Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২...

ব্রিটেনের যুবসমাজ তাঁকে পছন্দ করেছে

গত মাসে বিলেতের লেবার দলের নেতা নির্বাচিত হলেন জেরেমি কর্বিন। দলের অভ্যন্তরীণ নেতা নির্বাচনে জেরেমি কর্বিনের জয় লেবার দলের ভেতরে বটেই, দলের বাইরে‌ও বিলেতের সর্বত্র আলোড়ন তুলেছে। কারণটা মূলত কর্বিনের ব্যক্তিত্ব এবং তদুপরি তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা ও নীতিগত অবস্থান।

ইন্দ্রজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৫ ০২:২২
Share: Save:

গত মাসে বিলেতের লেবার দলের নেতা নির্বাচিত হলেন জেরেমি কর্বিন। দলের অভ্যন্তরীণ নেতা নির্বাচনে জেরেমি কর্বিনের জয় লেবার দলের ভেতরে বটেই, দলের বাইরে‌ও বিলেতের সর্বত্র আলোড়ন তুলেছে। কারণটা মূলত কর্বিনের ব্যক্তিত্ব এবং তদুপরি তাঁর নিজস্ব চিন্তাধারা ও নীতিগত অবস্থান। এক কথায় বললে, জেরেমি কর্বিনের পরিচয় হল তিনি এক বামপন্থী নেতা। কনজারভেটিভ দলের সঙ্গে তুলনা করলে লেবার দলকে সব সময়ই একটু বাম-ঘেঁষা মনে হতে পারে। বিলেতের সাম্প্রতিক নির্বাচনে পরাজিত লেবারের ভূতপূর্ব নেতা এড মিলিব্যান্ড নিজেও বাম দিকেই ঝুঁকে ছিলেন বলা চলে। অন্তত পিতৃ পরিচয়ে তো বটেই। এডের বাবা র‌্যাল্ফ মিলিব্যান্ড পুরোদস্তুর মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক হিসেবে বিখ্যাত, লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। এ হেন এড-এর তুলনাতেও জেরেমির রাজনৈতিক অবস্থান অনেক-অনেক দূর বামে। এ রকম কোনও প্রধান দলের নেতা, তদুপরি ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী, বিলেতের জনগণ আগে দেখেননি। অ-ভূতপূর্ব।

রাজনীতিক হিসেবে, এবং বামপন্থী পরিচয়ে জেরেমি কর্বিন অবশ্য নতুন মুখ নন। গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বিলেতের সাংসদ। দলের মধ্যে নিজের অবস্থান বজায় রেখেই তিনি লেবার দলের নানা নেতার নানা নীতিগত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এসেছেন এত দিন। কখনও পরোক্ষে, সংসদে দলের কথা না মেনে এবং কখনও-বা প্রত্যক্ষে, প্রকাশ্য ভাবে দলের নীতির বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে। যেমন, গত দশকে টনি ব্লেয়ারের ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধনীতির তিনি তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। শুধু বামপন্থী চিন্তাধারাই নয়, কর্বিনের ব্যক্তিত্ব, কথাবার্তার ধরনও বেশ দলছুট। বিলেতের সাংসদরা সাধারণত আচরণ ও কথায় বেশ উন্নাসিক, উচ্চশিক্ষিত সুরের, তুলনায় কর্বিন অনেক সাধারণ, সোজাসাপ্টা কথা বলেন। অতএব, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, জেরেমি কর্বিন লেবার দলের সাংসদদের মধ্যে খুব একটা জনপ্রিয় নন, অনেকেই তাঁর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতেন, এবং এখনও চলেন।

তা হলে, এ হেন জেরেমি কর্বিন কী ভাবে জিতলেন দলের নির্বাচনে? এ কথা ঠিক, বিলেতে গত সাধারণ নির্বাচনে গো-হারান হারার পরে, লেবার দলের প্রয়োজন ছিল এক অন্য ধরনের নেতার। নিন্দুকেরা বলেন, নেতা হিসেবে এড মিলিব্যান্ড এতটাই কম ব্যক্তিত্ব দেখিয়েছিলেন যে জেরেমির মতো স্পষ্ট বক্তা ও দৃঢ় ব্যক্তির পক্ষে নেতা হওয়া সহজতর হয়ে যায়; এক জনপ্রিয় সংবাদপত্রের কার্টুনে তো জেরেমির মুখে বসানোই হয় ‘থ্যাংক ইউ এড’। তবে, জেরেমি মোটেই তাঁর দলের সাংসদদের সমর্থনে নেতা হননি। বিলেতে দলের নেতা হবার জন্য সরাসরি সদস্যদের ভোট পেতে হয়, দলের সাংসদদের সমর্থন প্রয়োজন হয় না; জেরেমি তা পানওনি। বস্তুত, এখনও জেরেমিকে নেতা হিসেবে দলের অনেক সাংসদই মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি, কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করে বিভিন্ন সাংসদীয় পদ ও দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। নেতা নির্বাচনে দাঁড়ানোর জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিতে মুষ্টিমেয় কয়েক জন সাংসদ বন্ধু ও সহকর্মীর সমর্থন পেয়েছিলেন ঠিকই। তবে, জেরেমি কর্বিন নেতা নির্বাচিত হয়েছেন লেবার সদস্যদের মন জয় করে। জেরেমির জনদরদি বামপন্থী নীতি সাধারণ মানুষের মনে সহজেই দাগ কাটে। হলও তাই— সদস্যরা বিপুল ভোটে জেরেমিকে জেতালেন, শতকরা এত ভোট টনি ব্লেয়ারও লেবার নেতা নির্বাচিত হবার সময় পাননি। জেরেমির বক্তৃতা এতটাই প্রভাব ফেলে যে, তাঁকে জেতানোর জন্যে হাজার হাজার নাগরিক লেবার দলের সদস্যপদ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখ্য যুবসমাজ। তুলনায় কমবয়সি ভোটাররা বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন জেরেমি কর্বিনের জনসাধারণের জন্য তৈরি মন-মাতানো বামপন্থী নীতির প্রতি।

তবে, লেবার দলের নির্বাচনে জেতা এক, আর দেশের সাধারণ নির্বাচন আর এক। কয়েক বছরের মধ্যে জেরেমি কি প্রধানমন্ত্রী পদের যোগ্য হতে পারবেন? পারবেন এর পরের সাধারণ নির্বাচনে কনজারভেটিভদের হারিয়ে লেবারকে জেতাতে, একক ভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়তে? নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে? এর মধ্যেই নিন্দুকেরা বলতে শুরু করেছেন, নতুন সদস্য জুটিয়ে এ বার নেতা নির্বাচিত হলেও, এই সুখের দিন বেশি দিন জেরেমির ভাগ্যে নেই। প্রধানমন্ত্রী হওয়া তো দূর, কিছু দিন পরে হয়তো লেবার দলের আস্থা হারাবেন। লেবার দল নিজেরাই তাদের দলের নতুন নেতা নির্বাচন করবেন। কারণটা সহজবোধ্য। জেরেমি কর্বিনের রাজনীতি নতুন ধরনের, যাকে বলে র‌্যাডিক্যাল পলিটিক্স। বিলেত, আমেরিকার মতো পশ্চিমী দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এক ধরনের নিজস্ব গতে বাঁধা রাজনীতির স্টাইল আছে। সেটার বাইরে বেরিয়ে একটা চমক সৃষ্টি হয় ঠিক, কিন্তু বেশি দিন চলে না। যেমন, আমেরিকার ডেমোক্র্যাট দলের নেতার পদে বার্নি সনডার্স, অথবা বিলেতের অতি-ডান জাতীয়বাদী ইউকিপ দলের নেতা নাইজেল ফ্যারাজ। বার্নির কথায় যেমন জাদু আছে, তেমনই জেরেমিরও। নাইজেলও যেমন জোর গলায় বলেন— বিলেত হল বিলেতের নাগরিকদের জন্যে, ইউরোপীয়দের জন্য নয়, বিলেতের উচিত ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসা। এ হেন দৃঢ়চেতা নীতির বক্তা হিসেবে নাইজেলকে অনেকেই পছন্দ করেন, ঠিক তেমনই জেরেমিকে অনেকেই পছন্দ করতে পারেন অতি বাম মানসিকতার জন্যে।

জেরেমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, রাজতন্ত্রে নন— তাই রানিকে এড়িয়ে চলেন, এমনকী রানি দীর্ঘজীবী হোন এমন জাতীয় সংগীতের সঙ্গে গলাও মেলান না, জাতীয় অনুষ্ঠানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। জেরেমি মনে করেন যুদ্ধখাতে ব্যয় কমানো উচিত— পরমাণু অস্ত্র তো নৈব নৈব চ। অতি ধনী ব্যবসায়ীদের জেরেমি পছন্দ করেন না, তিনি চান ধনীরা আরও বেশি হারে ট্যাক্স দিক। তাঁর মতে, সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ ভুল হয়েছিল। যেমন, রেল পরিষেবাকে জেরেমি পুনরায় সরকারের আয়ত্ত ফিরিয়ে আনতে চান। অতি বাম ও অতি ডান যেন কোথায় মিশে যেতে চায়।

তবে রাজনীতির মঞ্চে মধ্যপন্থার জয় সহজ। আমেরিকায় বার্নি যতই জনপ্রিয় হন না কেন, হিলারি ক্লিন্টন সহজেই তাঁকে টিভি বিতর্কে হারিয়ে দেন। বিলেতে তো ক্যামেরন কটাক্ষ করতে শুরু করেছেন জেরেমিকে। বলেছেন, দেশটা তো চালাতে হবে, অতএব বাজারি অর্থনীতির বিকল্প বামপন্থী নীতি হতে পারে না। ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি হারে কর চাইলে তাঁদের অনেকেই হয়তো দেশ থেকেই ব্যবসা সরিয়ে নেবেন বা উৎপাদন কমাবেন— তাতে তো মোট কর এবং সরকারের আয় কমে যাবে, তখন?

বিলেতে এখন অর্থনীতির থেকেও বড় সমস্যা হল ইউরোপ ও ইউরোপে আসা শরণার্থীরা। ক্যামেরন এখন চাপে— সিরিয়ার শরণার্থীদের এখন হয়তো দেশে জায়গা দিতে চান। কিন্তু পরে কী হবে? অধিকাংশ অনুপ্রবেশকারী বা উদ্বাস্তুরা কিন্তু বিলেতে আসতে চান সৌভাগ্যের খোঁজে, অর্থনৈতিক কারণে। শরণার্থীরা তো সকলেই সিরিয়ার উদ্বাস্তু নন— অনেক এশীয় দেশের নাগরিক সিরিয়ান সেজে আসছেন এই দেশে। তার উপর আছে গত কয়েক বছর ধরে পূর্ব ইউরোপের অনাহূতরা, যাঁরা এখন দলে দলে বিলেতে এসেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্যে। তা হলে কি বিলেতের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে আসা? ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রতিশ্রুতি দেন এই বিষয়ে দেশ জুড়ে গণভোট হবে। আগামী বছর গণভোটে কী হবে কেউ জানে না— পক্ষে-বিপক্ষের দুই দলের তর্ক শুরু হয়ে গেছে। গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে আছে স্কটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডে গত নির্বাচনে লেবার একটি আসনও পায়নি। সেখানের জাতীয়তাবাদী দল এস এন পি হয়তো আবার স্কটল্যান্ডে গণভোট ডাকবে স্কটল্যান্ডকে স্বাধীন করার দাবিতে।

লেবার দল, বিশেষত জেরেমি কর্বিন এই দুই গণভোটে কী ভূমিকা নেন, সেটাই এখন দেখার।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE