Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

কলাভবনে ছাত্রী নির্যাতন, অভিযুক্ত ৩ সহপাঠী

শারীরিক নির্যাতনের পর মোবাইলে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর ছবি তোলে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র তিন ছাত্র। ছবি প্রকাশ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকাও আদায় করে তারা। মানসিক চাপে অসুস্থ ছাত্রীটি পুরো বিষয়টি জানিয়ে বিভাগীয় প্রধান তথা অধ্যক্ষকে লিখিত অভিযোগও করে। তার ৪৮ ঘণ্টা পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পুলিশকে তো বিষয়টি জানানো হয়ইনি, উল্টেং ওই তিন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনই বিস্ময়কর অভিযোগ উঠল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

মহেন্দ্র জেনা ও আবীর মুখোপাধ্যায়
বিশ্বভারতী শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৪ ০২:৪১
Share: Save:

শারীরিক নির্যাতনের পর মোবাইলে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর ছবি তোলে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র তিন ছাত্র। ছবি প্রকাশ করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকাও আদায় করে তারা। মানসিক চাপে অসুস্থ ছাত্রীটি পুরো বিষয়টি জানিয়ে বিভাগীয় প্রধান তথা অধ্যক্ষকে লিখিত অভিযোগও করে। তার ৪৮ ঘণ্টা পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পুলিশকে তো বিষয়টি জানানো হয়ইনি, উল্টেং ওই তিন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এমনই বিস্ময়কর অভিযোগ উঠল বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ যে হয়েছে, তা স্বীকার করে যৌন নিগ্রহ প্রতিরোধের জন্য তৈরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিশাখা কমিটি’-র সভাপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য বলেন, “বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কলাভবনের অধ্যক্ষ মারফত অভিযোগ পেয়েছি। তার ১৫ মিনিটের মধ্যে ছাত্রী ও ছাত্রীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কলাভবনের অধ্যক্ষ শিশির সাহানা অবশ্য মঙ্গলবারই লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। তা হলে তা দু’দিন পরে কেন পৌঁছল বিশাখা কমিটির কাছে, সে প্রশ্নও উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের মুখপাত্র সন্দীপ বসু সর্বাধিকারী বলেন, “এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।” মিডিয়া সংযোগ অফিসার সবুজকলি সেন ফোন ধরেননি।

বিশ্বভারতীরই অন্য সূত্রে অবশ্য খবর, মেয়েটির বাবা পরিচিতদের কাছে বৃহস্পতিবার দুপুরে থানায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু বিকেলে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে উপাচার্য, তিন প্রোভস্ট এবং বিশাখা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকের পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমাকে একটু চিন্তা করার সময় দিন।” দৃশ্যতই বিধ্বস্ত ভদ্রলোক জানান, তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারেননি।

বিশ্বভারতীর বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভিনরাজ্যের মেয়েটি এ বছরই ভর্তি হয়েছে বিশ্বভারতীর কলাভবনে। অভিযোগ, ওই তিন যুবক একাধিক বার মেয়েটির উপর শারীরিক নির্যাতন চালায়। কখনও কোপাইয়ে, কখনও ঘর দেখাবার নাম করে গুরুপল্লিতে নিয়ে গিয়ে মেয়েটির উপর শারীরিক নির্যাতন চলে। আপত্তিকর অবস্থায় তার ভিডিও রেকর্ডিং-ও করে ওই তিন ছাত্র। তা ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দফায় দফায় বেশ কিছু টাকাও আদায় করে।

ওই ছাত্রীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানিয়েছেন, নির্যাতন মাত্রা ছাড়ানোয় মেয়েটি মানসিক ও শারীরিক ভাবে এতটাই ভেঙে পড়েছিল, যে এক রকম বাধ্য হয়ে বিষয়টি তার এক বান্ধবীকে বলে। ওই বান্ধবী ও তার সহপাঠীর সহযোগিতায় ২৫ অগস্ট সে পিয়ার্সন মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হয়। খবর পেয়ে কলাভবনের অধ্যক্ষ তাকে দেখতেও যান। বিশ্বভারতী সূত্রে খবর, ছাত্রীটি সেই সময়ে সংজ্ঞাহীন ছিল, তার স্যালাইন চলছিল। ছাড়া পাওয়ার পর ওই ছাত্রী বিষয়টি অধ্যক্ষকে প্রথমে মৌখিক ভাবে জানায়। অধ্যক্ষ তাকে লিখিত অভিযোগ দিতে বললে সে মঙ্গলবার চিঠি এবং মেডিক্যাল রিপোর্টের কপি জমা দেয়। অধ্যক্ষ তখন অভিযুক্ত তিন ছাত্রকেও ডেকে লিখিত ভাবে অভিযোগের উত্তর দিতে বলেন। চিঠিতে তারা সকলেই অভিযোগ অস্বীকার করে বলে জানা গিয়েছে।

কলাভবন সূত্রে খবর, মঙ্গলবারই কলাভবনের অন্য অধ্যাপকদের সঙ্গে বৈঠক করেন অধ্যক্ষ। অভিযুক্ত ওই তিন ছাত্রকে ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বভারতী ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা এবং নবীনবরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে খবর জানাজানি হতে ক্রমশ ক্ষোভ ছড়ায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। ইতিমধ্যে ভিনরাজ্য থেকে মেয়েটির বাবা শান্তিনিকেতনে আসেন বুধবার। বিশ্বভারতী সূত্রে খবর, তাঁর আসার খবর পেয়ে বুধবার রাতেই অধ্যক্ষ শিশিরবাবু যোগাযোগ করেন বিশ্বভারতীর শীর্ষকর্তাদের সঙ্গে। ঘটনার কথা জানাজানি হতে কলাভবনে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দফায় দফায় অধ্যাপকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন তিনি। শিশিরবাবুকে অবশ্য এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, “এ নিয়ে মন্তব্য করব না।”

বৃহস্পতিবার দুপুরে উপাচার্যের দফতরে নির্যাতিতা ও তাঁর বাবাকে দেখা যায়। তখন তাঁরা উপাচার্যকে না পেয়ে ফিরে আসেন। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ কলাভবনের কয়েক জন ছাত্রছাত্রীর সহায়তায় বিশ্বভারতীর উপাচার্যের সঙ্গে ফের দেখা করতে যান তাঁরা। বিশ্বভারতীর উপাচার্য, তিন প্রোভস্ট এবং বিশাখা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন ওই ছাত্রী ও তার বাবা। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বৈঠক থেকে বেরিয়ে একে একে শীর্ষকর্তারা কাচ-তোলা গাড়িতে করে চলে যান। মেয়েটি এক বন্ধুর সঙ্গে হস্টেলে ফিরে যায়।

বোলপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, এখনও অবধি এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ তাঁদের কাছে করা হয়নি। বিশ্বভারতীর বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন, শারীরিক নির্যাতন এবং মোবাইলে আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলার লিখিত অভিযোগ পেয়েও বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ কেন ওই ছাত্রদের পুলিশি তদন্ত থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন? আইনজীবী অরুণাভ ঘোষ বলেন, “এ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষেরই উচিত ছিল পুলিশের কাছে ছাত্রীর লিখিত অভিযোগটি পাঠিয়ে দেওয়া।” মেয়েটির নিজেরও উচিত ছিল সরাসরি পুলিশকে জানানো, বলেন তিনি।

উল্লেখ্য, বছরখানেক আগে এক ছাত্রীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার, শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা-সহ যৌন হয়রানির দায়ে বেতনের ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করে এই কলাভবন থেকেই স্থানান্তর করা হয় অধ্যাপক সুমিতাভ পালকে। মণিপুরি এক গবেষিকাকে হেনস্থার দায়ে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক সিদ্ধার্থ দেব মুখোপাধ্যায়কে ডিন পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই ছাত্রীও ছেড়ে চলে যায়।

এলাকার তৃণমূলের সাংসদ তথা বিশ্বভারতীর সমাজকর্ম বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অনুপম হাজরা বলেন, “বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় বিষয়টি জানতে পারি। মেয়েটির বাবার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করে উঠতে পারিনি। যদি পরিবার কোনও আইনি সহায়তা চায়, অবশ্যই দেব।” এই ঘটনার জন্য বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে, এমনও দাবি করেন অনুপমবাবু।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE