Bangladesh Unrest

আমরা দাসত্ব-অন্ধত্ব গ্রহণ করেছিলাম, ছাত্রছাত্রীরা আমাদের মুক্তি দিয়েছে

আমি আশা করছি, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ছাত্রদের সঙ্গে বসে অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করা হবে। যেখানে ছাত্রদের মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। যে ধরনের সহিংসতা ঘটেছে, তার জন্য অবশ্যই আমরা দুঃখিত। আশা করি, খুব শীঘ্রই সুন্দর বাংলাদেশের মুখ দেখতে পাব।

Advertisement
আজমেরি হক বাঁধন
ঢাকা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ০৭:৪৫
যুব সমাজকে ধন্যবাদ জানালেন আজমেরি হক বাঁধন।

যুব সমাজকে ধন্যবাদ জানালেন আজমেরি হক বাঁধন। ছবি: পিটিআই।

ছাত্র-জনতার যে আন্দোলন সফল হয়েছে, তা সফল হয়েছে একটা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানোর মাধ্যমে। এর পুরো কৃতিত্ব ছাত্রদের। তাদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এটা সম্ভব হয়েছে। রাষ্ট্র যে পরিমাণে মানুষকে হত্যা করেছে, সেখানে পুলিশ, সাংবাদিক, ছোট শিশুরাও আছে। ছাত্রদের যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তার পরে আন্দোলন যে এই জায়গায় পৌঁছেছে, তা বড় সফলতা। এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই ছাত্র-যৌবনকে, যুব সমাজকে।

Advertisement

আমরা যারা দাসত্ব-অন্ধত্ব গ্রহণ করেছিলাম, নিপীড়িত হচ্ছিলাম, তাদের ভিতরের ভয়টা ওরা দূর করে রাস্তায় নামতে সাহায্য করেছে। আমি রাস্তায় ছিলাম ছাত্রদের সঙ্গে, ১ অগস্ট থেকে। তার আগে থেকে রাস্তায় নামতে পারিনি। ওই ‘সাফোকেশন’টা ছিল।

কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যা হয়েছে, তা খুবই অনৈতিক ছিল সরকারের পক্ষ থেকে। রাষ্ট্র যখন সেই আন্দোলনের উপর নির্বিচারে গুলি চালাল, সুস্থ, স্বাভাবিক মন-মানসিকতার মানুষের পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। রাষ্ট্র গুলি চালাচ্ছে, কেউ অধিকার চাইছে বলে! তার পরের দিন যা ঘটল, তা আরও ভয়াবহ। নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে মারা হল। এর মধ্যে শিশু, বাচ্চার মা রয়েছে। আমরা উপলব্ধি করলাম, আমাদের কথা বলার সুযোগ নেই। আমরা যদি তাদের মনমতো না-বলি, তারা আমাদের নির্বিচারে মারতে পারে। প্রথম দিকে এত হত্যার ঘটনা স্বীকার করা হয়নি। সরকার জড় পদার্থ—মেট্রো রেল, বিটিভি ভবন, আরও কাঠামো নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তারা ইন্টারনেট বন্ধ করে দিল, যাতে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারি, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আমাদের অবস্থা তুলে ধরতে না পারি।

প্রথমে বলা হল, সহিংসতার কারণে ইন্টারনেটের ডেটা সেন্টারের ক্ষতি হয়েছে। সেই জন্য ইন্টারনেট বন্ধ হয়েছে। পরে বলল, তারাই ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে সরকার, গণমাধ্যম, সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপরে। কারণ, ১৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয়েছে শোষণ করার জন্য। আর শোষিত মানুষগুলোই রাস্তায় নেমে এসেছে।

আমি রাস্তায় জনগণের সঙ্গে ছিলাম। দেখেছি, ছোট ছোট ছেলেরা হাতে লাঠি নিয়ে নেমেছে। তারা ভাবছে যে, তারা বুক পেতে দেবে। তারা গুলি খাবে কিন্তু তার পরেও এই দেশটাকে স্বৈরাচারমুক্ত করে তবে এখান থেকে যাবে। তাদের ভাইদের যে হত্যা করা হয়েছে, তার বিচার করে তবেই যাবে। পরে অভিভাবকেরা, শিক্ষকবৃন্দ, রিকশাচালক, ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা যোগ দেন। শিল্পীসমাজের কিছুটা অংশ ছাত্রদের সঙ্গে ছিলাম।

ছাত্রছাত্রীরা যা চেয়েছিল, তা ন্যায্য ছিল। ওদের ওই চাওয়ার সাহস আমাদেরও প্রতিবাদের সাহস দিল। কারণ, এত দিন আমাদের মুখ চেপে ধরা হয়েছিল। আমরা কথা বলতে পারতাম না। দাসত্ব গ্রহণ করেছিলাম। সেই দাসত্ব থেকে ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন আমাদের মুক্তি দিয়েছে। আমি সাধুবাদ জানাই ছাত্রদের, যারা আমাদের পথ দেখিয়েছে, এই স্বৈরাচারী অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছে। আশা করি, খুব শীঘ্রই গণতান্ত্রিক, নারীবান্ধব এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব।

আমি যেহেতু রাস্তায় ছিলাম, দেখেছি, ছাত্রদের হাতে অস্ত্র ছিল না। উল্টে পুলিশ তাদের উপরে নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। যে দিন এই ঘটনা ঘটল, তার আগের দিনও নির্বিচারে কয়েকশো মানুষকে মেরে ফেলেছে। তার পরে উল্টে কার্ফু ঘোষণা করে দিল। তখন ছাত্রেরা সিদ্ধান্ত নিল, একটাই দাবি— এই স্বৈরাচারী সরকারের পতন চাই। তার পরের দিনই ‘লং মার্চ’।

আমি মীরপুর সাড়ে ১১তে থাকি। মীরপুর থেকে বনানী হয়ে গিয়েছিলাম গণভবনের দিকে। বনানী পর্যন্ত কিছু উড়ালপুল আছে। এই পর্যন্ত রাস্তায় লক্ষ লক্ষ মানুষ। উড়ালপুল থেকে এয়ারপোর্ট রোডে যখন নামলাম, সেখানেও গণভবনমুখী লক্ষ লক্ষ মানুষ। সমস্ত স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমেছে। স্কুলের একটা মেয়ে আমার হাত ধরে আন্দোলনে গিয়েছে। বলেছে, ‘‘আপা, গুলি খেয়ে মরে যাব, তা-ও এই আন্দোলন সফল করে ছাড়ব।’’ এত সাহস, এত প্রজ্ঞা, এত তুখোড় ছাত্রছাত্রীরা, এদের থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।

আমাদের প্রাক্তন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ‘প্রথম আলো’র রিপোর্ট অনুযায়ী ৫ তারিখ সকাল পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। তিনি বলপ্রয়োগ করতে চেয়েছেন। আর্মিকে বলেছেন গুলি চালাতে। তখনও তিনি ইস্তফা দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁকে যখন পরিবারের মানুষেরা বোঝান, তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন। খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, তিনি তাঁর নেতাকর্মীদের, আত্মীয়স্বজনদের রাস্তায় ফেলে দিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন।

১৫ বছর ধরে শোষণ ও নির্যাতনের আক্রোশ রয়ে গিয়েছে মানুষের ভিতরে। সকলে তো আমার মতো চিন্তা করবে না, যে আমাকে আঘাত করলে আমি তাকে আঘাত করব না। ভিতরের আক্রোশ কিছু মানুষ প্রকাশ করেছেন।

কিছু সাম্প্রদায়িক উগ্র চিন্তার মানুষ এই আন্দোলনকে ঢাল বানিয়ে ‘অ্যাজেন্ডা’ পূরণ করতে চেয়েছে। মঙ্গলবার কোনও ট্র্যাফিক পুলিশ, কোনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করেনি। কোনও সেনা আমাদের নিরাপত্তা দেয়নি। ছাত্ররা মন্দির-মসজিদ, বড় বড় স্থাপনার পাশে দাঁড়িয়ে রক্ষার ব্যবস্থা করেছে। ছোট ছোট দল তৈরি করে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী দলকে প্রতিহত করছে।

আমি আশা করছি, মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ছাত্রদের সঙ্গে বসে অন্তর্বর্তী সরকার তৈরি করা হবে। যেখানে ছাত্রদের মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। যে ধরনের সহিংসতা ঘটেছে, তার জন্য অবশ্যই আমরা দুঃখিত। আশা করি, খুব শীঘ্রই সুন্দর বাংলাদেশের মুখ দেখতে পাব।

প্রাক্তন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু পালিয়েই যাননি, তাঁর সন্তান যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, তা খুবই ন্যক্কারজনক। বঙ্গবন্ধু কারও একার পিতা নন, একটা দলের নেতা নন। বঙ্গবন্ধু আমাদের সকলের। আমরা প্রত্যেক বাঙালি ধারণ করি বঙ্গবন্ধুকে। তিনি জাতির পিতা। মুহাম্মদ ইউনূসের রেফারেন্সে বলতে চাই, আজ যে পরিমাণে তাঁকে অপমানিত হতে হয়েছে, এর দায়ভার তাঁর কন্যাদ্বয়ের। তাঁদের অপকর্ম, শোষণ, স্বৈরাচারী আচরণের জন্য পিতাকে এই ধরনের অপমানের শিকার হতে হয়েছে। প্রচণ্ড ঘৃণা জানাই এ জন্য। কারণ, বঙ্গবন্ধুকে আমরা সবাই বুকে ধারণ করি।

অবশ্যই এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে। কেউ সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নন। আমার ও বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস, যারা বাংলাদেশে জন্মেছে, এই দেশ তাদের সকলের। আমরা সকলে বাংলাদেশি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, আদিবাসী—কেউ আলাদা নই। সবাই এক। এ রকম একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে চাই যেখানে বৈষম্য থাকবে না। ছাত্রদের স্পিরিট যেন কাজে লাগাতে পারি, তারাই আমাদের পথপ্রদর্শক। তাদের সঙ্গে আছি, সঙ্গে থাকব। তাদের শক্তি কাজে লাগাতে পারব, সেই আশা করি।

আমাদের যিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তিনি এমন ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যেখানে তাঁর লোকেরাই রয়ে গিয়েছেন। এটা খুবই সন্দেহজনক কেন সামরিক বাহিনী বা পুলিশ, এই সরকার পালিয়ে যাওয়ার পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে নামেনি। মানুষের মনে সন্দেহ, তাদের অন্য কোনও পরিকল্পনা ছিল কি না। এই ধরনের নাশকতা করে তারা কি দেখাতে চায় যে উনি যখন থাকছেন না, তখন আরও নৈরাজ্য তৈরি হচ্ছে। যদিও সেটা ভেস্তে দিয়েছে আমাদের ছাত্র-জনতা। গণভবনে যে সম্পদ লুট হয়েছে, তাঁরা তা ফেরত দিয়ে যাচ্ছেন। গণভবন, সংসদ ভবন, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করছেন। ট্র্যাফিক কন্ট্রোল করছেন। আর ছেলেমেয়েরা, এলাকার মানুষ পাহারা দিচ্ছে উপাসনালয়গুলো।

(অভিনেত্রী)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement