Advertisement
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

জন্ম ও মৃত্যু, ওরা ও আমরা

জীবনের বোধন আর বিসর্জনের দুই মুহূর্তে পুবে ও পশ্চিমে পুরুষের দুই ভূমিকা। লিখছেন ইন্দ্রজিৎ রায়।উত্তর কলকাতার এক ঘাটে বুক-জল গঙ্গায় দাঁড়িয়ে দু’বছর আগে আশ্বিনে, এই পিতৃপক্ষেই, পিতৃপুরুষদের স্মরণ করেছিলাম। মহালয়ার ভোরে নয়, কৃষ্ণপক্ষের এক মাঝরাতে, বাবার দাহকাজ শেষ করে। তার তিরিশ ঘণ্টা আগে বাবা দেহরক্ষা করেছিলেন।

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

উত্তর কলকাতার এক ঘাটে বুক-জল গঙ্গায় দাঁড়িয়ে দু’বছর আগে আশ্বিনে, এই পিতৃপক্ষেই, পিতৃপুরুষদের স্মরণ করেছিলাম। মহালয়ার ভোরে নয়, কৃষ্ণপক্ষের এক মাঝরাতে, বাবার দাহকাজ শেষ করে। তার তিরিশ ঘণ্টা আগে বাবা দেহরক্ষা করেছিলেন। ভাইয়ের ফোনে খবর পেলাম বাবা আর নেই। বাবা বেশ কিছু দিন ভুগছিলেন, একাধিক বার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তার আগের মাসেই অনেক দিন হাসপাতালে কাটিয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন। জানতাম মৃত্যু আসছে। তবু যে-কোনও মৃত্যুর ক্ষণই আচমকা আসে। সপরিবার রাতের ফ্লাইট ধরলাম। পরের দিন কলকাতা বিমানবন্দরে যখন নামলাম, তখন সন্ধেবেলা। বাবার মৃত্যুর ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পরে।

ফ্ল্যাশব্যাক: ১৯৯৯-এর অগস্ট মাসের এক রাত। স্থান, বিলেতের ইয়র্ক শহরের জেলা হাসপাতাল। প্রসূতি বিভাগের এক ঘরে মাঝরাতে আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দিতে চলেছেন আমার স্ত্রী। প্রথম সন্তানের জন্মের আগে পশ্চিমের দেশগুলোতে বাবা-মা’দের নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশেষত, বাবা হিসেবে সন্তানের জন্মের আগে ও পরের নানা খুঁটিনাটি বিষয় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হতে হয়, দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। অতএব, আগের কুড়ি ঘণ্টা ধরে চলা ঘটনাপ্রবাহ আমার জীবনে প্রথম হলেও একেবারে অজানা নয়। নতুন বাবা হিসেবে একাধিক ‘বার্থ-ভিডিয়ো’ আমায় দেখানো হয়েছিল, তবু ছোট্ট মাথাটা যখন গর্ভ থেকে উঁকি মারল, আগমনের এই চিত্র একেবারেই আনকোরা। গর্ভের বাইরে শুধু মাথা স্থির, চোখ বন্ধ, ভিতরে বাকি দেহ। জাতক তখনও বিজ্ঞানের চোখে জাত নয়, যত ক্ষণ পুরো দেহ বেরিয়ে না আসছে। ডাক্তার, নার্স, ধাইরা আছেন, ঠিক যেমন শ্মশানে বাবার মরদেহের পাশে পুরোহিতরা ছিলেন। কিন্তু জাতকের নতুন দেহ আমার হাতেই তুলে দেওয়া হল। আমার সন্তানকে নাড়ি কেটে গর্ভ থেকে আলাদা করার দায়িত্বও আমার।

পুত্রের জন্ম আর পিতার মৃত্যু যেন পুরুষ হিসেবে আমাকে কোথাও একটা মিলিয়ে দিয়েছিল। এক দিকে নতুন প্রজন্মের আগমন, অন্য দিকে পুরাতনের বিদায়। মাঝে থাকি আমি, বাবা বা ছেলে হিসেবে, মহাকালের চাকার সাক্ষী হয়ে। আর সাক্ষী থাকেন পূর্বপুরুষরা, যাঁদের আমরা মহালয়ার দিন স্মরণ করি।

পশ্চিম দুনিয়া বলেই সন্তানজন্মের সময় এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল, হতে পেরেছিল। আমার নিজের দেশে হলে সেটা সম্ভব ছিল না কিছুতেই। আমাদের সমাজে জন্মের সময় বাবার ভূমিকা নগণ্য। আগেকার যুগে তো আঁতুড়ের ধারেকাছে কোনও পুরুষকেই ঘেঁষতে দেওয়া হত না। ডাক্তার নন, জন্মের সময় সব কাজ করতেন ধাইমা-রা। সাবেক প্রথা আর নেই ঠিক, তবু, হাসপাতালের (তা সে যত আধুনিক নার্সিং হোম হোক না কেন) প্রসূতিকক্ষে জন্মের সময় বাবাকে ঢুকতেই দেওয়া হয় না। হরিহর এখনও অপুর জন্মের আগে অস্থির ভাবে পায়চারি করেন, বাড়ির বদলে নার্সিং হোমে, এই যা তফাত।

অন্য দিকে, পাশ্চাত্য সভ্যতায় মরদেহ নিয়ে আচার প্রায় নেই বললেই চলে। দেহ সাজানো থেকে শুরু করে শান্তিকামী পারলৌকিক ক্রিয়া, সব হয় অবশ্যই। তবে, সব রকম কাজ করার জন্যে আলাদা আলাদা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক নিয়োগ করা হয়। ছেলে, আত্মীয়, বন্ধু, সকলের ভূমিকাই প্রায় দর্শকের।

যেন দুই আলাদা পৃথিবী। প্রমথ চৌধুরীর ‘তোমরা ও আমরা’ মনে করিয়ে দেয় প্রতি পদে। আমাদের শ্মশানে মেয়েদের যেতে নেই। বাড়ি থেকেই মেয়েরা বিদায় জানান। মরদেহ কী ভাবে পুড়ে যায়, তা শুধু পুরুষচক্ষেই দেখা যায়। তর্পণ শুধু পুরুষরাই করেন, পিতার উদ্দেশে।

উল্টো দিকে, সন্তানের জন্ম, আগমন যেন শুধু মেয়েদেরই দিন। মাতৃগর্ভ থেকে কী ভাবে আমি বেরিয়ে আসি, তা কোনও পিতা, কোনও পুরুষ জানবেন না, জানতে পারবেন না।

আচ্ছা, সেই দৃশ্য চর্মচোখে দেখি না বলেই কি আমরা পুরুষরা নারীর গর্ভের সম্মান করতে আমরা শিখি না? নারীর শরীরকে, মনকে, তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারি না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial indrajeet roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE