যে মুকুট রাহুল গাঁধী পরছেন, তা যে কাঁটার মুকুট, সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ছবি: সংগৃহীত।
তাঁর এক পূর্বপুরুষ প্রায় ৮৮ বছর আগে প্রথম বার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন। সে দিন সম্ভবত কারওরই জানা ছিল না যে, ১৯২৯ সালে যিনি প্রথম বার কংগ্রেসের সভাপতি হলেন, পরবর্তী ৮৮ বছরের এক বিরাট সময় জুড়ে তাঁর পরিবারের হাতেই থাকবে কংগ্রেসের রাশটা। আজ অবশ্য সকলেই জানেন যে, কংগ্রেসের শীর্ষপদ আর নেহরু-গাঁধী পরিবার প্রায় সমার্থক। পরম্পরা বহাল রেখেই আজ আনুষ্ঠানিক ভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হচ্ছেন রাহুল গাঁধী।
এমন এক সময়ে রাহুল গাঁধী কংগ্রেস সভাপতি পদে বসছেন, যখন দল এক অভূতপূর্ব সন্ধিক্ষণে। রাহুলের আগে তাঁর পরিবারের তিনটি প্রজন্ম কংগ্রেসের শীর্ষপদ সামলেছে। কিন্তু জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গাঁধী, রাজীব গাঁধী— প্রত্যেকেই এমন এক সময়ে দলের দায়িত্ব হাতে নিয়েছিলেন, যখন দল শাসন ক্ষমতায় আসীন। সনিয়া গাঁধী অবশ্য বিরোধী আসনে থাকা কংগ্রেসের দায়িত্বই হাতে পেয়েছিলেন। কিন্তু সে কংগ্রেসও আজকের মতো দুর্বল ছিল না। এবং পরবর্তী কালে টানা এক দশক ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকেও হাতে পেয়েছেন সনিয়া।
রাহুল গাঁধী কখন হাতে পেলেন কংগ্রেসের সভাপতিত্ব? যখন প্রায় গোটা দেশে বিজেপি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। যখন দেশের প্রায় সব বড় রাজ্যে ক্ষমতার অলিন্দ থেকে কংগ্রেস বহু দূরে ছিটকে গিয়েছে। যখন আসমুদ্রহিমাচল ভারতে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলি কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। যখন স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে প্রথম বার সংসদের দুই কক্ষেই কংগ্রেস গরিষ্ঠতা হারিয়েছে। যখন দেশের নানা প্রান্তে, নানা স্তরের নির্বাচনে কংগ্রেসের ব্যর্থতা সাফল্যের চেয়ে অনেক বেশি।
অতএব, যে মুকুট রাহুল গাঁধী পরছেন, তা যে কাঁটার মুকুট, সে নিয়ে কোনও সংশয় নেই। নেহরু-গাঁধী পরিবারের সদস্য হিসেবে রাহুলই যে সবচেয়ে কঠিন সময়ে কংগ্রেস সভাপতিত্বে আসীন হলেন, তা নিয়েও কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
নেহরু-গাঁধী পরিবারের বাইরে কংগ্রেস সচরাচর কোনও সভাপতি খুঁজে পায় না, এ কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা হতে পারে। সে দুর্বলতা কাটানোর প্রয়োজন কংগ্রেস বোধ করে কি না, তা কংগ্রেসকেই ভাবতে হবে। আজকের প্রসঙ্গে সে নিয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ নেই। আলোচনার অবকাশ এখানে রাহুল গাঁধীর সাফল্য বা ব্যর্থতার সম্ভাবনা নিয়ে। রাজনীতিতে অনেকগুলো বছরই কাটিয়ে দিয়েছেন রাহুল। কিন্তু দলের মুকুটে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পালক তিনি সংযোজন করতে পেরেছেন, এমন নজির নেই। সভাপতি হওয়ার পরে কি কিছুটা বদলে দিতে পারবেন তিনি পরিস্থিতি? রাজনৈতিক শিবিরে চর্চা এখন তা নিয়েই।
আরও পড়ুন
কীসের ‘অবসর’, জল্পনা ওড়াল দলই
এ কথা কিন্তু ঠিক যে, অতীতের রাহুল গাঁধী এবং সাম্প্রতিক রাহুল গাঁধীর মধ্যে কিছু ফারাক চোখে পড়ছে। বারংবার ‘পাপ্পু’ সম্বোধনে যে রাহুলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে নেতির আলোকে দেখানোর চেষ্টা করে তাঁর বিরোধীরা, গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে কিন্তু সেই রাহুলকে দেখা যায়নি। তাঁর মধ্যে অনেক পরিণত এক রাজনীতিককে দেখা গিয়েছে গুজরাতে। বেফাঁস মন্তব্য করে বিজেপি-র হাতে অস্ত্র তুলে দেননি তিনি। বেফাঁস মন্তব্য দেখেই মণিশঙ্কর আইয়ারের মতো প্রবীণ নেতার বিরুদ্ধেও তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ করেছেন। হার্দিক, অল্পেশ, জিগ্নেশের মতো পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠীপতিদের এক ছাতার তলায় এনেছেন। গুজরাতে সম্পূর্ণ নতুন এক সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর জন্ম দিয়েছেন। কংগ্রেস রাজনীতির বহু বছরের অভিমুখ তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছেন, সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে সরব হননি, মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে গুজরাতে নরম হিন্দুত্বের বার্তা দিতে চেয়েছেন। গোটা দেশে যখন দুর্নিবার গতি বিজেপির, তখন নরেন্দ্র মোদীর নিজের রাজ্যে বিজেপিকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছেন। অর্থাৎ সভাপতি পদে আসীন হওয়ার প্রাক্-মুহূর্ত থেকেই এক অন্য রাহুল দেখা দিতে শুরু করেছেন। গুজরাতে তাঁর দল ক্ষমতায় আসতে পারুক বা না পারুক, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে হয়ে উঠতে পেরেছে অনেক বছর পরে, এ নিশ্চয়ই রাহুল গাঁধীর কৃতিত্ব। এ নির্বাচনে না জিতেও যদি কিছু আসন রাহুল ছিনিয়ে নিতে পারেন প্রবল পরাক্রমী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের থেকে, যদি বাড়িয়ে নিতে পারেন ভোট শতাংশ, তা হলে সে নিঃসন্দেহে কংগ্রেসের জন্য ইতিবাচক হবে। বিজেপি-র বিরুদ্ধে যে রাজনৈতিক প্রবাহ এ দেশে, সে প্রবাহের চালিকাশক্তি যে কংগ্রেসের হাতেই থাকছে এবং কংগ্রেস যে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইটাও শুরু করে দিয়েছে, গুজরাত নির্বাচনে কংগ্রেসের অপেক্ষাকৃত ভাল ফল হলে তেমনটাই প্রমাণিত হবে। রাহুল গাঁধী নিজেও সম্ভবত এখন সেই অনুমোদনের অপেক্ষাতেই রয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy