আপাতত সবার উপরে কাশ্মীর সত্য, আপাতত ভারতীয় অর্থনীতির বিপন্নতার চিত্র বহুলাংশে আড়ালে। কিন্তু অর্থনীতির মার দুনিয়ার বার, সংবাদমাধ্যমের পাদপ্রদীপের আলো সরাইয়া লইলেও তাহা হইতে রক্ষা মিলিবে না। নরেন্দ্র মোদী কখনও রাজা ক্যানিউটের কাহিনি শুনিয়াছেন কি না বলা কঠিন, কিন্তু আপন অভিজ্ঞতায় নির্ঘাত বুঝিতেছেন যে, বিপুল ভোটে জয়ী হইলেও অর্থনীতির সমীহ আদায় করা যায় না। জাতীয় আয়ের অঙ্ক পাঁচ লক্ষ কোটিতে পৌঁছাইয়া দিবার ফানুস তিনি উড়াইয়া দিয়াছেন, তাহার জন্য বৎসরে অন্তত ৮ শতাংশ হারে আয়বৃদ্ধি চাই, অথচ চলতি বৎসরে ৬ শতাংশ বৃদ্ধিও ক্রমশ সাধ্যাতীত ঠেকিতেছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর বিমল জালান বড় মুখ করিয়া ভরসা দিয়াছেন: অর্থনীতির জোয়ারভাটা চলিতেই থাকে, দুই-এক বৎসরের মধ্যে আয়বৃদ্ধির গতি বাড়িবে। ইহাতে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার সঙ্গীরা কতটা ভরসা পাইবেন, বলা শক্ত। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বর্তমান কর্ণধার শক্তিকান্ত দাস মোদী সরকারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ বলিয়াই কথিত আছে, তিনিও চলতি বৎসরের আনুমানিক আয়বৃদ্ধির হারকে ৬.৯ শতাংশের উপরে রাখিতে পারেন নাই।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন কোনও যুগে অর্থনীতির ছাত্রী ছিলেন, সেই বিদ্যার অন্যতম প্রাথমিক সূত্রটি হয়তো তাঁহার মনে আছে— ভবিষ্যৎ আয়বৃদ্ধি নির্ভর করে প্রধানত বর্তমান বিনিয়োগের উপর। বেসরকারি বিনিয়োগ এখনও ন যযৌ ন তস্থৌ। তাহার পাশাপাশি যন্ত্রপাতি এবং শিল্প-উপকরণ আমদানির হারও স্তিমিত। ইহার অর্থ অতি সহজ এবং সরল— শিল্পোদ্যোগী ও ব্যবসায়ীরা বাজার উঠিবে বলিয়া মনে করিতেছেন না, অতএব তাঁহারা উৎপাদন বাড়াইবার জন্য রসদ সংগ্রহে বা নূতন বিনিয়োগে উৎসাহী নহেন। তাঁহাদের ‘অ্যানিমাল স্পিরিটস’ এখনও নিদ্রিত। স্বাভাবিক। মোটরগাড়ি হইতে গৃহস্থালির সরঞ্জাম— বহু পণ্যের বাজারে চাহিদা নাই, কোম্পানির গুদামে মাল জমিতেছে। জমি-বাড়ির বাজারে জোয়ারের ক্ষীণ লক্ষণ দেখা দিয়াও মিলিয়া যাইতে বসিয়াছে। রেলে মালপত্র পরিবহণের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। এমনকি মূল্যবৃদ্ধির হার চার শতাংশে সীমিত বলিয়াও যথেষ্ট নিশ্চিন্ত বোধ করা কঠিন— চাহিদায় ভাটার টান অধিক হইলে বাজারদর অস্বাভাবিক কম থাকে।
কাশ্মীর কব্জা করিবার অভিযান চালাইয়া উন্মাদনার বাষ্প ছড়াইয়া দেওয়া চলিতে পারে, কিন্তু তাহাতে জিডিপির ফানুস উড়িবে না। প্রধানমন্ত্রী জানেন, নির্মলাজি নিমিত্তমাত্র, অর্থনীতির পরীক্ষায় ফেল করিলে ভক্তরা তাঁহাকেই দায়ী করিবেন। বস্তুত, ইতিমধ্যেই তাঁহারা প্রশ্ন তুলিতে শুরু করিয়াছেন। যে শিল্প-পরিচালক বা ব্যবসায়ীরা মোদীজির মহিমায় আপ্লুত ছিলেন, তাঁহারাও একের পর এক মুখ খুলিতেছেন। যাঁহাদের মুখ ফুটিবার নহে, তাঁহাদেরও ‘মন কি বাত’ অনুমেয়। ইতিমধ্যে শক্তিকান্তবাবু আপন দায়িত্ব পালন করিয়াছেন, সুদের হার বার বার চার বার কমাইয়াছেন, এ বার আবার কিছু ফাউও দিয়াছেন— রেপো রেট (রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক হইতে ঋণ লইলে ব্যাঙ্কগুলিকে যে হারে সুদ মিটাইতে হয়) কমিয়াছে ০.২৫-এর বদলে ০.৩৫ শতাংশ-বিন্দু। কিন্তু কম সুদে ধার মিলিলেই উপভোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা ভোগ ও বিনিয়োগ বাড়াইবার তাগিদে দলে দলে ঋণ লইবেন এবং তজ্জনিত চাহিদার টানে মন্দাক্রান্ত বাজারে জোয়ার আসিবে, ধনলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া চাহিবেন— এমন ঘটিবার ভরসা বোধ করি বিমল জালানও দিবেন না। অর্থমন্ত্রী কিছুকাল আগে চোয়াল কঠিন করিয়া বলিয়াছিলেন, তিনি অর্থনীতি লইয়া উদ্বিগ্ন নহেন। ইতিমধ্যে অমিত শাহের কল্যাণে তাঁহাকে আর ক্যামেরার সামনে দাঁড়াইতে হয় নাই। কিন্তু অনন্তকাল এমন আড়াল মিলিবে না। চোয়াল কঠিন রাখিবার যোগ-বিদ্যাটি অভ্যাস করিতেছেন তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy