এক পক্ষের হুঁশিয়ারি, ৭৫ বছরে দখলদারি এবং ভয়ঙ্কর ইজ়রায়েলি আগ্রাসনের প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
আর এক পক্ষের হুঙ্কার, হামলাকারীরা পার পাবে না। চরম মূল্য দিতে হবে তাদের।
যুযুধান ইজ়রায়েল এবং প্যালেস্টাইনের হুঁশিয়ারি-পাল্টা হুঁশিয়ারি থেকে স্পষ্ট দেওয়াল লিখন, পশ্চিম এশিয়ায় এক রক্তক্ষয়ী দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত শুরু হয়েছে। যার বলি হাজারের বেশি।
ইজ়রায়েল বাহিনীকে হতচকিত করে গত কাল সে দেশে ঢুকে পড়েছিল প্যালেস্টাইনের হয়ে অস্ত্র ধরা হামাস বাহিনী। তার পর থেকে যে লড়াই শুরু হয়েছে, তাতে ঝড়ের গতিতে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। আজ রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। ইজ়রায়েলে নিহত হয়েছেন ৭০০-র বেশি মানুষ। ইজ়রায়েলের পাল্টা আক্রমণ প্যালেস্টাইনের ৪০০-র বেশি মানুষের প্রাণ কেড়েছে। উভয় পক্ষই বন্দি করেছে শত্রু পক্ষের সেনা-নাগরিককে। এই পরিস্থিতিতে সংঘাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভিডিয়ো। যা কিনা উভয় পক্ষের উগ্র জাতীয়তাবাদে ইন্ধন জোগানোর পক্ষে যথেষ্ট। এই পরিস্থিতিতে প্রত্যাশিত ভাবেই ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে আমেরিকার জানিয়ে দিয়েছে, প্রয়োজনে তেল আভিভকে যাবতীয় সামরিক সহায়তা করা হবে। পাশে দাঁড়িয়েছে ব্রিটেনও। তেল আভিভের যাবতীয় উড়ান আগামী ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত বাতিল করেছে এয়ার ইন্ডিয়া।
ইজ়রায়েলের দক্ষিণ অংশে বিভিন্ন জায়গায় আজও ইজ়রায়েল সেনাবাহিনীর সঙ্গে হামাসের তীব্র লড়াই চলেছে। ইজ়রায়েলের একটি সংবাদমাধ্যম দাবি করেছে, সে দেশের সেনাবাহিনী দক্ষিণাংশের অনেকটা জায়গা ইতিমধ্যে দখল করেছে। কিন্তু গাজ়া সীমান্তের কাছে এখনও তীব্র লড়াই চলছে। সেখানের পরিস্থিতি যে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে ইজ়রায়েলের সামরিক তৎপরতায়। ইজ়রায়েল সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিলেন হাগারি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে ওর হানের, নির এম, কারমিয়া, জ়াকিম-সহ গাজ়া সীমান্তবর্তী সব শহর থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই সব এলাকা থেকে সব অসামরিক ব্যক্তিকে সরিয়ে ফেলা হবে। সীমান্ত এলাকায় আমাদের অন্তত ১০ হাজার সেনা রয়েছে। ওই এলাকায় থাকা প্রতিটি হামাস জঙ্গিকে খুঁজে বার করে হত্যা করা হবে।’’ আজ, ডজনখানেক ইজ়রায়েলি যুদ্ধবিমান গাজ়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
সংঘাতে ইজ়রায়েলের প্রাণহানির সংখ্যা অনেকটাই বেশি। সে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি জানাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত ৭০০-র বেশি ইজ়রায়েলি প্রাণ হারিয়েছেন। তার মধ্যে ৪৪ জন সেনা রয়েছেন। তাঁদের পরিচয় প্রকাশ করেছে ইজ়রায়েল সেনাবাহিনী।
গত কালকে দেশের ‘কালো দিন’ আখ্যা দিয়ে আজ ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘‘কোনও অপারেশন বা সাময়িক অভিযান নয়, ইজ়রায়েল পুরোপুরি যুদ্ধে রয়েছে। অতর্কিতে হামাস যে প্রাণঘাতী হামলা ইজ়রায়েল এবং তার নাগরিকদের উপরে চালিয়েছে, তার যোগ্য জবাব দেওয়া হবে। সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অনুপ্রবেশকারীদের অবিলম্বে তাড়াতে হবে।’’ গাজ়ায় হামাসের ঘাঁটি খুঁজে বার করে তাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন নেতানিয়াহু। তাঁর কথায়, ‘‘শত্রুদের চরম মূল্য দিতে হবে।’’ গাজ়ার বাস্তবতাকেই বদলে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্ত-ও। আজ এক ভিডিয়ো বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন শয়তানের মুখ দেখতে পেয়েছি। হামাস নির্বিচারে আমাদের উপরে জঘন্য অপরাধমূলক হামলা চালিয়েছে। আমরা গাজ়া স্ট্রিপের বাস্তবতাই বদলে দেব।’’
আজ দুপুরের দিকে বায়ুসেনার শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেখানে বায়ুসেনা প্রধান টোমের বার, সামরিক সচিব অভি গিলের মতো প্রথমসারির অফিসারেরা। ওই বৈঠকেই গাজ়ায় বিমান হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়েছে। নেতানিয়াহুর পৌরহিত্যে আজ বৈঠকে বসে মন্ত্রিসভা। সেখানে হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সেনাবাহিনীকে খোলাখুলি ছাড় দেওয়া হয়েছে।
তৎপরতা জারি রেখেছে হামাসও। হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইজ়রায়েলের যে জায়গা হামাসের দখলে রয়েছে, সেখানে আরও অস্ত্র এবং সেনা সমাগম বাড়ানো হচ্ছে। হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রথমসারির নেতা নিজ়ার আওদাল্লার ছেলে সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন। যদিও এই সংঘর্ষে প্রথমসারির কোনও নেতা নিহত হননি বা ইজ়রায়েলের হাতে বন্দি হননি। হামাসের তরফে আজ জানানো হয়েছে, ইজ়রায়েল বাহিনীর আক্রমণে গাজ়া ভূখণ্ডে অন্তত ৪১৩ জন প্যালেস্টাইনি প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন দু’জারের বেশি। নিহতদের অধিকাংশই গাজ়া স্ট্রিপের বাসিন্দা। নিহতদের মধ্যে রয়েছে ২০টি শিশুও। প্রাণ হারিয়েছেন এক জন অন্তঃসত্ত্বা-সহ ছ’জন মহিলা। রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সংস্থা জানিয়েছে, ২০ হাজারের বেশি মানুষ রাষ্ট্রপুঞ্জের স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।
এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন ভিডিয়ো। একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, এক তরুণীকে বাইকের পিছনে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে হামাসের সশস্ত্র সদস্যেরা। শোনা যাচ্ছে তরুণীর আর্তচিৎকার, ‘‘আমাকে মেরো না!’’ ২৫ বছর বয়সি নোয়া আরগামানির এই ভিডিয়োয় আঁতকে উঠছেন মানুষ। ভিডিয়োতে দেখা গিয়েছে, তাঁর সঙ্গী আভি নাথানকেও মারধর করা হচ্ছে। ওই তরুণ নিখোঁজ। নোয়া বর্তমানে হামাসের হেফাজতে।
আর একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, হামাসের হাতে বন্দি দুই সন্তানকে নিয়ে মেঝেতে বসে রয়েছেন এক ইজ়রায়েলি দম্পতি। তাঁদের ছোট্ট ছেলেটি হাতে লেগে থাকা রক্ত দেখিয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘‘এটা কার রক্ত?’’ তার আর এক বোন উত্তরে বলছে, ‘‘আমাদের বোনকে ওরা মেরে ফেলেছে। আমি ওর সঙ্গে থাকতে চাই।’’ প্যালেস্টাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, ইজ়রায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র গুঁড়িয়ে যাচ্ছে বিশাল একটি বহুতল। সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আর একটি ভিডিয়োয় দেখা গিয়েছে, ইজ়রায়েলের হাতে ধরা পড়া এক হামাস সদস্যের নগ্ন দেহ মাটিতে পড়ে রয়েছে। তার উপর মূত্রত্যাগ করছে ইজ়রায়েলের এক সেনা।
ইতিমধ্যেই ইজ়রায়েলে নিখোঁজদের হদিশ দেওয়ার দাবি তুলেছেন পরিজন। যে হারে নিহতের সংখ্যা বাড়ছে তাতে অনেকের আশঙ্কা সরকার প্রকৃত তথ্য গোপন করছে। ইজ়রায়েলের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, বহু মানুষ সরকারের কাছে সমাজমাধ্যমে আবেদন জানাচ্ছেন, ‘আমার ছেলেকে খুঁজে দিন।’
সংঘাতের মধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। আজ আমেরিকার বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জানিয়েছেন, তারা পুরোদস্তুর ইজ়রায়েলের পাশে রয়েছে। প্রয়োজনে তাঁরা তেল আভিভকে অস্ত্র সাহায্যও করবে। প্রথম থেকেই প্যালেস্টাইনের পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান। ইরানের সরকারি সংবাদমাধ্যম আজ জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি টেলিফোনে কথা বলেন, হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ মুভমেন্টের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গেসংঘাতের অগ্রগতি নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন রইসি। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেইনির উপদেষ্টা আলি আকবর ভেলায়াতি হামাসের হামলাকে ‘কৌশলগত বিরাট জয়’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
হামাসের হামলার পরে পরিস্থিতি নিয়ে নেতানিয়াহু কথা বলেছেন, ইউক্রেন, ব্রিটেন, জার্মানি, ইটালির রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে। এ দিকে, পশ্চিম এশিয়ার ইসলামিক রাষ্ট্রগুলি ইজ়রায়েল বিদ্বেষ প্রবল আকার নিয়েছে, মিশরে ইজ়রায়েলি পর্যটকদের উপরে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় এক পুলিশকর্মী। সংবাদমাধ্যমের খবর, অন্তত দু’জন ইজ়রায়েলি এবং এক জন মিশরবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ওই পুলিশকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সে ব্যক্তিগত রিভলভার থেকে গুলি চালিয়েছিল।
সংঘাতের জেরে তেল আভিভগামী সব উড়ান আপাতত বন্ধ রেখেছে এয়ার ইন্ডিয়া। সংস্থার মুখপাত্র আজ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘ইজ়রায়েলে যুদ্ধের কারণে আগামী ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত তেল আভিভ থেকে কোনও উড়ান যাতায়াত করবে না। তেল আভিভেও যাবে না কোনও উড়ান। আমাদের যাত্রী এবং বিমানকর্মীদের সুরক্ষার কথা ভেবে এই সিদ্ধান্ত।’’ নেপাল জানিয়েছে, এই সংঘাতে ইজ়রায়েলে তাদের দশ জন নাগরিক মারা গিয়েছেন।