রণবীর সিংহ পারলেন না। রাজধানী দিল্লির তুঘলকাবাদে এক রেস্তরাঁতে গত কয়েক বছর তিনি ছিলেন ডেলিভারি এজেন্ট। করোনাভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে কেন্দ্রীয় সরকার যখন মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে গোটা দেশকে লকডাউন বা ঘরবন্দি করার নির্দেশ দিল, তার দিন দুয়েকের মধ্যেই আশপাশের অন্য অভিবাসী কর্মীর মতো রণবীরও দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু দেশ যে অনেক দূর, দিল্লি থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার। পায়ে হেঁটেই যেতে হবে এই দীর্ঘ পথ। শ’দুয়েক কিলোমিটার অতিক্রম করে ফেললেও রণবীরের শরীর দিল না। গন্তব্যের সওয়াশো কিলোমিটার আগেই আগরার উপকণ্ঠে ক্লান্তিতে, অবসাদে, অনাহারে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
রণবীরের মতো হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক এখন ‘দেশে ফিরতে’ মরিয়া চেষ্টা করছেন। টেলিভিশনের পর্দায় দিল্লির আনন্দবিহারের বাস টার্মিনাসের ‘ভয়ঙ্কর’ দৃশ্য দেখে আমরা কেউ বিস্মিত, কেউ উত্তেজিত। এই ‘নির্বোধ’ লোকগুলো তো নিজেরা মরবেই, আমাদেরও মারবে। এদের কেন কেউ আটকাচ্ছে না, বাধা দিচ্ছে না?
আনন্দবিহারে জমায়েত হওয়া পুরুষ-নারী-শিশু খবর পেয়েছিলেন যে উত্তরপ্রদেশ সরকার তাদের ঘরে ফেরাবার জন্য বিশেষ আন্তঃরাজ্য বাসের ব্যবস্থা করবে। তাই এ এক অন্য ‘ঘর ওয়াপসি’-র অদম্য প্রচেষ্টা। ভুললে চলবে কি, বিগত বছরগুলিতে এই অভিবাসী শ্রমিক কর্মচারীরাই কিন্তু দিল্লিতে বা দেশের অন্য বড় শহরগুলিতে আমার-আপনার ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন, ঘরের কাজে সাহায্য করেছেন, ছোট ছোট অসংগঠিত ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে নিরন্তর কাজ করে হয়তো আমাদের আয়ত্তে এনে দিয়েছেন রকমারি কাজের জিনিস। কিন্তু আজ যখন ভাইরাসের ভ্রুকুটিতে সমগ্র পৃথিবী আতঙ্কিত ও বিপন্ন, তখন যেখানে এই মানুষগুলি কাজ করেন, যেখানকার অর্থনীতিকে সামান্য হলেও সমৃদ্ধ করেন, সেখানকার প্রশাসন তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টাই করল না প্রায়। কোনও কোনও রাজ্য সরকার সামান্য প্রতিশ্রুতিতেই নিজেদের পদক্ষেপ সীমিত রেখেছে। সাহায্যের কোনও হাত প্রকৃতপক্ষে আর্ত মানুষদের কাছে পৌঁছয়নি। এই সঙ্কটকালেও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অধিকাংশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রাদেশিকতার ছাপ স্পষ্ট। রয়েছে প্রকট শ্রেণিবৈষম্যের ছায়াও। প্রসঙ্গত, যে দিন রণবীর পথে লুটিয়ে পড়লেন, সে দিনই এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ফোনে তীব্র উষ্মা প্রকাশ করছিলেন এই বলে যে, পশ্চিমবঙ্গে এত লোক যে ফিরে আসছে রোজ, আমাদের কী হবে? সকলের সঙ্গে মিলেমিশে এরা তো ভাইরাসকে আরও ছড়াবে। মজার ব্যাপার, প্রবীণ এই মানুষটির একমাত্র সন্তান নিজেও দেশের অন্য একটি শহরের তথ্যপ্রযুক্তি তালুকে কর্মরত। অভিবাসী শ্রমিকরা তো অশিক্ষিত গরিবগুর্বোর দল। অবশ্য এক পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গের অন্তত এক লক্ষ ষোলো হাজার মানুষ ভিন রাজ্যে কর্মরত হলেও এই বিপর্যয়ের মুখে ঘরে ফিরেছেন এখনও পর্যন্ত এঁদের মাত্র দুই শতাংশ।
পুঁজিকেন্দ্রিক বিশ্বায়ন দুনিয়াটাকে বিগত কয়েক দশকে একেবারে পাল্টে ফেলেছে। পুঁজি এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে শ্রমিক এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছেন উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার সৌজন্যে। আইনি পথে বা আইনবহির্ভূত উপায়ে, হয়তো বা দালালের হাত ধরে, কোটি কোটি মানুষ জীবিকার সন্ধানে পাড়ি দিয়েছেন বা দিতে বাধ্য হয়েছেন অন্যত্র, ভিন্ দেশেও। গোটা পৃথিবীতেই উচ্চপ্রশিক্ষিত কর্মীদের স্বাগত জানানো হয়েছে। স্বল্পশিক্ষিত, অদক্ষ শ্রমিকের জন্য রাষ্ট্রের সীমানা বহু ক্ষেত্রেই বন্ধ থাকলেও কম খরচে ক্রেতা, উপভোক্তাদের কাছে পণ্য ও পরিষেবা পৌঁছনোর তাগিদে প্রধানত মুনাফাকেন্দ্রিক এই অর্থনীতিতে চোরা পথেই অদক্ষ শ্রমিকদের ঠাঁই হয়েছে। এই ঠাঁই মিলেছে স্থানীয় মানুষের, দেশের মানুষের বহিরাগত-বিদ্বেষ সত্ত্বেও।
কিন্তু আজকের এই তীব্র সঙ্কটে অভিবাসী শ্রমিকরা নতুন ভাবে বৈষম্যের শিকার। সীমিত সঞ্চয় নিয়ে সরকারি সাহায্য ছাড়া কর্মহীন অবস্থায় ভিন্ দেশে বেশি দিন থাকা যে অসম্ভব, সেই সরল সত্য অনুধাবনেও আমরা অপারগ। রাষ্ট্রের চোখে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের অবস্থা আরও করুণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা বিভিন্ন দেশের সরকার নির্দেশিত সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং অথবা বার বার সাবান আর জল দিয়ে হাত ধোওয়ার প্রস্তাব (স্যানিটাইজ়ারের কথা ছেড়েই দিলাম) এঁদের অধিকাংশের কাছেই নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া কিছু নয়। যে বস্তিতে বা অস্থায়ী ছাউনিতে দেশ-বিদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের থাকতে হয়, সেখানে অনেক সময়েই এক চিলতে ঘরে বিশ-পঁচিশ জনের বাস। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরই হোক, গ্রিক দ্বীপ লেসবোস-এ অবস্থিত মোরিয়া শিবিরই হোক, বা লেবাননের রেকা উপত্যকার উদ্বাস্তু শিবিরই হোক, ত্রিপল আর প্লাস্টিকের চাদরে আচ্ছাদিত অস্থায়ী আশ্রয়গুলিতে সর্বত্রই ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই পরিস্থিতি। যেখানে বড়জোর পাঁচশো লোকের আশ্রয় জুটতে পারে, সেখানে হয়তো ছ’হাজার লোক রয়েছেন। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে প্রতি আড়াইশো-তিনশো মানুষের জন্য একটিমাত্র শৌচালয়। তার পরিস্থিতিও বিপজ্জনক। সেখানে সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বা নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা সর্বৈব অবাস্তব। অথচ কোথাও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সন্দেহের তালিকায় সর্বোচ্চ স্থানটি এই অভিবাসী এবং উদ্বাস্তুদের। সর্বাগ্রে অপবাদ জোটে তাঁদেরই। উত্তরপ্রদেশের বরেলিতে ফিরে আসার পর সেখানকার প্রশাসন যে ভাবে সকলের উপরে জীবাণুনাশক ছড়িয়েছে, তেমন করা কি সম্ভব হত অন্যা রাজ্য থেকে বা বিদেশ থেকে ফেরত আসা উচ্চশিক্ষিত তথ্যপ্রযুক্তি কর্মীদের ক্ষেত্রে?
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী যৌথ উদ্যোগ বহু প্রত্যাশিত, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন ইঙ্গিত মেলেনি। আমেরিকা করোনাভাইরাসকে ‘চিনা ভাইরাস’ বলে চিহ্নিত করতে উদ্যত হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই বিশ্বের ধনী দেশগুলির মধ্যেও কথা আর এগোয়নি। অথচ উৎস যেখানেই হোক, এই অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে, বিশ্বজনীন সমস্যার মোকাবিলা বিশ্বব্যাপী পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই করা দরকার। ভাইরাস রাষ্ট্রীয় কাঁটাতারের বেড়া মানেনি। তার মোকাবিলাতেও বেড়ার অন্য পারে হাত বাড়াতে হবেই। বিশ্বায়িত নাগরিক সমাজকেও সাধ্যমতো সক্রিয় হতে হবে। সর্বোপরি, বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণিনির্বিশেষে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একান্ত জরুরি। যে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক কাজে যুক্ত মানুষেরা এই বিপদের মুখে নিজেদের ও আপনজনের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন, যে অভিবাসী শ্রমিক বা শরণার্থী আজ সর্বাধিক বিপন্ন, তাঁদের জন্য যদি সামান্য সমানুভূতিও আমাদের না থাকে, তা হলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। লক্ষণীয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই নেওয়া অন্তত ২ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষের একটি বড় অংশই শিশু। আর এই শিশুদের অনেকেই মা-বাবা-বিহীন। এই আপৎকালেও কি তারা অনাথই বোধ করবে? আর নিরাপদ দূরত্ব ও আশ্রয় থেকে আমরা আরও রণবীর সিংহের অকালমৃত্যুর অপেক্ষাতেই থাকব?
উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy