বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক কাঠামো ভাঙতে এবং দেশের সামরিক নিরাপত্তা ধ্বংস করতেই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআর (বাংলাদেশ রাইফেলস)-এর জওয়ানেরা বিদ্রোহ ঘটিয়েছিল বলে সোমবার জানালো বাংলাদেশের হাইকোর্ট। স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রেই পিলখানা ব্যারাকে এই বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল বলে বিচারপতিরা মন্তব্য করেছেন। এই মামলার নিম্ন আদালতের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির রায়ে ১৩৯ জন আসামিকে এ দিন ফাঁসির আদেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ১৮৫ জনের যাবজ্জীবন ও ২২৮ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। বিদ্রোহে অংশ নেওয়ার প্রমাণ না-মেলায় খালাস পেয়েছেন ২৮৮ জন। অভিযুক্ত ৮৪৬ জনের মধ্যে বাকি ছয় জনের ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে।
আসামির সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম এই ফৈজদারী মামলার মূল রায়টি প্রায় ১০ হাজার পাতার। তার মধ্যে পর্যবেক্ষণ ও সাজার অংশের এক হাজার পাতার রায়টি বিচারপতিরা পড়া শুরু করেছিলেন রবিবার। সোমবার পড়া হয় সাজার অংশটি। কোনও সাজার রায় যেমন দু’দিন ধরে পড়াটা নজিরবিহীন ঘটনা, তেমনই একটি মামলায় এত জনের এক সঙ্গে প্রাণদণ্ডের ঘটনাও বাংলাদেশে এই প্রথম।
এর আগে পিলখানার বাইরের বিডিআর বিদ্রোহের ৫৭টি মামলায় বাহিনীর নিজস্ব আদালতে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার জওয়ানকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। পিলখানার মামলাটি আলাদা ভাবে বিচার করা হয় ঢাকার জজ আদালতে। ২০১৩ সালে এই মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। খালাস দেওয়া ২৭৮ জনের মধ্যে ৬৯ জনের বিষয়ে হাইকোর্টে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। তাঁদের ৩১ জনকে এ দিন যাবজ্জীবন ও ৪ জনকে ৭ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে হাইকোর্ট।
শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যেই ২০০৯-এর ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানা বিডিআর ব্যারাকে এই বিদ্রোহ হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্রও। পিলখানায় সাধারণ জওয়ানেরা ৭৪ জনকে হত্যা করে, যার মধ্যে ৫৭ জনই বিডিআর-এর দায়িত্ব পালন করা সিনিয়ার সেনা-অফিসার। অফিসারদের মেসে লুটপাটও করে জওয়ানেরা। এই বিদ্রোহের নেতা হিসাবে উঠে আসে উপ-সহকারী পরিচালক তৌহিদুল আলমের নাম। তাঁকেও এ দিন মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
দায়িত্বশীল সামরিক অফিসারেরা জওয়ানদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের কথা শুনতে পিলখানা বিডিআর ব্যারাকে সাধারণ সভা ডেকেছিলেন। কিন্তু সকাল ন’টায় সভা শুরুর পরেই জওয়ানেরা অফিসারদের লক্ষ করে গুলি ছুড়তে শুরু করে। অফিসারদের হত্যা করে ব্যারাকের দখল নেয় জওয়ানেরা। শুরু হয় অফিসারদের খুঁজে খুঁজে নির্যাতন করে হত্যা করা। তাঁদের মেসে ঢুকে পরিজনদেরও হত্যা করা হয়।
পর দিন সরকারের পক্ষে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গির কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম ও সাংসদ ফজলে নুর তাপস বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও বিদ্রোহীদের কথা হয়। পরে গভীর রাতে পিলখানা ব্যারাকের বাইরে একটি রেস্তরাঁয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে বিদ্রোহের নেতাদের আলোচনায় বরফ গলে। গভীর রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় পৌঁছলে, বিদ্রোহীরা তাঁর হাতে অস্ত্রসমর্পণ করেন। আটকে রাখা কয়েক জন সেনা অফিসার ও তাঁদের পরিবারকেও বার করে আনেন মন্ত্রী।
এর পরে বিডিআর ভেঙে দিয়ে ‘বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ’ (বিজিবি) নামে নতুন বাহিনী গড়ে সরকার। জওয়ানদের ক্ষোভের কথা মাথায় রেখে নতুন বাহিনীতে নিয়মকানুনের বেশ কিছু সংস্কারও করা হয়, এ দিন হাইকোর্টের বিচারপতিরা পর্যবেক্ষণে যার প্রশংসা করেছেন। একই সঙ্গে বিদ্রোহের বিষয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতার দিকটিও তুলে ধরে সমালোচনা করেছে হাইকোর্ট। বাহিনীতে অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে পেশাদারি সম্পর্ক ও অধঃস্তনদের প্রতি নজরে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবরিতন করার কথাও বলেছেন বিচারপতিরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy