গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
শুক্রবার সকাল থেকেই সকলের নজর ছিল ব্রিটেনের দিকে। সরকারে কি পালাবদল ঘটবে না কি ফের মসনদে ফিরবে কনজ়ারভেটিভ পার্টি (টোরি)? সেই প্রশ্নই ঘুরছিল। সময় যত এগিয়েছে, পালাবদলের দিকেই পাল্লা ভারী হয়েছে। ১৪ বছর পর আবারও ব্রিটেনের মসনদে ফিরল লেবার পার্টি। শুধু জিতল নয়, ৪০০-এর বেশি আসন পেল তারা। ২০০১ সালের পর কোনও দল ৪০০-র গণ্ডি পেরোল ব্রিটেনে।
১৯৪৫ সালের পর এই প্রথম বার জুলাই মাসে ভোট হল ব্রিটেনে। এ বারের নির্বাচনে মোট ৪৫১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় (ভারতে দুপুর সাড়ে ১২টা) শুরু হয়েছে ভোটগ্রহণ। চলেছে রাত ১০টা পর্যন্ত। তার পরেই শুরু হয়েছে গণনা। শুক্রবার সকাল থেকেই ভোটের ফল সামনে আসতে থাকে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ৪০০ বেশি আসন জিতে ব্রিটেন জয় করল লেবার পার্টি।
লড়াই ছিল দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল, লেবার পার্টি ও কনজ়ারভেটিভ পার্টির (টোরি) মধ্যে। লেবার পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন কায়ের স্টার্মার আর কনজ়ারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বে সুনক। ভোটপর্ব শুরু থেকেই হাওয়া ছিল পালবদলের পালে। বিভিন্ন জনসমীক্ষা আভাস দিয়েছিল, সুনককে আর প্রধানমন্ত্রী চাইছেন না ব্রিটেনবাসী। ভারতীয় বংশোদ্ভূত সুনকের উপর আস্থা হারিয়েছেন তাঁরা।
২০১৯ সালে ভোটে লেবার পার্টি আশা জাগালেও ব্রিটেনবাসী কনজ়ারভেটিভ পার্টির পক্ষেই রায় দিয়েছিলেন। সে বার কনজ়ারভেটিভ পার্টি পায় ৩৬৫টি আসন। আর লেবার পার্টির ঝুলিতে ছিল ২০৩টি আসন। কনজ়ারভেটিভ পার্টির অনুকূলে তথা ব্রেক্সিটের পক্ষে প্রচারে বিপুল সাড়া মিলেছিল। ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ স্লোগানে ভর করে ব্রিটেন জয় করেছিল তারা। প্রধানমন্ত্রী হন বরিস জনসন। কিন্তু ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাসভবনে আড়াই বছরের বেশি কাটাতে পারেননি তিনি। দলের অন্দরে বিদ্রোহ এবং কোভিডবিধি ভেঙে পানভোজনের আসর বসানোর অভিযোগ মাথায় নিয়ে ২০২২ সালে জুলাই মাসে প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তার পর লিজ় ট্রাসের ৪৯ দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব পর্বের শেষে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন ঋষি।
দু’বছর পর জাতীয় নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয় ঋষিকে। তাঁর শাসনকালে একাধিক বিষয় ঋষির বিপক্ষে ছিল। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা কনজ়ারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ছিল ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভ’। শুধু তা-ই নয়, কনজ়ারভেটিভ সরকারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অর্থনীতি, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং অভিবাসন। ব্রেক্সিট–পরবর্তী সময় থেকে ভঙ্গুর অর্থনীতি, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন সমস্যা-সহ সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনের জনগণ বিরক্ত ছিল ঋষি সুনকের সরকারের বিরুদ্ধে। সেটাই ভোটবাক্সে প্রভাব ফেলল।
লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা এ বারের ভোটে ভাল ফল করল। গত বার তারা মাত্র ১১টি আসন পেয়েছিল। ২০২৪ সালে সেই দলই ৭০-এর বেশি আসন জিতল। এ ছাড়াও নাইজেল ফারাজের নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থী দল রিফর্ম ইউকে-ও নতুন দল হিসাবে ভাল শুরু করল। চারটি আসন তারা জেতে। বলাই চলে, কনজ়ারভেটিভদের ভোট কাটতে অন্যতম ভূমিকা নিয়েছে লিবারেল।
ঋষির স্থলাভিষিক্ত হলেন স্টার্মার। ভোটের ফল স্পষ্ট হতেই সুনক অভিনন্দন জানান তাঁর উত্তরসূরি হতে যাওয়া স্টার্মারকে। এর পরে প্রথা মেনে বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লসকে ভোটের ফলাফল জানিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেন সুনক। এর পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে বিদায়ী বক্তৃতা করেন তিনি। পূর্ণাঙ্গ ফলপ্রকাশের আগেই পরাজয় স্বীকার করে নেন ঋষি। দলের সমর্থকদের উদ্দেশে সুনক বলেন, “লেবার পার্টি সাধারণ নির্বাচনে জিতেছে। আমি কিয়ের স্টার্মারকে ফোন করে এই জয়ের জন্য শুভেচ্ছা জানিয়েছি। আজই শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।” একই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, “আমি দুঃখিত। আমি এই পরাজয়ের দায় স্বীকার করছি।”
অন্য দিকে, বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে দেখা করে আসেন স্টার্মার। সরকার গড়ার ব্যাপারে কথা বলেন তিনি। এর পর ডাউনিং স্ট্রিটের সেই ‘১০’ লেখা কালো দরজার সামনে বক্তৃতা করেন তিনি। পেশায় আইনজীবী লেবার নেতা বলেন, ‘‘আজ থেকেই পরিবর্তনের পালা শুরু হল দেশে।’’
সরকার গড়লেও স্টার্মারের আগামী দিন সুগম হবে না বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ। তাঁদের মতে, দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করাই এখন লেবারদের প্রধান কাজ। ব্রিটেনে শিশুদের মধ্যে দারিদ্র এখন চরমে। ফুড ব্যাঙ্কগুলির উপরে নির্ভরশীলতা ক্রমশ বাড়ছে। এনএইচএসের পরিষেবাও ব্রিটেনের ভোটে বরাবরের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর আয়করের কাঁটা তো আছেই।