২০২০ সালে ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে মুজিবুরের। কিন্তু করোনার ধাক্কায় বাংলাদেশে তাঁর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান হচ্ছে এ বছর।
যে হাতে বন্দুক তুলে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ডাকে, সেই হাতেই রং-তুলির খেলায় অজস্র বার ফুটিয়ে তুলেছেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। শাহাবুদ্দিন। প্রবাসী বাঙালি চিত্রকর। কৈশোর থেকেই মুজিবুরের প্রতি দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতাই শাহাবুদ্দিনকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের রণক্ষেত্রে। নেতৃত্ব দিইয়ে নিয়েছিল একটা গোটা সশস্ত্র দলকে। শাহাবুদ্দিন তখন দেশের উদীয়মান চিত্রশিল্পী। ঢাকা অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের ছাত্র। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মূলত মুজিবুরের অনুপ্রেরণাতেই শাহাবুদ্দিন প্যারিসে যান। জীবনের মোড় ঘুরে যায় অন্য দিকে। অজয় রায়ের সম্পাদনায় শাহাবুদ্দিনের এত দিনের সেই মুজিবুর-সংগ্রহ ‘আমার বঙ্গবন্ধু’ নামে দু’মলাটের মধ্যে ধরা পড়ল। অনেকটা কথন। ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ মুজিবকে নিয়ে। সঙ্গে অমূল্য সব শিল্পচিত্র।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শাহাবুদ্দিনের প্রথম দেখা ১৯৭২-এর ২১ জানুয়ারি। সে দিন মুজিবের উপস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন সদলে গিয়েছিলেন অস্ত্র সমর্পণ করতে। সেই প্রথম স্বপ্নের নায়কের সঙ্গে পরিচয়। তার আগে যদিও পারিবারিক একটা সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় মুজিবের সঙ্গেই রাজনীতি করতেন শাহাবুদ্দিনের বাবা। তবে সেই পরিচয় নিয়ে নায়কের কাছে যেতে চাননি। বরং একেবারেই নিজস্ব পরিচিতিতে উদ্ভাসিত হতে চেয়েছিলেন। মুজিবও তাঁকে দ্রুতই ‘তুমি’ থেকে ‘তুই’য়ের স্নেহে বেঁধে ফেলেছিলেন ওই শিল্পীসত্ত্বা এবং দেশপ্রেমের কারণে। শাহাবুদ্দিনের কথায়, ‘‘পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে সদ্য দেশে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধু। আমরা তো পণ করেছিলাম, উনি দেশে না ফেরা পর্যন্ত অস্ত্র সমর্পণ করব না। উনি মুক্তি পেয়ে ফিরলেন বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি। আমার সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণ করতে গিয়ে পরিচয় ২১ তারিখ। সেই শুরু। তার পর আমৃত্যু যোগাযোগ থেকেছে। আমি ১৯৭৪-এ প্যারিস চলে যাই, মূলত ওঁর অনুপ্রেরণাতেই। তার আগে পর্যন্ত ওঁর স্নেহ-সান্নিধ্য পেয়েছি।’’
প্রথম পরিচয়েই জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘কী করো?’’ সদ্য তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন জানিয়েছিলেন, তিনি চারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র। ছবি আঁকেন। অর্ধশতবর্ষ আগের সে দিনের সেই সংলাপ হুবহু মনে আছে এখনও শাহাবুদ্দিনের। প্যারিস থেকে আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘আমি ছবি আঁকি শুনে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিলেন। তার পর বলেন, ‘ছবি আঁকো! আবার যুদ্ধও করো! নেতৃত্বও দিয়েছো! আমার সোনার বাংলা তো গড়ে উঠবেই!’ এখনও কথাগুলো কানে বাজে।’’ শাহাবুদ্দিনের তুলি-রেখায় ধরা পড়া ‘বঙ্গবন্ধু’কে দেখেও গিয়েছিলেন মুজিবুর।
কিশোর শাহাবুদ্দিনের কাছে, এক জন শিল্পীর কাছে কী ভাবে এক জন জননেতা এতটা গুরুত্ব পেলেন? শাহাবুদ্দিনের কথায়, ‘‘ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছিলাম। তবে প্রথমবার গভীর ভাবে তাঁর উপস্থিতি বুঝেছিলাম, ছাত্র আন্দোলনের সময়। ছাত্রাবস্থায় পল্টন ময়দানে শোনা তাঁর বক্তৃতা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলে। এত সহজ ভাষায় বক্তৃতা করতে আমি এর আগে কখনও শুনিনি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আমার কাছে অনেকে জানতে চান, বঙ্গবন্ধুর এত ছবি কেন এঁকেছি? আমার জবাব, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে মাইকেলেঞ্জেলো— প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ব্যক্তির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আমার কাছে সেই ব্যক্তি বঙ্গবন্ধু।’’
‘আমার বঙ্গবন্ধু’ একইসঙ্গে তিনটি ভাষায়, ১৩৪ পাতার এক অনবদ্য উপস্থাপনা। বাংলা এবং ইংরেজিতে লিখেছেন শাহাবুদ্দিন। ফরাসি অনুবাদ তাঁর মেয়ে চর্যা শাহাবুদ্দিনের। বইজোড়া শাহাবুদ্দিনের আঁকা ছবি আর তার সঙ্গে টুকরো টুকরো কথা। রয়েছে বইটির সম্পাদক এবং চিত্রশিল্পী অজয় রায়ের তোলা বেশ কিছু ছবিও।
২০২০ সালে ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে মুজিবুরের। কিন্তু করোনার ধাক্কায় বাংলাদেশে তাঁর জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান হচ্ছে এ বছর। আগামী অক্টোবরে, শাহাবুদ্দিনের এই বইয়ের প্রকাশ সে দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার হাতে হওয়ার কথা, জানিয়েছেন সম্পাদক অজয়। তাঁর কথায়, ‘‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ এবং শিল্পী শাহাবুদ্দিনের শিল্পকর্মের সুচারু মেলবন্ধন ঘটিয়ে প্রকাশিত এই বইটি আমার একটি স্বপ্নপূরণও।’’
ছবি সৌজন্য: অজয় রায়।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।