Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আর সরকারি স্কুল, হাসপাতাল?

‘ক্লি নিকাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট বিল’ রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত হল, কিছুটা যেন ধর তক্তা-মার পেরেক ধাঁচেই। বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার আদবকায়দা আমরা সবাই এত দিন এক রকম মেনেই নিয়েছিলাম। নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া মানেই বাঁধাধরা এক গত— একগাদা অর্থ ব্যয়, অথচ প্রাপ্ত পরিষেবার বেলায় অষ্টরম্ভা।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

‘ক্লি নিকাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট বিল’ রাজ্য বিধানসভায় গৃহীত হল, কিছুটা যেন ধর তক্তা-মার পেরেক ধাঁচেই। বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার আদবকায়দা আমরা সবাই এত দিন এক রকম মেনেই নিয়েছিলাম। নার্সিংহোমে ভর্তি হওয়া মানেই বাঁধাধরা এক গত— একগাদা অর্থ ব্যয়, অথচ প্রাপ্ত পরিষেবার বেলায় অষ্টরম্ভা। তবু এই (অ)ব্যবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই, কারণ বিকল্প নেই, সরকারি হাসপাতালের চেয়ে তো মন্দের ভাল। এক বিশেষ সাম্প্রতিক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে বহুআলোচিত না হলে হয়তো মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে সমস্যাটা আসতও না।

নতুন আইন প্রণয়নে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের ভূমিকা সাধুবাদার্হ। তবে, কথায় বলে, নিজের কাজ ভাল ভাবে করার জন্যে কোনও পুরস্কার নেই। এ ক্ষেত্রেও হয়তো তাই। আধুনিক বাজারি-অর্থনীতিতে সরকারের কাজই হল ‘গভর্ন্যান্স।’ বাজারের জোগান-চাহিদার শর্ত মেনে যে কোনও দ্রব্য বা পরিষেবার ক্রয়-বিক্রয় হবে ঠিকই, তবে, তাতে যদি কোনও অনৈতিক অথবা অযাচিত পরিস্থিতির সূচনা হয়, তা হলে সরকারি হস্তক্ষেপ আবশ্যিক। অর্থনীতির পরিভাষায় বললে, বাজারি পরিণামের বৈষম্য ও অদক্ষতা দূর করার দায় সরকারের। দেশে-বিদেশে এ রকম সরকারি হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণের ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। যেমন, পশ্চিমি দেশগুলিতে গ্রাহক বা উপভোক্তার জন্যে বিভিন্ন কমিশনের বিভিন্ন শাখা। বিলেতে বিভিন্ন পরিষেবার ক্ষেত্রে ‘রেগুলেটর’ বা নিয়ন্ত্রক অফিস আছে, যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের জন্যে অফজেম, টেলিফোনের জন্যে অফকম, শিক্ষাব্যবস্থার জন্যে অফস্টেড ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের দেশের খাদ্য-নিয়ন্ত্রক বা ফুড-ইনস্পেকটর পদটি নতুন নয়— ছোটবেলায় দেখেছি গঙ্গার ধারের হাটের মুখে সকালবেলায় জাঁকিয়ে বসে থাকতেন সরকারের প্রতিভূ। তরিতরকারি, মাছমাংসের দাম অথবা মানের গোলমাল হলেই তাঁর কাছে বিক্রেতাকে জবাবদিহি করতে হত। অতএব, সরকার চাইলে, গভর্ন্যান্স-এর দোহাই দিয়ে, অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকের সংজ্ঞা মেনেই, বেসরকারি হাসপাতালের জুলুম বন্ধ করতে পারতেন, নতুন বিল না লিখলেও হয়তো চলত।

বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় হানা দিয়ে সরকারি নীতির রথ যে থামবে না, তা মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় স্পষ্ট। তাঁর পরের পদক্ষেপ হতে চলেছে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় আঘাত। বেসরকারি হাসপাতালের মতো, এখানেও ‘টাকার খেলা’। মুখ্যমন্ত্রী চান বিপুল অর্থের বিনিময়ে শিক্ষা দানের (বা বিক্রয়ের) এ হেন আয়োজনের মুখে লাগাম টানতে। শিক্ষাক্ষেত্রেও এ জাতীয় আইন বলবৎ হলে পুনরায় সাধুরব উঠবে। তবে, এ ভাবে স্বল্পমেয়াদি নীতি দিয়ে শুধু হাততালি না কুড়িয়ে সরকারের উচিত এই সুযোগটা কাজে লাগানো, আমাদের রাজ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-ব্যবস্থার মূল সমস্যার গোড়ায় ঢুকে খোলনলচে বদলানো। তা না হলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-ব্যবস্থায় আমাদের মূল সমস্যাটা যেমন, ঠিক তেমনই থাকবে।

আমাদের মূল সমস্যা হল, এখন আর মধ্যবিত্ত (এমনকী অনেকাংশে নিম্ন মধ্যবিত্ত) শ্রেণির মানুষ সরকারি হাসপাতালে যেতে চান না। দাম যা-ই হোক না কেন, বেসরকারি হাসপাতালই আমাদের ভরসা। শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যাটা এক ধাপ ওপরে, ভাল স্কুল বলতে কেবল বেসরকারি না, ইংরেজি-মাধ্যমের বেসরকারি স্কুল বোঝায়। গ্রামে, যেখানে ইংরেজি-মাধ্যম স্কুল নেই, সরকারি স্কুল ভরসা, বাকি সর্বত্র বেসরকারির জয়জয়কার। সরকারি স্কুলের শিক্ষকশিক্ষিকারাই নিজের সন্তানের জন্য ইংরেজি-মাধ্যমের বেসরকারি স্কুল খোঁজেন।

স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ দেখে মনে হয়, সরকারের কাজ যেন শুধু বেসরকারি বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু কেন? শিক্ষা, স্বাস্থ্য তো সরকারের দায়। বিশেষত আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে। বস্তুত, বিলেত সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বেসরকারি স্কুল আছে বটে, কিন্তু তাতে ১০ শতাংশও যায় না। শিক্ষা খাতে সরকার সেখানে বিপুল ব্যয় করে। বিলেতে সরকারি টাকায় চলে ‘ন্যাশনাল হেল্‌থ সার্ভিস’। তবে হ্যাঁ, পশ্চিমের দেশগুলিতে করের হার বেশি। কিন্তু ভেবে দেখলে, বেসরকারি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যর জন্য আমরাও তো প্রতি মাসে টাকা জমাই। এই সঞ্চিত টাকা ব্যবহার করেই হয়তো আমাদের দেশের সরকারও ভাল সরকারি স্কুল-হাসপাতাল চালাতে পারেন। সরকার এটা ভেবে দেখলে তার সুফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE