পরিবর্তন। আজকের বোলপুর শহর।
ঠিক বিশ্বাস হয় না, আজকের বোলপুর সে দিনের বলিপুর ছিল!
অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মতো একের পর এক মুক্তি সংগ্রামে উত্তাল হয়েছিল এই শহরই। সেই সব জাতীয় আন্দোলনের সময় এ শহরের আনাচকানাচই ছিল বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়।
আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষকদের লেখায় এবং লোককথায় পাওয়া যায়, সর্পলেহনা-সুপুর ও রাইপুরু নিয়ে তৈরি হয় বোলপুর। ইলামবাজার হাইস্কুলের শিক্ষক তথা আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষক সৌরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, রাজা সুরথের রাজধানী ছিল সুপুর। তিনি এক বার তাঁর সিদ্ধির জন্য দুর্গাপূজার অষ্টমী শেষে এক লক্ষ পশু বলি দিয়েছিলেন। সেই বলিদানের রক্ত বোলপুর ভাসিয়ে দিয়েছিল। তখন একটি জায়গায় বাঁধ দিয়ে বলির রক্ত আটক করা হয়েছিল। সম্ভবত, সেই থেকে বোলপুর। আর ওই বাঁধ দেওয়ার জায়গাটির নাম বাঁধগোড়া।
সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের মতো জেলার আঞ্চলিক ইতিহাসের গবেষকদের লেখায় মেলে, লোহা, লাক্ষা ও নীল শিল্পের জন্য সুনাম ছিল বোলপুরের। ইংরেজ ও ফরাসি কুঠিয়ালরা ব্যবসা ফেঁদেছিল গোটা জেলাতেই। ১৭৮২ সালে জন চিপ জেলায় আসেন। এক কিলোমিটারের ব্যবধানে বোলপুর সংলগ্ন সুরুলের উত্তর পশ্চিমে দু’টি কুঠি নির্মিত হয়। ফরাসিদের পক্ষে মনলি সিনর এবং ইংরেজদের পক্ষে চিপ সাহেব সেই কুঠি থেকে ব্যবসা পরিচালনা করতে শুরু করেন। পরে এই মনলির কুঠিটিই বিশ্বভারতী অধিগ্রহণ করে।
বোলপুর স্টেশনে খাদ্য আন্দোলনে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মারক।
এ ভাবেই একদিন পুরাণকল্পের শহর হয়ে উঠল গঞ্জ শহর, বাণিজ্যের বোলপুর। বোলপুর ও তার সংলগ্ন এলাকায় নীল চাষের স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে। রয়েছে সুরুল কুঠিবাড়িতেও। শহর সংলগ্ন গাঁ-ঘরে অনাদরে পড়ে রয়েছে পুরাতাত্ত্বিক নির্দশনও।
ধীরে ধীরে বোলপুর আধুনিক শহরের চেহারা নেয়। গড়ে ওঠে বেশ কিছু চালকল। জেলার প্রথম রেল স্টেশন তৈরি হয় এখানেই। জীবিকার প্রয়োজনে আশেপাশের বহু মানুষজন তখন থেকে বোলপুরে বসবাস শুরু করতে থাকেন। নানা ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। গড়ে ওঠে পুরসভা, আদালত, মহকুমা অফিস। আর এই উড়ানে গতি এনে দেয় শান্তিনিকেতন আশ্রমের সূচনা।
ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে এ শহরে বহু জনসভা হয়েছে। বয়কট ও স্বদেশির পক্ষে প্রচার চালিয়ে একে একে জেলার কংগ্রেস নেতৃত্ব গ্রেফতারও হয়েছেন। তবে, ১৯১৫ সালে ফেব্রুয়ারিতে গাঁধীর প্রথম বোলপুর-শান্তিনিকেতনে পা রাখায় যেন জোরদার হল আন্দোলন। দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করলেন তিনি এখানকার ছাত্র আন্দোলন থেকেই। তাঁর আহ্বানে হেতমপুর কৃষ্ণচন্দ্র কলেজ ও বেণীমাধব স্কুলের ছাত্ররা রাস্তায় নামে। ঢেউ লাগে শান্তিনিকেতনের ছাত্রমহলেও।
জাতীয় আন্দোলনে বোলপুর সংলগ্ন ‘আমার কুটির’-এর অবদানও কম নয়। প্রতিষ্ঠানের প্রধান সংগঠক ছিলেন সুষেণ মুখোপাধ্যায়। সূতবস্ত্র ছাপার প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে ওঠে ১৯২৬ সালে। ক্রমশ বিপ্লবীদের আত্মগোপনের কেন্দ্র হওয়ায় গ্রেফতার হন সুষেণ। ১৯৩৮ সাল থেকে আইন শিথিল হওয়ায় ফের বিপ্লবীরা জড়ো হন এখানে। গড়ে ওঠে নৈশ বিদ্যালয় ও স্বাস্থ্যচর্চা কেন্দ্র। এরই মধ্যে সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ সালে বোলপুরের কালী বারওয়ারি তলায় একটি জন সমাবেশ করে যান। বিপ্লবের ঢেউ যেন উথলে ওঠে। পরের দিকে আমার কুঠিতে পান্নালাল দাশগুপ্ত, কালিপদ বশিষ্ঠরা যোগ দিলে নব্য রাজনীতির আমদানি হয়। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে, একটি অংশ বোলপুরকে ঘিরে বাম আন্দোলনের বীজ ছড়াতে থাকে। তার চরম পরিণতি দেখা যায় ১৯৪২-এর আন্দোলনে।
১৯৪২ সালের খাদ্য আন্দোলন বোলপুরের স্মৃতির ভিতর। সে দিন ব্রিটিশরা হাজার বস্তা চাল তাদের সৈন্যদের জন্যও মজুত রেখেছিল বোলপুর স্টেশনে। সেই খবর পেয়ে স্থানীয় ক্ষুদার্থ মানুষ ও বল্লভপুরের আমার কুটিরের প্রচুর সাঁওতাল যুবক তির-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন মজুত চাল ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। তাতে খণ্ড যুদ্ধ বেধে যায়। গুলিতে ব্রিটিশদের কয়েকজন আহত হলেও আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েক জন মারা যান। সে সময় বীরভূম বার্তা পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘‘অনেক আশ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। আন্দোলনে যোগদানের জন্য ৮ জন কর্মীর উপর ধার্য হয়েছে পিটুনি ট্যাক্স।’’
সেই সব শহfদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পরে একটি শহিদ স্মারক কমিটি গড়ে উঠেছে। বোলপুর স্টেশনে একটি স্মারক মূর্তিও স্থাপিত হয়েছে। বোলপুরের প্রবীণ সমাজসেবী আনন্দময় সেন বলেন, ‘‘প্রতি বছর সেই দিনটিতে কিছু মানুষ জড়ো হয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বোলপুর স্টেশনে।’’
আজকের নতুন নতুন ব্যাঙ্ক, এটিএম, বস্ত্র বিপণী, এসি গাড়ির ভিড় দেখে আন্দাজ করা মুশকিল এ শহরের কয়েক দশক আগের ছবি। আনন্দবাবু বলেন, ‘‘খুব দ্রুত যেন বদলে গেল। সব স্মৃতি। মহাত্মা গাঁধীরও স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে বোলপুর পুর এলাকার ১৯ নুম্বর ওয়ার্ডে কাছারিপট্টিতে। যেটিকে এখন খাদি পাড়া বলা হয়। সেখানে গড়ে উঠেছিল শিক্ষাগার ও খাদি সঙ্ঘ। মহাত্মা গাঁধীর একান্ত সচিব নির্মলকুমার বসু ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা। গাঁধীর অহিংস আন্দোলন ও স্বাবলম্বন বিস্তারই ছিল ওই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে। বর্তমান সেখানে একটি প্রাথমিক স্কুল স্থাপিত হয়েছে। তবে, স্কুল চত্বরে গাঁধীর ডাণ্ডি অভিযানের একটি সুন্দর প্রস্তর মূর্তি স্থাপিত হয়েছে।’’
বোলপুরে রেল পথ হওয়ার পরে বহু কালের পুরনো বাসন্তীতলার হাট উঠে আসে স্টেশনের গা ঘেঁষা এলাকায়। যেটি এখন বৃহৎ হাটতলা বলে পরিচিত। ফলে রেলপথের পশ্চিম দিকেও ব্যস্ততা বাড়ল। জনবসতিও বাড়ল। তবে বোলপুরের উত্তরে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করেই এলাকায় জনবসতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। কয়েক দশক আগে পর্যন্ত বোলপুর আর শান্তিনিকেতনের মধ্যে একটা সীমারেখা ছিল। এখন তার আর হদিস পাওয়া যায় না। হয়তো সেই কারণেই, স্টেশনের নাম ‘বোলপুর-শান্তিনিকেতন’।
ভিড় থই থই এ শহরে এখন পা রাখা দায়। বিলাসবহুল হোটেল, লজ, রেস্তোরাঁ, পাড়ায় পাড়ায় বহুতল, ইংলিশ মিডিয়ম স্কুল, নগরী-উপনগরী, মন্ত্রী, লালবাতি এবং কেষ্টু-বিষ্টুদের দাদাগিরি! আর এসব নিয়েই আধুনিক বোলপুর। ফি সপ্তাহে যেখানে শয়ে শয়ে মানুষ পর্যটনের টানে ভিড় করেন। ভিড় সরিয়ে মনে পড়ে জেলার কবি আশানন্দন চট্টরাজের কথা। মিঠে সুরেই তো পর্যটনের ডাক দিয়ে লিখেছিলেন, ‘‘দেখে যাও এই মাটিতে, কবিগুরুর সুখের শান্তিনিকেতন/ যেথা আমলকি আম, ছাতিম গাছে/ রোদের সোনা আলোক নাচে/ রাঙা ধূলায় বসায় মেলা গ্রামছাড়া ওই পথ ঘুরে/ দেশ-বিদেশের মানুষ গো যাও এই বীরভূম ঘুরে।’’
ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy