Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

একটু ভাবলে কিন্তু চাষির দুর্গতি কমত

কেন্দ্রীয় সরকারের কিসান ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পটির সফল রূপায়ণ হলে আজ চাষিরা তার সাহায্যে এটিএম থেকে টাকা তুলতে পারতেন। নোটবন্দির ফলে গ্রামে গ্রামে গরিব চাষি কতখানি দুর্দশায় পড়েছেন, তা নিয়ে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং বরিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের কিসান ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি) চাষির জন্যই তৈরি হয়েছিল।

সোমদীপ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

নোটবন্দির ফলে গ্রামে গ্রামে গরিব চাষি কতখানি দুর্দশায় পড়েছেন, তা নিয়ে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন অনেক রাজনৈতিক নেতা এবং বরিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের কিসান ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি) চাষির জন্যই তৈরি হয়েছিল। প্রকল্পটির যথাযথ রূপায়ণ হয়ে থাকলে কেসিসি ব্যবহার করে চাষের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে, বা টাকার জোগান থাকলে এটিএম থেকে টাকা তুলতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেসিসি-র সদ্ব্যবহার কি আদৌ হচ্ছে এ দেশে?

ব্যাঙ্কের সঙ্গে চাষির সম্পর্ক তৈরির কথা ছিল কেসিসি-র। স্বল্প হারে সুদ, সহজ শর্তে ঋণ, নমনীয় ঋণশোধ, এই ছিল কেসিসি-র উদ্দেশ্য। প্রয়োজন মতো টাকা ধার পেলে চাষি আরও ভাল প্রযুক্তি ব্যবহার করবে, উৎপাদন আরও বাড়াবে, এমনই মনে করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে শুরু হওয়ার পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কেসিসি। নাবার্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রকল্পের সূচনা থেকে শুরু করে ২০১৫-১৬ অর্থবর্ষ অবধি শুধুমাত্র সমবায় ও আঞ্চলিক গ্রামীণ ব্যাঙ্কেই পাঁচ কোটির ওপর সক্রিয় কেসিসি অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু, অধিকাংশ চাষি কি কেসিসি ব্যবহার করে উন্নত চাষ, বেশি রোজগার, সহজ ঋণের সুযোগ পাচ্ছেন?

চাষের উপর ব্যাঙ্কের কৃষিঋণের প্রভাব যে রয়েছে, তা ধরা পড়ছে গবেষণায়। ভারতে পনেরো বছরের ধান উৎপাদনের তথ্য (১৯৮৬-২০১১) থেকে দেখা যাচ্ছে, যে সব জেলায় কেসিসি বিতরণের পরিকাঠামো ভাল, চাষিদের কাছে কেসিসি তুলনায় সহজলভ্য, সেখানে ধানের উৎপাদন বেশি। গড় উৎপাদনের চাইতে প্রায় ৩৩ শতাংশ বেশি উৎপাদন হচ্ছে সেই সব জেলায়। এমনকী অধিক উৎপাদনশীল বীজ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, এই সব জেলাগুলি অন্যান্য এলাকার চাইতে এগিয়ে রয়েছে। ফলনে এই তারতম্য যে কেসিসি-র জন্যই হচ্ছে, অন্য কারণে নয়, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে কেসিসি বিতরণ শুরু হওয়ার আগের দশ বছর ও পরের দশ বছরের ফলনের তথ্য মিলিয়ে দেখা হয়েছে। তাতে স্পষ্ট হয়েছে, কেসিসি বিতরণ ও ব্যবহারের পরিকাঠামো যে সব এলাকায় দ্রুত উন্নত হয়েছে, সেখানেই বাড়তি ফসল হচ্ছে।

অথচ কেসিসি-র সঙ্গে বাড়তি ফলনের সম্পর্ক ঠিক কী, সেটা স্পষ্ট নয়। চাষির স্বল্প সুদে ঋণের প্রয়োজন আছে, এটা যদি ধরে নেওয়া যায়, তা হলে কেসিসি-র মতো প্রকল্পের সুযোগ পেলে তাঁরা বেশি ঋণ নেবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কেসিসি আসার পর চাষি পরিবারগুলি যে বেশি ঋণ নিচ্ছে এমন নয়। এমনকী তাঁরা যে ঋণের জন্য ব্যাঙ্ককেই বেশি পছন্দ করছেন, এমনও নয়। ঋণ নেওয়ার হার, গৃহীত ঋণের মোট অঙ্ক, অশোধিত ঋণের অঙ্ক, একাধিক জায়গা থেকে ঋণ, কোনও বিষয়েই কেসিসি-র কোনও প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। চাষিদের একটা বড় অংশের ঋণচিত্রে কোনও পরিবর্তনই আনেনি কেসিসি।

লাভ হচ্ছে কেবল সেই সব পরিবারের, যাদের আগে থেকে ব্যাঙ্কের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। ফসল উৎপাদনও বাড়ছে তাদেরই বেশি। কারণ তাঁরা অন্য উৎস থেকে বেশি সুদে টাকা না নিয়ে, ব্যাঙ্ক থেকে কম সুদে টাকা নিচ্ছেন। তাতে পাওনাদারের সংখ্যা কমেছে। যদিও মোট ঋণের অঙ্ক বাড়েনি এঁদের ক্ষেত্রেও। তা হলে উৎপাদন বেশি হচ্ছে কী করে? তার একটি সম্ভাব্য কারণ, এই চাষিরা আগে দুঃসময়ের কথা ভেবে যে টাকাটা জমাতেন, সেটা এখন খরচ করছেন চাষের কাজে। প্রয়োজন হলে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়া যাবে, এই নিশ্চয়তা তাঁদের প্রত্যয় জুগিয়েছে সঞ্চয় কম রেখে চাষে বেশি বিনিয়োগ করার। অর্থনীতির ভাষায় বলা যেতে পারে, এই চাষিদের ঝুঁকি সহ্য করার ক্ষমতা (রিস্ক টলারেন্স) বেড়েছে।

এ থেকে ইঙ্গিত মিলছে, যাঁদের একাধিক জায়গা থেকে ঋণ নেওয়ার সুবিধে আগেই ছিল, কেসিসি তাঁদের সেই সুবিধেকে আরও বাড়াচ্ছে। তাতে সামগ্রিক ভাবে চাষে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে কিন্তু ক্ষুদ্র চাষির হাল ফেরেনি। কেসিসি তাঁদের অধিকাংশের কাছে ব্যাঙ্কের ঋণকে পৌঁছে দিতে পারেনি। হয় তিনি কেসিসি পাননি, অথবা কার্ড হাতে পেলেও তা ব্যবহার করে ঋণ নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে এই গবেষকের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ হল এই যে, ধনী চাষি পরিবারগুলির হাতে অনেকগুলি করে কেসিসি থাকছে, তা ব্যবহার করে তাঁরা অনেক টাকা তুলছেন। ব্যাঙ্কের খাতায় কেসিসি-র সংখ্যা এবং কৃষি ঋণের অঙ্ক, দুটোই অনেক বেশি দেখাচ্ছে। কিন্তু চাষিদের বড় অংশ সেই সুযোগের বাইরে থেকে যাচ্ছেন।

নাবার্ডের তথ্যেও এই বিভাজনের কথা বলছে— ২০০৪ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে সেই সব ঋণের অ্যাকাউন্ট, যার অঙ্ক দু’লক্ষ টাকার কম। ওই একই সময়ে এক কোটি টাকার বেশি ঋণের অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে আটগুণ।

কিসান ক্রেডিট কার্ড ক্ষুদ্র চাষিকে ব্যাঙ্কের আওতায় আনার সুযোগ তৈরি করেছিল। সে সুযোগ যদি ঠিক সময়ে কাজে লাগানো যেত, তা হলে আজ গরিব চাষির কথা ভেবে হাহুতাশ করতে হত না। এটিএম যখন নোটভর্তি হবে, তখনও নগদবন্দি হয়ে থাকবে চাষি। ঋণবন্দি থাকবে মহাজনের খাতায়।

লেখক আইআইএম লখনউ-এ অর্থনীতির শিক্ষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy