবং এক সময় মাটির নীচে চাপা পড়ে যায়। জেএনইউ-এর সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রসঙ্গে যাঁরা ছাত্রদের ব্যবহৃত কন্ডোম গুনতে গেছেন, তাঁদের আচরণ কুরঙ্গের বিষয় হলেও এটা সত্যি যে, কন্ডোম কোথায় ফেলা হল তা নিয়ে কেউ বিশেষ ভাবে না! বীর্য বা ঋতুরক্ত যতই ‘এ ম্যা গো’ বলার জিনিস হোক, তা ভাঙতে ভাঙতে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। মেশে না প্লাস্টিক এবং রাবার। একটি মেয়ের পিরিয়ড শুরু হয় মোটামুটি বারো বছর বয়সে, চলে গড়পড়তা পঁয়তাল্লিশ পর্যন্ত। এই তেত্রিশ বছর, প্রতিমাসে পাঁচ দিনে পনেরো থেকে কুড়িটা ন্যাপকিন ব্যবহার হয়। এ বার একটি মেয়ে সারাজীবনে প্রতি বার যদি ন্যাপকিন মাটিতে পোঁতে, পুড়িয়ে দেয়, কমোডে ফ্লাশ করে বা জলে ফেলে দেয়… মোট সংখ্যাটা কত হল, হিসেব করে নেওয়া সহজ। এ বার ভাবুন, দেশের মফস্‌সলে আর গ্রামে ঋতুমতী কত মেয়ে থাকেন। আবার, অনুরূপ হিসেবে, কত জন সমর্থ পুরুষ সারাজীবনে কতগুলো কন্ডোম যত্রতত্র ফেলে দেন, সেই হিসেবটাও মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। জলে আর্সেনিক আমরা মেশাই না। সকলের ঘরেই এখন ফিল্টার আছে। মাটি দূষণ বা বায়ু দূষণ নিয়ে কম বেশি ধারণা সবার আছে। কিন্তু এই সমস্যার কোনও প্রতিকার নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।

নেই, তার কারণ একটাই। যৌনতা নিয়ে আমাদের দ্বিচারিতা। যৌনতা খুব জরুরি জিনিস সক্কলে জানি, কিন্তু তার ছোঁয়াচ লাগা যে কোনও জিনিস বাজে। সে জিনিস যে ভাবে হোক তাড়াতাড়ি চোখের আড়াল করতে পারলে বাঁচা যায়। সে জন্যেই স্কুল কলেজে যাঁরা বাথরুম পরিষ্কার করেন, তাঁরা নোংরা টয়লেট পরিষ্কার করার চেয়েও বেশি ঘেন্না পান ন্যাপকিনের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে গিয়ে। আসলে সে জন্যেই যাদবপুরে ন্যাপকিনের ওপর স্লোগান লেখা হলে আমাদের আপত্তি। সেই জন্যেই অসাবধানে কারও শাড়িতে জামায় দাগ লেগে গেলে সে বেচারিকে মরমে মরে যেতে হয়। বাচ্চা মেয়ে যদি পেটখারাপ চাপতে না পেরে পটি করে ফেলে, খানিক সহানুভূতি পাবে। কিন্তু দাগ লাগলেই সর্বনাশ! তোমার যোনির থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত মানেই ঘেন্নার জিনিস। ঋতুরক্ত অশুদ্ধ, তাতে একটা ডিম্বাণু আর কিছু টিস্যু থাকে। আপনার হাত থেঁতলে গেলে তাতেও টিস্যু থাকে। আর ডিম্বাণু তো চোখে দেখাও যায় না! কিন্তু ওই রাস্তাটা খারাপ, ওই জরায়ু থেকে যোনি পর্যন্ত। বীর্যও খুব খারাপ, নোংরা জিনিস। ওই দুটো জিনিস যে ভাবে পারো দূর হটাও। তাতে হোক দূষণ, হোক ক্ষতি, আমি তো আর মরছি না! পরে পৃথিবীর যা হওয়ার হবে।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলেছিলেন না, ‘পশ্চাতে রেখেছ জারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’! আপনারই ফেলে দেওয়া জিনিস, দূর করে দেওয়া জিনিস একদিন ঘুরেফিরে আপনার কাছেই ফেরত আসবে। আপনারই নতুন তৈরি বাড়ির ভিতের নীচে, আপনারই ব্যবহারযোগ্য জলের কিনারায় কিনারায়। সে দিন এড়াবেন কী করে? পালাবেন কোথায়? কী ভাবে নিশ্বাস নেবেন, আপনার যেমন তেমন করে পুড়িয়ে দেওয়া প্যাডের বিষবাষ্পে? দেশে সমস্যার অন্ত নেই। অর্থনীতির ধস, শিশুমৃত্যু, একের পর এক স্ক্যাম। কিন্তু তাই বলে এই সমস্যাকে তুচ্ছ করবেন না, এ অত্যন্ত গোপনে আপনারই অন্দরমহল থেকে বেড়ে চলেছে। ছড়িয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে, কিন্তু নিরন্তর।

প্রতিটি গ্রামে যদি একটা করে আবর্জনা নষ্ট করার প্ল্যান্ট থাকে, আর থাকে বাড়ির মহিলা ও পুরুষদের সচেতন করার প্রয়াস, তা হলেই এ সমস্যার একটা সুষ্ঠু সমাধান হয়। পাকা বাথরুম বানানো, পোলিয়ো বা এডস নিরাময়, পরিষ্কার জল ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে এত খরচ করে প্রচার হয়। কন্ডোম ব্যবহার নিয়ে প্রচার হয়। মেয়েদের স্কুলে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়া হয়। কিন্তু এক বারও কোথাও বলা হয় না যে সেগুলোকে ঠিক জায়গায় ফেলা প্রয়োজন। আমরা স্বচ্ছ ভারত গড়ছি, যৌনতা সংক্রান্ত এত জরুরি দুটো অনুষঙ্গ বাদ রেখে।

একটা পরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত করতে গেলে কিছু বাদ দিয়ে যাওয়া যায় না। আমাদের বহুকালীন সংস্কারবশে আমরা এগুলো নিয়ে ভাবি না। কিন্তু শুধু এই কারণে দূষণ আটকানোর প্রত্যেকটা চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। শুধু এই কারণে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বাড়তে পারে বহুগুণ। বৃষ্টির জলের ভৌম জলস্তরে পৌঁছনো পিছিয়ে যেতে পারে বহু বছর। মাটির দৃঢ়তা কমে গিয়ে পাড় ভাঙা, ধস নামা বাড়তে পারে। গাড়ির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করে বা প্লাস্টিক ব্যান করে যেটুকু এগোনোর স্বপ্ন দেখা গেছে, সবটাই অলীক প্রমাণিত হতে পারে। সুতরাং, অন্য ভাবে ভাবার সময় এসেছে। কবে কী হবে তার ভরসায় বসে না থেকে নিজেরাই যদি একটু সচেতন হই, ওই জিনিসগুলোকে নেহাত ঘেন্নার না ভেবে ক্ষতিকর বর্জ্য হিসেবে দেখি, তা হলেই সমস্যা অনেকটা কমবে। আমাদের জল মাটি হাওয়া আমরাই বাঁচাতে পারব।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy