Advertisement
E-Paper

জন্মই আমার আজন্ম পাপ

আমাদের নামটিই পরিচয়পত্রে, চাকরির ফর্মে, বাড়িভাড়ার চুক্তিতে, হাসপাতালের রিসেপশনে, বুকিং কাউন্টারে— সর্বত্র হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়।

রোহন ইসলাম

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ০৭:২৩
Share
Save

সব জীবন এক রকম হয় না। কিছু জীবন জন্ম থেকেই আলোয় ভিজে থাকে— নিরাপত্তার আলো, মুক্তির আলো, নিশ্চিত ভবিষ্যতের আলো। আর কিছু জীবন জন্ম থেকেই ছায়ার গর্ভে বেড়ে ওঠে— প্রশ্নের ছায়া, সন্দেহের ছায়া, আতঙ্কের ছায়া। আমরা, যারা আজকের ভারতে ‘মুসলমান’ পরিচয়ে বাঁচি, তাদের জীবন সেই ছায়ার ভিতরেই গড়ে ওঠে। আমাদের নামটিই পরিচয়পত্রে, চাকরির ফর্মে, বাড়িভাড়ার চুক্তিতে, হাসপাতালের রিসেপশনে, বুকিং কাউন্টারে— সর্বত্র হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়।

প্রতিটি জঙ্গি হামলার পরে, দাঙ্গার পরে আমরা, যারা জঙ্গিহানা কিংবা দাঙ্গায় মৃত্যু দেখে শোকে নুয়ে পড়ি, যারা শান্তির প্রার্থনায় হাত দু’খানি জড়ো করি, তারাও অজানতে ‘অপরাধী’ হয়ে পড়ি। চেনা চোখে। অচেনা চোখে। আমার শরীরে, আমার পরিচয়ে গেঁথে আছে একটি ব্যাজ, ‘মুসলমান’। আমরা যারা নিজেদের ধর্ম নিয়ে কখনও বিশেষ ভাবে ভাবিনি, তারা বুঝি না, নামের আগে বা পরে বসে থাকা কোনও শব্দ কী ভাবে প্রতি দিনের জীবনযাত্রাকে নিমেষে পাল্টে দিতে পারে। নিতান্ত সাধারণ আমাদের রোজ বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট অর্জন করতে হয়।

মিডিয়ার চোখরাঙানি, খবরের কাগজের ভাষা, আদালতের বিচার— প্রতি দিন হত্যা হচ্ছে আমাদের। আমাদেরই শহরে, গ্রামে, দেশে। শহরের ফুটপাতে হাঁটার সময়, গ্রামের বাজারের ভিড়ে, কিংবা হাসপাতালের অপেক্ষমাণ ঘরে— হঠাৎ করেই মনে হয়, আমার নামের ছায়া আমার সামনে ধরা পড়ে যাচ্ছে। আমার আগে সে পৌঁছে যাচ্ছে। সেখানে ধর্ম পরিচয়ই জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মীর অতিরিক্ত প্রশ্নে, বন্ধুর খটকা লাগা হাসিতে, স্বজনের চুপচাপ শ্বাসপ্রশ্বাসে— মনে হয়, যেন চোখের সামনে অদৃশ্য এক স্ক্যানার কাজ করছে। মনে হয় জিজ্ঞেস করি, ‘আমায় সন্দেহ করছ?’— এ দেশে আর এটুকুও সাহসে কুলোয় না উচ্চারণ করতে। প্রতি বার যখন কোনও বোমা বিস্ফোরণ হয়, কোনও হামলা হয়, টেলিভিশনের পর্দায় যখন মুখগুলো গর্জন করে ওঠে, এই গর্জনের শব্দ প্রথমে এসে ধাক্কা দেয় আমাদেরই দরজায়। আমাদের ফের প্রমাণ করতে হয়— ‘আমি ওদের মতো নই’। এই ‘নই’ উচ্চারণের ভার প্রতি দিন মারে আমাদের। শ্বাস নেওয়ার মতো আবশ্যিক কাজটিও তখন ক্লান্তিকর মনে হয়।

আমরা জানি না, কখন সোশ্যাল মিডিয়ার কোনও মন্তব্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠবে। কখন আমাদের গোমাংসের অজুহাতে পিটিয়ে মারা হবে; কখন কঠিন ধারায় জেলে পুরে পচিয়ে মারা হবে। কখন ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। কখন আমাদের চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। কখন আমাদের সন্তানেরা স্কুলে, পাড়ায় হেনস্থার মুখে পড়বে। কখন আমাদের ভালবাসা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে। কখন আমাদের দেশপ্রেম ফাঁপা বলে দেগে দেওয়া হবে। আমরা স্রেফ এ দেশের মুসলমান বলে। ধর্মহীন পৃথিবী কেবল কবিতার বইতে আছে। বাস্তবের ভারতে ধর্মই পরিচয়, এবং পরিচয়ই প্রমাণ। আমাদের প্রমাণ করতে হয়, ‘ইসলামিক’ জঙ্গি নই।

কখনও কখনও মনে হয়, যদি নামহীন, ধর্মহীন হয়ে থাকতে পারতাম! ঈশ্বরের সন্তানেরা কি তখন শুধু ভালবাসা আর শ্রদ্ধার মাপকাঠিতেই আমাদের বিচার করতেন? রেজাউল করীম প্রায় এক শতাব্দী আগে লিখেছিলেন, “ধর্মের আসল শিক্ষা আমাদের বুঝতে হবে— মানুষকে হত্যা করে নয়, মানুষকে ভালবেসেই প্রকৃত ঈশ্বরসেবা করা হয়। দরকারে দশ হাজার মসজিদ আর মন্দির মাটিতে মিশে যাক, তবু যেন ঈশ্বরের কোনও একটি সন্তানের সামান্যতম ক্ষতি না হয়... সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তখন খুশি হবেন, যখন তিনি দেখবেন, শত শত বছরের বিবাদ, রক্তপাত আর যুদ্ধের পরে অবশেষে তাঁর সন্তানেরা শান্তি, সৌহার্দ্য আর বন্ধুত্বের মধ্যে একত্রে বসবাস করছে।” আজ ওঁর এই কথাগুলো বড় বেশি করে মাথায় ঘুরছে। এই যে বাঁচার দাবি, শুধু মুসলমান নয়, শুধু হিন্দু নয়, কোনও ধর্মের মানুষ হয়ে নয়— প্রতি দিন, প্রতি ক্ষণে শুধু মানুষ হয়ে বাঁচার দাবি— এর কোনও মূল্য আর নেই? কাকে বোঝাব? যিনি পহেলগামের ঘটনায় বন্ধু-আত্মীয়-সহকর্মী-সহযোদ্ধা মুসলমানকে গাল পেড়ে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ‘বিসর্জন’ দিয়েছেন, তাঁকে?

স্কুলের সরস্বতী পুজোয় বাকি বন্ধুদের সঙ্গে তুমুল মাততাম। কে কোন ধর্মের, আলাদা করে ভাবতে হত না। আজ, ইদের দিন বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় করে। নমাজের পোশাকে দেখে যদি কেউ ‘ভুল বোঝে’। যদি প্রশ্ন ওঠে। আলো ও ছায়ার খেলা শুধু প্রকৃতিতে নয়, মানুষের মনেও। কেউ আলোকে ব্যবহার করে— ভালবাসা ছড়িয়ে দিতে, কেউ ছায়াকে ব্যবহার করে— ঘৃণা রোপণ করতে।

আমরা, এ দেশের সাধারণ মুসলমানেরা, আমরা চাই আলো— যে আলোয় আমাদের পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে স্বতঃসিদ্ধ প্রশ্ন তোলা হবে না। কিন্তু, এই আলো আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যায়। ঝন্টুরা শত প্রাণ দিয়েও সে আলোর নাগাল পায় না। প্রতিটি আলো ছায়ার ভিতরে নীলচে হয়ে আসে— প্রশ্নের ছায়া, বিদ্বেষের ছায়া, বঞ্চনার ছায়া। আমাদের শিশুরাও স্কুলে নাম বলার আগে দ্বিধা করে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া তরুণ মুসলমানেরা ‘জেহাদি’ অপবাদে ঘেরা থাকে। চাকরির ইন্টারভিউয়ে আমরা বুঝে যাই— আমাদের নাম, আমাদের ধর্ম আমাদের দক্ষতার চেয়েও বেশি দৃশ্যমান।

আমরা আজ নদী হয়ে ভবিষ্যৎহীন আকাশের নীচে এক বিষণ্ণ মরুভূমির ভিতর দিয়ে চলেছি। এই নদী আজ বড় ক্লান্ত। কিন্তু নদী থামতে পারে না। এই নদীর আত্মা প্রতি দিন রক্তাক্ত হয় রাজনৈতিক বক্তৃতায়, হিংসাত্মক মিছিলের পোস্টারে, সংবাদমাধ্যমের ন্যারেটিভ নির্মাণে, মসজিদের সামনে ডিজে বক্সের হল্লায়, চেনা বন্ধুদের পাল্টে যাওয়ায়। আমরা আলোর জন্য লড়ছি। আমরা নদীর মতো বয়ে চলছি— বাঁক নিতে নিতে, শুকিয়ে যেতে যেতে, আবার বৃষ্টির অপেক্ষায়। আলো আর ছায়ার এই খেলায়, আমরা জানি, ছায়া এখন জিতছে।

কিন্তু নদী জানে— এক দিন সে সমুদ্রে পৌঁছবেই। আমরাও জানি, কোনও এক দিন সমস্ত ছায়া পেরিয়ে আমরাও আলোয় দাঁড়াব ঠিকই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Communalism Communal harmony

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy