Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

এ বার ক্রিকেট

‘ইন্ডিয়া জিতেগা’ বলে রক্তচাপ বাড়ানোর জাতীয়তাবাদী দায় নেই। আজ খেলাটাকে খেলার মতো করে দেখতে পারেন। সুযোগটা নেবেন নাকি? প্রতি বছর শীত এলে লেপের ভেতরে শুয়ে মায়ের মুখে শুনতাম উমনোঝুমনোর গল্প। আর বাবা শোনাতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘থ্রি ডব্লুস’-এর কথা। পৌষলক্ষ্মীর পুজো, সংক্রান্তির পিঠেপুলির মতোই বছরে এক বার নিয়ম করে শীতের ছুটির মধ্যে ইডেনে আসত টেস্ট ক্রিকেট, আর খেলা শুরুর আগে বাবার মুখে রূপকথার মতো শুনতাম ইডেন টেস্টের অভিজ্ঞতাগুলো।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:১২
Share: Save:

প্রতি বছর শীত এলে লেপের ভেতরে শুয়ে মায়ের মুখে শুনতাম উমনোঝুমনোর গল্প। আর বাবা শোনাতেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ‘থ্রি ডব্লুস’-এর কথা। পৌষলক্ষ্মীর পুজো, সংক্রান্তির পিঠেপুলির মতোই বছরে এক বার নিয়ম করে শীতের ছুটির মধ্যে ইডেনে আসত টেস্ট ক্রিকেট, আর খেলা শুরুর আগে বাবার মুখে রূপকথার মতো শুনতাম ইডেন টেস্টের অভিজ্ঞতাগুলো। যে দেশই ভারত সফরে আসুক না কেন, বাবার কাছে ইডেন টেস্টের গল্প মানেই হয় ইংল্যান্ড নয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। একটা দেশ আমাদের খেলাটা শিখিয়েছে আর অন্য দেশটা আমাদের মতোই সাদাদের এই খেলাটাকে নিজেদের মতো করে নিয়ে প্রাণ দিয়ে ভালবেসে খেলেছে। আজ বিশ্বকাপ ফাইনালের প্রতিযোগী দুই দেশকে দেখে বাবার কথাগুলো খুব মনে পড়ল। বাবা আর নেই, ক্রিকেটও এখন আমূল বদলেছে, পৌষ মাসের শীতের সকালের টেস্ট এটা মোটেও নয়। হোক না চৈত্রের আঁচে সন্ধের টি-টোয়েন্টি, তবু, নিজের দেশ ছাড়া যে দুই দেশের খেলা দেখতে বাবা আজ নিশ্চয় ইডেনে যেতেন, তারাই আজ ইডেনে।

কেবল পূর্বপ্রজন্মের ইমোশন নয়, পরিসংখ্যানই প্রমাণ দেয় ইডেনের সঙ্গে এই দুই দেশের সংযোগ কতখানি প্রবল। ১৯৩৪ থেকে গত আট দশকে ইডেনে ঊনচল্লিশটা টেস্ট খেলা হয়েছে। ইংল্যান্ড আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলেছে সবচেয়ে বেশি, দশটা করে। আমার জন্মের আগে তিন দশকে তিন বার ইডেনে আসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ’৪৮, ’৫৮, ’৬৬। এই তিন বারই ইডেন টেস্ট শুরু হয় ৩১ ডিসেম্বর।

বাবার মুখে বারংবার শোনা তিনটে নাম ‘থ্রি ডব্লুস’ হলেন তিন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, যাঁদের পদবির আদ্যক্ষর ডব্লু। স্যর ফ্র্যাঙ্ক ওরেল, স্যর এভার্টন উইকস আর স্যর ক্লাইড ওয়ালকট। স্যর আর ডব্লু ছাড়াও নানা মিল ছিল এঁদের, অমিলও, তবে তিন জনই অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যানের মালিক, যা যে কোনও খেলোয়াড়ের ঈর্ষার কারণ হবে। ছোটবেলায় বাবার কথা শুনে ভাবতাম, নিশ্চয়ই এঁরা তিন জন একসঙ্গে ইডেনে খেলে গেছেন। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। বস্তুত, ওরেল ভারতেই খেলতে আসেননি। ভারতের বিরুদ্ধে দশটা টেস্ট খেলেছেন ঘরের মাঠে দুটো সিরিজে, পাঁচটা করে। ১৯৪৮-৪৯-এ ভারত সফরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের নতুন দুই মুখ, বছর চব্বিশের উইকস আর ওয়ালকট মাতিয়ে দিয়ে যান। উইকস ইডেনে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করেন, ওয়ালকট প্রথম ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি করেন, দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরি। ইডেনের আর এক মিথ রোহন কানহাই। ১৯৫৮-৫৯’য় ইডেনে এক ইনিংসে একাই ২৫৬। বাবাদের প্রজন্মের কাছে কানহাই আরও বড় হিরো হলেন ১৯৬৬-৬৭ সিরিজে। টেস্টের দ্বিতীয় দিন, পয়লা জানুয়ারি দর্শকরা ইডেনে আগুন লাগান, সে আগুন থেকে ভারতের জাতীয় পতাকা বাঁচাতে কানহাই নাকি তরতর করে ছাদে ওঠেন। মিথ, পুরোটাই কাহিনি। কানহাই নন, কোনও ক্রিকেটারই নন, সাদা জামা পরিহিত কলকাতা পুলিশের এক অফিসার নাকি পতাকা নামিয়েছিলেন। তবু, গল্প শুনে শুনে কানহাই আমাদের কাছে নায়ক।

বাবা-কাকা-মেসোদের সঙ্গে হাত ধরে সত্তর-আশির দশকে আমাদের প্রজন্মও প্রতি শীতে ইডেনে গেছে। মিথ আমাদের জীবনেও গড়ে উঠেছে বইকী। চোখের সামনে দেখা ছবি এখন রূপকথার মতো শোনায়। যেমন, ১৯৭৬-৭৭-এ ইংল্যান্ডের অধিনায়ক দীর্ঘদেহী টনি গ্রেগ সেঞ্চুরি করে, হাঁটু মুড়ে বসে ইডেনের দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। ১৯৭৮-এর ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে আমাদের আইডল সানি দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করলেন। সেই গাওস্করই (তখন অবশ্য আনন্দবাজার গাভাসকার-ই লিখত) ঠিক পাঁচ বছর পর, দর্শকরা সিটে বসার আগেই টেস্টের প্রথম বলে মার্শালকে খোঁচা দিয়ে, পিছনে আর না তাকিয়ে সোজা প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা দিলেন। লম্বা রুপোলি চুলের রাজপুত্রদ্বয় বব উইলিস আর ইয়ান বথাম আশির দশকে রান-আপ শুরু করতেন সাইটস্ক্রিন থেকে। তিন দশক পরে এখনকার বিশেষজ্ঞ উইলিস আর বথামকে দেখে মনে হয় সেই দিনগুলো বোধহয় স্বপ্নেই দেখেছি, ঠিক যেমন স্বপ্ন হয়ে গেছেন বাঁ-হাতি জাদুকর ডেভিড গাওয়ার?

ইডেনের দর্শক হিসেবে আমাদের মনে ওঁরা বেঁচে আছেন, ওঁদের মনেও নিশ্চয় আজও ইডেনে খেলার স্মৃতি জ্বলজ্বল করে। টনি গ্রেগের মতো আর এক লম্বা-চওড়া অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড ১৯৮৩ ডিসেম্বরে একা ভারতকে দুরমুশ করেন। নিজে ১৬১ রানে অপরাজিত থেকে তৃতীয় দিনের বিকেলে যেন ক্ষুধার্ত পেস বোলারদের লেলিয়ে দিলেন, গাওস্করের ব্যাট থেকে পর পর চারটে চার বাদ দিলে পর দিন একমাত্র প্রতিরোধ এসেছিল বাংলার জামাই অশোক মলহোত্র-র ব্যাট থেকে (সেটাই তাঁর একমাত্র ইডেন টেস্ট)। মলহোত্র ত্রিশ রানে আউট, ভারত নব্বই রানে অল আউট। খেলা সওয়া তিন দিনে শেষ। সে দিনের পরে লয়েডের কাছে আজও ইডেন পৃথিবীর সেরা মাঠ!

যে ক্রিকেট খেলা ইডেনে দেখে বড় হয়েছি, সেই স্মৃতির সঙ্গে আজকের ক্রিকেটের বিশেষ মিল নেই। বাবাকে যেমন ভুলতে পারি না, ছোটবেলার ইডেনকেও মিস করি খুব। এখন খেলাটার সঙ্গে আমরা অহেতুক জাতীয়তা জুড়ে দিয়েছি। খেলা শুরু হলেই বলতে হয় ‘ইন্ডিয়া জিতেগা’। বিদেশি হলেও ভাল ক্রিকেটার যে হতে পারে, আর তাদের খেলা দেখেও যে আনন্দ পেতে পারি, সেই ধারণাটা বিস্মৃত। ’৮৩-র ইডেনের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে গোহারা হারব তবু মন খারাপ হবে না, সে যুগ চলে গেছে কবে!

যে দুই দেশ আমাদের ক্রিকেটকে ভালবাসতে শিখিয়েছে, তারাই আজ আমাদের ঘরের মাঠে মুখোমুখি। আগে যা ছিল ক্রিকেট, আজ তা পণ্য। ওয়েস্ট ইন্ডিজে আজও ক্রিকেট প্রতিভার খামতি নেই, অথচ ক্রিকেটের বাজার দর নেই বলে সে দেশের যুবসমাজ ক্রিকেট খেলতেই চায় না, সবাই আমেরিকার টাকার জোরে বাস্কেটবল খেলে আর দেখে। আইপিএল থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের যেমন ব্যক্তিগত লাভ, তেমনই এই বিশ্বকাপে ভারতে এসে ভাল ফল করলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটেরও লাভ। ইংল্যান্ডের গল্পও অনুরূপ। স্কাই-এর চ্যানেলে ক্রিকেট দেখিয়েই ক্রিকেট বোর্ড ও কাউন্টিগুলো অর্থ উপার্জন করে। টিভিতে ক্রিকেট দর্শক মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূতরাই, যাঁরা ভারতকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দেখতে চান। জাতীয়তাবাদ অধুনা দেশে প্রবল, প্রবাসে প্রবলতর।

তাই বলি কী, মাঠে ও টিভির সামনে উগ্র জাতীয়তাবাদ তো অনেক দেখলাম এবং দেখালাম, আজ বরং ছোটবেলার মতো ক্রিকেটটা উপভোগ করি। ‘ইন্ডিয়া জিতেগা’ বলে রক্তচাপ বাড়ানোর দায় না থাকলে খেলাটাকে খেলার মতো করে দেখার একটা সুযোগ থাকে। ভালবাসারও। কয়েক ঘণ্টা সেই সুযোগটুকুর সদ্ব্যবহার করলে ক্ষতি কী?

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE