অবাধ এবং স্বচ্ছ ভাবে ভোটের ফলপ্রকাশের দাবিতে বিক্ষোভ পিটিআই সমর্থকদের। ছবি: পিটিআই।
ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হয়েছিল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায়। প্রায় ৬০ ঘণ্টা পরে রবিবার দুপুরে পাকিস্তানে ভোটগণনা শেষ হওয়ার কথা জানাল সে দেশের নির্বাচন কমিশন। ভোটগণনা শেষ হলেও কে বা কারা পাকিস্তানের পরবর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে চলেছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৬৪টি আসনে গণনা শেষ হয়ে গেলেও কোনও দলই একক ভাবে ‘জাদুসংখ্যা’ ছুঁতে পারেনি। ত্রিশঙ্কু ফলাফল হওয়ায় জোট সরকারই ক্ষমতায় আসতে চলছে বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য পাকিস্তানের চারটি প্রাদেশিক নির্বাচনের ভোটগণনা এখনও চলছে। এখনও পর্যন্ত যে প্রাথমিক ফল জানা গিয়েছে, তাতে পঞ্জাব প্রদেশে এগিয়ে রয়েছে নওয়াজের দল। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে এগিয়ে ইমরানের দল। সিন্ধ প্রদেশে নিজেদের গড় ধরে রাখার ইঙ্গিত দিয়েছে বিলাবলের পিপিপি। আর বালুচিস্তান প্রদেশে জোর লড়াই চলছে পিপিপি এবং পিএমএল-এনের মধ্যে।
প্রাথমিক গণনাতেই ইঙ্গিত ছিল যে, লড়াই হতে চলেছে মূলত জেলবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত নির্দল এবং আর এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)-এর মধ্যে। তবে লড়াইয়ে ছিল প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী তথা বেনজির ভুট্টোর পুত্র বিলাবল ভুট্টো জারদারির দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-ও। সে দেশের সংবাদপত্র ‘ডন’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, এখনও পর্যন্ত পিটিআই সমর্থিত নির্দল প্রার্থীরা ৯৩টি, পিএমএল-এন ৭৩টি এবং পিপিপি ৫৪টি আসনে জিতেছে। অন্যেরা পেয়েছে ৩৩টি আসন। অন্য একটি সূত্র বলছে, পিটিআই সমর্থিত নির্দলরা ১০২টি আসনে জয়ের মুখ দেখে ফেলেছেন। তবে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়ার জন্য চাই আরও ৩১টি আসন। যা সম্ভব নয়। কারণ আর গুটিকয়েক আসনে গণনা বাকি আছে।
অন্য দিকে, গণনায় কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রের প্রার্থীরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ৪০টি কেন্দ্রে ইতিমধ্যে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে। আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পুনর্নির্বাচনের দিন স্থির হয়েছে। তবে এই ৪০টি আসন যদি কোনও একটি দলের পক্ষে যায়, তা হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া মুশকিল।
এই আবহে আরও এক বার বিলাবলের পিপিপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গড়ার কথা জানিয়েছেন নওয়াজ। মাঝে শোনা গিয়েছিল বিলাবলের পিতা আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে বৈঠক হয়েছে নওয়াজের। কিন্তু এমন কোনও বৈঠকের কথা তিনি জানেন না বলে দাবি করেছেন বিলাবল নিজেই। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক শিবিরের বড় অংশ মনে করছেন, ইসলামাবাদের কুর্সিতে কে বসবেন, শেষমেশ তা ঠিক করবে পাক সেনাই, আরও স্পষ্ট করে বললে সেনাপ্রধান আসিম মুনির।
শনিবারই একটি বিবৃতিতে মুনির বলেছিলেন, ‘‘নির্বাচন শুধুমাত্র জয়-পরাজয় নির্ধারণের প্রতিযোগিতা নয়, বরং জনমত যাচাইয়ের পরীক্ষা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাঁদের কর্মীদের অবশ্যই ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পরিচালনা এবং জনগণের সেবা করতে হবে। কার্যকরী ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সম্ভবত এটাই একমাত্র পথ।’’ মনে করা হচ্ছে ‘যৌথ প্রচেষ্টা’ বলতে সেনাপ্রধান নওয়াজ-বিলাবল জোট সরকারের দিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গত, ২০২২ সালে আস্থাভোটে ক্ষমতা খোয়ানোর পর পাক সেনার দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন ইমরান। ২০১৮-র নির্বাচনে যে ইমরান সেনার সমর্থন নিয়ে কুর্সিতে বসেছেন বলে গুঞ্জন উঠেছিল, সেই ইমরানের সঙ্গেই সেনার দূরত্ব বাড়ে। ২০২৩-এ পিটিআই কর্মীদের বিরুদ্ধে সেনার একাধিক দফতরে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে। একাধিক মামলায় অভিযুক্ত হয়ে বর্তমানে জেলবন্দি ইমরান।
অন্য দিকে, অতীতে দু’বার সেনার ‘হাতযশে’ ক্ষমতা খোয়ানো নওয়াজই এ বার ‘সেনার বাজি’ বলে জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। আপাত ভাবে মনে করা হয়েছিল, নির্বিঘ্নেই জয় হাসিল করবেন নওয়াজ। কার্যক্ষেত্রে তা হয়নি। বরং দলীয় প্রতীক না পেয়ে নির্দল হয়ে লড়েই চমক দেখান ইমরানের দলের ‘নির্দলেরা’। প্রতীক না পাওয়ার নেপথ্যে যে কারণ, তা হল, পাক নির্বাচন কমিশনের তরফে দাবি করা হয়, ইমরানের দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব রয়েছে। তাই এ বার তাদের দলীয় প্রতীক ‘ক্রিকেট ব্যাট’ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ভোটপর্ব মেটার পর এ বার সে দেশে কে বা কারা কী ভাবে সরকার গঠন করে, সে দিকেই নজর সকলের।