Advertisement
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
ভবঘুরের প্রাণ যায়, শাসক-ঘনিষ্ঠ জামিন পায়

বেপরোয়া গাড়িচালককে বাঁচাতে পুলিশের লুকোচুরি

দক্ষিণ কলকাতার বিজন সেতুতে গাড়ির ধাক্কায় এক ফুটপাথবাসীর মৃত্যু হয় বৃহস্পতিবার রাত ২টোয়। হাসপাতাল সূত্রের দাবি। অথচ তার ১২ ঘণ্টা পরে, শুক্রবার ঘাতক গাড়ির চালককে আদালতে তুলে খুনের চেষ্টার কোনও অভিযোগই দিল না পুলিশ। ফলে জামিন পেতে সমস্যা হয়নি তাঁর। পুলিশের যুক্তি, অভিযুক্তকে আদালতে তোলার পরে হাসপাতালে আহতের মৃত্যুর কথা জানা যায়।

বিজন সেতুর উপরে লাল রঙে চিহ্নিত এই জায়গাতেই ভবঘুরেকে ধাক্কা মারে গাড়ি। (ইনসেটে) কণিষ্ক মজুমদারের গাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

বিজন সেতুর উপরে লাল রঙে চিহ্নিত এই জায়গাতেই ভবঘুরেকে ধাক্কা মারে গাড়ি। (ইনসেটে) কণিষ্ক মজুমদারের গাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:১৪
Share: Save:

দক্ষিণ কলকাতার বিজন সেতুতে গাড়ির ধাক্কায় এক ফুটপাথবাসীর মৃত্যু হয় বৃহস্পতিবার রাত ২টোয়। হাসপাতাল সূত্রের দাবি।

অথচ তার ১২ ঘণ্টা পরে, শুক্রবার ঘাতক গাড়ির চালককে আদালতে তুলে খুনের চেষ্টার কোনও অভিযোগই দিল না পুলিশ। ফলে জামিন পেতে সমস্যা হয়নি তাঁর। পুলিশের যুক্তি, অভিযুক্তকে আদালতে তোলার পরে হাসপাতালে আহতের মৃত্যুর কথা জানা যায়। তাই অনিচ্ছাকৃত ভাবে মৃত্যু ঘটানোর জামিন-অযোগ্য ধারা দেওয়া যায়নি।

হাসপাতালে আহতের মৃত্যু তো হয়েছে বৃহস্পতিবার রাত ২টোয়। পুলিশ শুক্রবার বেলা ২টো পর্যন্ত তা জানতে পারল না কেন? পুলিশের তথ্য সংগ্রহের অবস্থা কি এত খারাপ?

লালবাজারের কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। পুলিশ ঠিক করেছে আজ, শনিবার অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বেপরোয়া বা অবহেলাপূর্ণ কাজের জেরে মৃত্যু ঘটানোর (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪এ) ধারা যোগ করা হবে। ওই ধারাটিও জামিন-অযোগ্য।

রেড রোডে বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় এক জওয়ানের মৃত্যু ঘটানোর জন্য তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ এক ব্যবসায়ীর ছেলে সাম্বিয়া সোহরাবের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে। কিন্তু বিজন সেতুতে বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় ফুটপাথবাসীর মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্তকে এই ছাড় কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে আইনজীবীদের মধ্যে।

ওই অভিযুক্ত কি সাম্বিয়ার থেকে বেশি প্রভাবশালী? পুলিশ তাঁকে কোর্টে তোলার আগে ভবঘুরের মৃত্যুর খবর চেপে গেল কেন? অভিযুক্ত কণিষ্ক মজুমদার আসলে কে?

পুলিশি সূত্রের খবর, কণিষ্ক যে-গাড়িটি চালাচ্ছিলেন, তার ড্যাশবোর্ড থেকে তৃণমূল এবং টিএমসিপি-র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের গোটা কুড়ি বিশাল ব্যাজ পাওয়া গিয়েছে। আলিপুর আদালতে কণিষ্কের যে-সব বন্ধুবান্ধব উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের দাবি, ওই যুবক টিএমসিপি-র অন্যতম সাধারণ সম্পাদক। টিএমসিপি নেতৃত্ব এমন দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ের পাশে বিভিন্ন সময়ে কণিষ্ককে দেখা গিয়েছে। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও তাঁর ছবি আছে। তৃণমূলের বিভিন্ন বড় বড় অনুষ্ঠানেও তাঁকে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিতে দেখা যেত।

কণিষ্কের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের কথা অস্বীকার করেননি বৈশ্বানর। আর মেয়র শোভনবাবুর দাবি, ‘‘কণিষ্ক মজুমদার দলের লোক হতে পারে। তবে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়।’’

বৃহস্পতিবার রাতে কী ঘটেছিল?

পুলিশ জানায়, বিজন সেতু থেকে নেমে গড়িয়াহাটের দিকে কিছুটা এগিয়ে পিছন থেকে কণিষ্কের স্করপিও ধাক্কা মারে একটি লাক্সারি ট্যাক্সিকে। ফার্ন রোডের মোড়ে তিনি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গার্ডরেলে ধাক্কা মারেন। তার পরে ধাক্কা মারেন বাঁ দিকের ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটি হলুদ ট্যাক্সি এবং এক ভবঘুরেকে। ছিটকে পড়েন ওই ভবঘুরে। তাঁর মাথায় ও কানে গুরুতর আঘাত লাগে। ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান তিনি।

লাক্সারি ট্যাক্সির চালক উমেশকুমার যাদব পুলিশকে জানান, ধাক্কায় তিনি জ্ঞান হারান। পরে জানতে পারেন, তাঁর গাড়িকে ধাক্কা মেরেছিল কালো স্করপিওটিই।

পুলিশের খবর, দুর্ঘটনা ঘটিয়ে কণিষ্ক সোজা গড়িয়াহাটের দিকে পালান। জনতা তাড়া করছে এবং একটি লাল বাতির গাড়ি পিছু নিয়েছে দেখে তিনি স্করপিও থামিয়ে নেমে যান। চালকের আসনে বসেন তাঁর সঙ্গী। পিছনে তখন ধাবমান জনতার চিৎকার চলছে, ‘ওই কালো গাড়িই ধাক্কা মেরেছে।’ শুনেই জোরে গাড়ি ঘুরিয়ে বিজন সেতু পেরিয়ে কসবার দিকে যেতে থাকেন কণিষ্কের সঙ্গী।

দুর্ঘটনাস্থলের খুব কাছেই ছিল পুলিশের একটি কিয়ক্স। সেখানকার কর্মীরা কিন্তু তাড়া করে স্করপিওটিকে ধরার চেষ্টা করেননি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একটি লাল বাতি লাগানো গাড়ি প্রায় এক কিলোমিটার ধাওয়া করে ঘাতক গাড়িটিকে ধরে। লাল বাতির গাড়িতে ছিলেন ঝাড়খণ্ডের আইপিএস এস কে সূর্যবংশী।

ওই আইপিএস অফিসার বলেন, ‘‘কিছু পরে এক যুবক এসে নিজেকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নেতা বলে পরিচয় দিয়ে কেন আমি তাঁর গাড়ি আটকালাম, সেই প্রশ্ন তুলে চোটপাট শুরু করে দেন। আমি লালবাজারে ফোন করে বিষয়টি জানাই।’’ পুলিশ এসে যুবকটিকে নিয়ে যায়।

এ দিন দুপুরে পুলিশ কণিষ্ককে আদালতে তোলে। তাঁর বিরুদ্ধে বেপরোয়া গাড়ি চালানো, কাউকে গুরুতর আহত করার অভিযোগ (ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩৩৭, ৩৩৮ ও ৪২৭ ধারা) দায়ের হয়। প্রতিটি অভিযোগই জামিনযোগ্য। আদালত তাঁকে জামিন দেয়। পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত ভাবে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ দেয়নি কেন?

তদন্তকারীরা জানান, অভিযুক্তকে আদালতে তোলার পরে মৃত্যু হয়েছে আহতের। ভবঘুরের মৃত্যুর খবর জানার পরে কী করেছে পুলিশ?

যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘কণিষ্কের বিরুদ্ধে বেপরোয়া বা অবহেলাপূর্ণ কাজের জন্য মৃত্যুর (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০৪এ) অভিযোগও যুক্ত করার আর্জি জানানো হবে আদালতে।’’

ভবঘুরের মৃত্যু ঠিক কখন হয়েছে?

‘‘বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ৩৪ মিনিটে ওই ভবঘুরেকে ভর্তি করানো হয়। রাত ২টোয় তিনি মারা যান,’’ বললেন ন্যাশনাল মেডিক্যালের সুপার পীতবরণ চক্রবর্তী। তা হলে কি তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ওই যুবককে বাঁচাতেই পুলিশ আদালতে তথ্য গোপন করেছিল? প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE