আত্মঘাতী: সুইসাইড জ্যাকেটের বোতাম টিপে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়া মহিলা জঙ্গির দেহ। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। নিজস্ব চিত্র।
কাল বিকেল থেকে চলতে থাকা টানাপড়েনে যবনিকাপাত হল আজ বেলা দশটা নাগাদ। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জঙ্গিদের সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর লড়াই শেষ হয়েছে। বিস্ফোরণ ও গুলিতে এক মহিলা-সহ চার জঙ্গিই নিহত। জঙ্গি আস্তনায় বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন এক শিশুর মৃতদেহ পেয়েছে পুলিশ। রাত থেকে পণবন্দি হয়ে থাকা ২০ জনের সবাইকেই জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা গিয়েছে। অভিযানে আহত হয়েছেন সোয়াট (স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিক্স) বাহিনীর দুই সদস্য এবং ফায়ার সার্ভিসের দু’জন। টানা ১৯ ঘন্টা ধরে চলল এই 'অপারেশন অ্যাসল্ট সিক্সটিন'।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের দোতলা বাড়ি ছায়ানীড়ে আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। জঙ্গি আস্তানা রয়েছে খবর পেয়ে গতকাল, বুধবার, বিকেলে বাড়িটি ঘিরে ফেলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, সোয়াট ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সদস্যরা। ভিতর থেকে গুলি চালাতে থাকে সন্দেহভাজনেরা। বাড়ির বেশ কয়েকজন বাসিন্দাকে জঙ্গিরা পণবন্দি করে রাখে বলেও রাতে জানায় পুলিশ। তবে মধ্যরাত থেকে থেমে যায় গুলির শব্দ। রাতে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেনি নিরাপত্তাবাহিনী।
অভিযানের ছবি (ফোকাস বাংলা সৌজন্যে)।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম জানাচ্ছেন, আজ ভোর ৬টা থেকে আবার অভিযান শুরু হয়। এর পর থেকেই পুলিশ বাইরে থেকে গুলিবর্ষণ শুরু করে। একটা সময়ের পর ভিতর থেকে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। এই বিস্ফোরণেই চার জঙ্গি নিহত হয় বলে মনে করছে পুলিশ। সোয়াট এবং দমকলবাহিনীর চার সদস্যও আহত হন। তাঁদের চট্টগ্রাম শহরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
নিহত চারজনের পরিচয় জানা যায়নি। তারা নব্য জেএমবির সদস্য বলে দাবি করেছে পুলিশ। ‘ছায়ানীড়’ নামের দোতলা ওই বাড়ির সিঁড়িতে একতলা ও দোতলার মাঝামাঝি স্থানে যেখানে এক মহিলার দেহ পড়েছিল, তার পাশেই আনুমানিক ছয় বছর বয়সী ওই শিশুর দেহ পাওয়া যায় বলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান জানান। সকালে অভিযানের সময় জঙ্গিরা যখন আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়, তখনই শিশুটির মৃত্যু হয় বলে অনুমান করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাবিবুর রহমান।
আরও পড়ুন: জিয়া হত্যায় ‘র’-এর হাত, অভিযোগ বিএনপি-র
গতকাল জঙ্গি বিরোধী পুলিশি অভিযান শুরু হয়েছিল সীতাকুণ্ডেরই আর এক বাড়ি থেকে। মহাদেবপুরের আমিরাবাদ এলাকায় সুরেশ বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তির দোতলা বাড়িতে অভিযান চালানো হয় প্রথমে। এক মহিলা-সহ দু’জনকে গ্রেনেড, বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও অস্ত্রসহ আটক করা হয়। তাদের জেরা করেই জানা যায় সীতাকুণ্ড কলেজ রোডের প্রেমতলায় ছায়ানীড় বাড়িটির জঙ্গি আস্তানার খবর।
বাড়ির মালিকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই মহাদেবপুরের বাড়িতে গিয়েছিল পুলিশ। সাধন কুঠি নামের ওই বাড়িতে ধৃত দু’জন স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে ভাড়া নেয় মার্চ মাসের গোড়ায়। নিজেকে জসিম উদ্দিন নামে পরিচয় দিয়েছিল পুরুষটি। স্ত্রীর নাম আর্জিনা বলে জানানো হয়। তাঁদের সঙ্গে দু মাস বয়সী শিশুপুত্রও ছিল। সেও গতকাল থেকে পুলিশি হেফাজতেই রয়েছে।
বাড়ির মালিক সুভাষ দাস জানান, গত ৪ মার্চ জসিম তাঁর স্ত্রী ও দুই ‘শ্যালক’কে নিয়ে বাড়ি ভাড়া করতে আসে। ভাড়া নেওয়ার পর জসিমের দুই শ্যালক চলে যায়। জসিমের জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি নেন বাড়িওয়ালা। তবে ভাড়া নেওয়ার পর থেকে বাড়ির দরজা জানালা সব সময় বন্ধ রাখত জসিম। এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে বাড়িওয়ালা সুভাষ দাস ওই পরিচয়পত্র নিয়ে নির্বাচন কমিশনে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, এটা ভুয়ো পরিচয়পত্র। গত মঙ্গলবার রাতে জোর করে তিনি জসিমের ঘরে ঢুকে দেখতে পান, সেখানে প্রচুর তার, সার্কিট। এ সব দিয়ে কী করা হয় জানতে চাইলে জসিম উত্তর দেয়, তারা সার্কিট বানানোর কাজ করে। বাড়িওয়ালা সেখান থেকে একটি সার্কিট নিয়ে আসেন। পরে তিনি সেটা পরিচিত এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে দেখান। মিস্ত্রি জানান, এটা টাইমার। এটা জানার পরই কাল সকালে তিনি পুলিশকে খবর দেন।
পুলিশ দাবি করেছে, বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করার সময় তাদের বাধা দেয় জসিম ও আর্জিনা। পুলিশ জোর করে ঢুকলে আর্জিনা তাঁর কোমরে হাত দিতে যায়। সেটা দেখে বাড়িওয়ালা ও তাঁর স্ত্রী ওই মহিলার দুই হাত শক্ত করে ধরে ফেলেন। পরে পুলিশ আর্জিনার কোমর থেকে বোমা উদ্ধার করে।
বুধবার বিকেলে ওই বাড়ি ঘিরে ফেলার পর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টায় সোয়াট ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা ওই বাড়িতে অভিযান শুরু করেন। ওই বাড়ির বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিসি) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ছানোয়ার হোসেন। এর মধ্যে বিস্ফোরকবোঝাই তিনটি সুইসাইড ভেস্ট-সহ দশটি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে।
হাবিবুর রহমান বলেন, “সন্ধ্যা ৬টায় বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের কাজ শেষে ক্রাইম সিন ইউনিট ওই বাড়িতে প্রমাণ সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে। পাঁচজনের লাশের বিভিন্ন অংশ জড়ো করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হচ্ছে। সে সময় তাদের ডিএনএ নমুনাও সংগ্রহ করা হবে।
(নিজস্ব চিত্র)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy