Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

খেলাটা নতুন, ভারতকেও তা শিখতে হবে

ব্রেক্সিটের ফলে বিশ্ববাজারে একটা সাময়িক ধাক্কা আসবেই। তবে এটাও ঠিক যে এই সুযোগে ভারতের সঙ্গে বিলেতের সম্পর্ক হয়তো আরও গাঢ় হবে, অনেক বেশি চুক্তি ও লেনদেন হবে।অদূর ও সুদূর ভবিষ্যতের ব্রিটেনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বেই। কিন্তু ঠিক কী কী ভাবে অর্থনীতির ক্ষতি (অথবা লাভ) হতে পারে? দেশের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদদের প্রায় সকলের অভিমত ছিল, ব্রিটেনের পক্ষে ব্রেক্সিট মোটেই সুখকর হবে না।

কী জানি। শেয়ার বাজারের কারবারি। লন্ডন, ২৭ জুন। এএফপি

কী জানি। শেয়ার বাজারের কারবারি। লন্ডন, ২৭ জুন। এএফপি

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

অদূর ও সুদূর ভবিষ্যতের ব্রিটেনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বেই। কিন্তু ঠিক কী কী ভাবে অর্থনীতির ক্ষতি (অথবা লাভ) হতে পারে? দেশের তাবড় তাবড় অর্থনীতিবিদদের প্রায় সকলের অভিমত ছিল, ব্রিটেনের পক্ষে ব্রেক্সিট মোটেই সুখকর হবে না। রয়াল ইকনমিক সোসাইটির আশি শতাংশ সদস্য গণভোটের আগে এক সমীক্ষায় বলেছিলেন, যদি ব্রেক্সিট হয়, তা হলে অর্থনীতিতে একটা ধাক্কা লাগবেই, পরিভাষায় যাকে বলে ‘ইকনমিক শক’। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন সহ ব্রেক্সিটের বিপক্ষে যাঁরা ছিলেন, সে কথাটাই জনগণকে বারংবার মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা জেনেও ৫২ শতাংশ ভোটদাতা ব্রেক্সিটের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন।

বিলেতে অর্থনৈতিক পতন কি তা হলে এ বার শুরু হবে? পক্ষে-বিপক্ষে সকলেই এটা মেনে নিচ্ছেন যে ব্রেক্সিটের ফলে বিশ্ববাজারে একটা সাময়িক ধাক্কা আসবেই। গণভোটের পরের দিন শুক্রবার সকালেই ব্রিটেনের শেয়ার বাজারে ধস দেখা গেছে, ডলার ও ইউরোর সাপেক্ষে পাউন্ডের দামও কমে গেছে। হয়তো বা কয়েক সপ্তাহ ধরেই বিলেত এবং সারা পৃথিবী জুড়েই শেয়ার বাজার প্রভাবিত হবে। কিন্তু এটা কতটা সুদূরপ্রসারী হবে, সেটাই সকলের চিন্তা। আগামী দিনে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি কতটা হবে? কী ভাবে হবে? গোটা পৃথিবীতেই বা কী প্রতিক্রিয়া হবে?

ব্রিটেনের অধিকাংশ অর্থনীতিবিদের মত ছিল, ইউরোপের সঙ্গে না থাকলে ইউরোপের বাজার তো দেশের হাতছাড়া হবেই, বিশ্ব বাজারে লেনদেন, আমদানি-রফতানি সবই মার খাবে। এ দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ব্যতিক্রমী হলেন আমার বিভাগের অধ্যাপক প্যাট্রিক মিনফোর্ড। তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষে। আমার সহকর্মী প্যাট্রিক এই বিষয় নিয়ে বইও লিখেছেন ব্রেক্সিটের অনেক দিন আগেই। শিরোনাম: শ্যুড ব্রিটেন লিভ দ্য ই ইউ। বয়সে অনেক বড় হলেও প্যাট্রিক বন্ধুপ্রতিম। তাঁর সঙ্গে প্রাণ খুলে গল্প করার সুযোগ পেয়েছি বহু বার। তাঁর মূল বক্তব্য হল, ইউরোপে থেকে বিলেতের এখন মোটেই কোনও লাভ হচ্ছে না, বরং ক্ষতিই বেশি হয়েছে। ইউরোপের নিজস্ব বাণিজ্য নীতি মেনে চলতে গিয়ে ব্রিটেনের হাত-পা বাঁধা, ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে বরং ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর সঙ্গে নিজেরা অনেক ভাল ভাবে ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারবে— মুক্ত বাজারে চাহিদা-জোগানের সমীকরণ মেনেই কেনাবেচা হবে। অতএব, ব্রেক্সিটের পরে ব্রিটিশ অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়তে পারে, এমন যে ভয়টা অন্য অর্থনীতিবিদরা এবং ক্যামেরন-সহ অন্য নেতারা দেখাচ্ছিলেন, সেটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

তর্কসাপেক্ষে যদি ধরেও নিই প্যাট্রিক ঠিকই বলেছেন যে, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ইইউ-কে বাদ দিয়ে ব্রিটেন নিজেরাই নানা দেশের সঙ্গে ভাল বাণিজ্য চুক্তি করতে পারবে, তবু নিশ্চিত কী হবে তা তো বলা মুশকিল। অন্যরা, মানে ইউরোপের বাইরের দেশগুলো কী করতে চাইবে, সেটাও তো ভাবতে হবে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কয়েক সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট ওবামা ক্যামেরনের পক্ষ নিয়ে বলেছিলেন, যদি বিলেত ইইউ থেকে বেরিয়ে যায়, তা হলে আমেরিকার সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে গেলে লাইনের পিছনে (ব্যাক অব দ্য কিউ) গিয়ে দাঁড়াতে হবে, দশ বছর সময় লাগবে। ব্রেক্সিটের পরের দিন কিন্তু ওবামা বললেন, ব্রিটেনের সঙ্গে আমেরিকার লেনদেন স্বাভাবিক ভাবেই বজায় থাকবে।

এ রকম উলটো সুরে গাইবার আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর মার্ক কার্নি নিজে ইইউ-তে থাকার পক্ষপাতী ছিলেন। ক্যামেরনের মতো তিনিও বলেছিলেন, ব্রেক্সিটের ফলে অর্থনীতি আগামী দশ বছর রিসেশন বা মন্দা-দশায় থাকবে। আর এখন? ব্রেক্সিটের সকালে তিনি নিজেই স্বীকার করলেন, ধস যাতে না নামে, তার জন্য সব ব্যবস্থা ব্যাংক আগেই করে রেখেছে, অতএব এ হেন পতন মোটেই হবে না।

আপাতদৃষ্টিতে ওবামা বা কার্নির কথা ও কাজ স্ববিরোধী মনে হতে পারে। তা কিন্তু নয়। এই আচরণের ব্যাখ্যা করা যায় আধুনিক অর্থনীতির এক তত্ত্ব দিয়েই। গেম থিয়োরি। এখানে গেমটা কী, সেটা আগে দেখা যাক। গেমটার দুটো ধাপ। প্রথমে ব্রিটেনের নাগরিকরা বাছবেন— ইউরোপে থাকব (রিমেন) না বেরোব (লিভ)। যদি ব্রিটেন না বেরোয়, কোনও কথা নেই। বেরোলে, গেমের দ্বিতীয় ধাপে আমেরিকা স্থির করবে যে তারা কী করবে— ব্রিটেনকে সত্যি লাইনের পিছনে ফেলে রাখবে, না কি সত্বর তাদের সঙ্গে নতুন বাণিজ্যের চুক্তি করে নেবে। খেলার আগে ওবামা ভয় দেখাতে পারেন বটে, কিন্তু ‘আজ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করো’ তা হলে উত্তর হবে: শুধু শুধু নিজের নাক কাটব কেন? ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য না হলে তো নিজের ক্ষতিই হবে; সুতরাং নিজের স্বার্থেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ব্রিটেনের পাশে থাকবে। গেম থিয়োরিতে এ হল ‘ইনক্রেডিবল থ্রেট’ বা অ-বিশ্বাসযোগ্য হুঁশিয়ারি-র তত্ত্ব। গণভোটের আগে আমেরিকা যে হুঁশিয়ারি ছিল, ব্রেক্সিট বস্তুত কার্যকর হলে সে-সব অমূলক হয়ে দাঁড়ায়।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নরের সেই একই ব্যাপার। ভোটের আগে মার্ক কার্নি যা বলেছিলেন, তা ছিল থ্রেট— ভোটের পরে নিজের কাজ অনুযায়ী তাঁকে মানতেই হল যে, ধস রুখে দেওয়া হবে। একই ভাবে যেমন, ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এলে ইউরোপের বাজার হারানোর যে ভয় ব্রিটেনের জনগণকে দেখানো হচ্ছিল, সেটাও মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ বাজার নিজের গতিতেই চলবে, ইউরোপের দেশগুলো নিজের স্বার্থেই ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য জারি রাখবে। হয়তো এই সুযোগে বিলেতের সঙ্গে ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর বাণিজ্য বাড়বে। চিন, ভারত, রাশিয়া সবাইকে এখন ব্রিটেনের বাজারে টেনে আনার চেষ্টা হবে। এই সুযোগে ভারতের সঙ্গে বিলেতের সম্পর্ক হয়তো আরও গাঢ় হবে, অনেক বেশি চুক্তি ও লেনদেন হবে। নিজের স্বার্থে ভারতের উচিত ব্রিটেনের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের অন্যদের সঙ্গেও নতুন করে যোগাযোগ সাধন করা।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE