কলাভবনের দেওয়ালে কাজ করছেন কে জি সুব্রমণিয়ন। ছবিটি বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা।
চলে গেলেন শান্তিনিকেতনের ‘মানিদা।’
একইসঙ্গে শেষ হল, কলাভবনের প্রথম যুগের শিল্প-ধারার একটি অধ্যায়। মৃত্যুর সময় কে জি সুব্রমণিয়নের বয়স হয়েছিল বিরানব্বই বছর। বুধবার সকালেও শান্তিনিকেতনের দু’-একজনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন তিনি। বেলার দিকে তাঁর প্রয়াণের খবর জানাজানি হতেই শোক ছড়ায় শান্তিনিকেতনে। ভেঙে পড়েন তাঁর স্বজন, কলাভবনে তাঁর ছাত্ররা।
চিত্রকলা, ভাস্কর্য, ভিত্তিচিত্র— সব মাধ্যমেই শিল্পী সারাজীবন ধরে কাজ করেছেন। শিক্ষক হিসেবেও তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন শ্রদ্ধেয়। প্রিয় আশ্রমে তাঁর পরিচিতি ছিল ‘মানিদা’ নামেই। শিল্পের সঙ্গে শিল্পতত্ত্ব চর্চার ক্ষেত্রেও সুবিদিত ছিলেন বলে শিল্প-সমালোচকদের কাছেও বহু চর্চিত তিনি। তাঁদের কথায়, শিল্পী ‘‘এই দুটি ক্ষেত্রকে মিলিয়ে নিতে পারার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। শিল্পচর্চায় এই জায়গাটিতে তাঁর তুলনা চলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে।’’
শিল্পীর জন্ম কেরলের গ্রামে ১৯২৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। প্রথম জীবনে শিল্প নয়, মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। সেখানে পড়তে পড়তেই জড়িয়ে পড়েন ভারত ছাড়ো আন্দোলনে। তাঁকে জেলেও যেতে হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পরে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি না নেওয়ায় ১৯৪৪ সালে কেজি শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন কলাভবনে ভর্তি হওয়ার জন্য। তখন নন্দলাল বসু ছিলেন কলাভবনের অধ্যক্ষ। তখনই পরিচিতি রামকিঙ্করের সঙ্গেও।
সবাই যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে বাড়ি যেতেন, কেজি কিঙ্করের সঙ্গে স্কেচ করতে যেতেন খোয়াই-কোপাইয়ে ধারে। সাঁওতাল পল্লিতে।
শিল্পী কলাভবনের ছাত্র ছিলেন ’৪৮ সাল পর্যন্ত। তাঁর ছবিতে রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীর প্রভাব তখন থেকেই। নন্দলাল, বিনোদবিহারী এবং রামকিঙ্কর – তিনজনকেই তিনি পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। পরে যখন ১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি লন্ডনের ‘স্লেড স্কুল অব আর্টে’ শিল্প নিয়ে পড়ছেন, তখনও তাঁর ছবিতে ঘুরে ফিরে শান্তিনিকেতনের রং-রেখার ভুবন। তবে, সেখানে পাশ্চাত্য আধুনিকতা ও অ্যাকাডেমিক রীতির সঙ্গে নিবিড় পরিচয় ঘটে সেখানেই। যখন অল ইন্ডিয়া হ্যান্ডলুম বোর্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন, লোক-শিল্পের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় ঘটে। এই পর্বেই তাঁর শিল্প-ভাবনা নতুন দিকে মোড় নেয়। তাঁর শিক্ষকতাও কলাভবনেই, ১৯৮০ সাল থেকে।
এ দিন সেই কলাভবনের কিউরেটর সুশোভন অধিকারী বলেন, ‘‘হঠাৎ ফোনে খারাপ খবর পেলাম। পপুলার আর্টের এই মাপের শিল্পী অনেক আছেন, কিন্তু মানিদা ব্যতিক্রমী শিল্পী ছিলেন। কলাভবনের নন্দলাল-বিনোদবিহারী-রামকিঙ্করের ঘরানা শেষ হল। শেষ বার ফেব্রুয়ারিতে শান্তিনিকেতনে যখন এলেন, নন্দনে প্রদর্শনী করলাম। তখনই মনে হল নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন। একটু ক্লান্তও দেখাচ্ছিল!’’
শেষবার যখন শান্তিনিকেতন এসেছিলেন নিজের বাড়িটি দান করে যান বিশ্বভারতীকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, ওই বাড়িটিতে প্রিয় শিক্ষক বিনোদবিহারীর নামে কোনও প্রদর্শশালা করার কথা। ইতিমধ্যেই বিশ্বভারতী তার কাজ শুরু করেছে।
বিশিষ্ট শিল্পী যোগেন চৌধুরী এবং কলাভবনের অধ্যাপক ও ছাত্রছাত্রীরা বুধবার সন্ধেয় একটি স্মরণসভা করে কলাভবন চাতালে। যোগেনবাবু বলেন, ‘‘ওঁর চলে যাওয়া শিল্পের জগতে বড় ক্ষতি হল। প্যারিসের রাস্তায় ওঁর সঙ্গে প্রথম আলাপ। শেষ সময় পর্যন্ত শিল্প সৃষ্টি করে গিয়েছেন।’’ স্মরণসভায় ছিলেন কলাভবনের অধ্যক্ষ তথা ‘মানিদা’র ছাত্র দিলীপ মিত্র। তিনি বলেন, ‘‘মানিদার কাছে শিল্পের পাঠ নেওয়া এক অন্য অভিজ্ঞতা। উনি কেবল শিল্পী নন, বড় মাপের শিক্ষকও ছিলেন।’’
এ দিন সকালে শান্তিনিকেতন থেকে বরোদায় তাঁর স্নেহভাজন স্বপনকুমার ঘোষ টেলিফোন করেছিলেন খবর নেওয়ার জন্য। ফোন ধরেছিলেন শিল্পীর মেয়ে উমাদেবী। স্বপনবাবু বলেন, ‘‘উমা মানিদাকে ফোন দিতেই উনি শান্তিনিকেতনের খবর নিলেন। খুবই অল্প কথা, কিন্তু কত আন্তরিক। ফোন রাখার আগে বললেন, ‘ঠিক আছে স্বপন। ভালো থেকো। বাই, বাই। ফোনটা কেটে গেল। খারাপ খবর তারপরে পরেই এল!’’
শেষবার শান্তিনিকেতনে এসে বলেছিলেন, ‘‘আর হয়তো আসা হবে না!’’ এ দিন সন্ধেয় কলাভবনের স্মরণসভায় সেই কথাগুলোই ঘুরছিল। কেমন করে যেন শিল্পীর শেষ কথাগুলোই সত্যি হয়ে গেল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy