কাবুলের অনতিদূরেই তালিবানি টহল। ছবি পিটিআই।
আট দিন আগেও ভাবিনি, পরিস্থিতি এমন হবে! তখনও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল, তালিবান যতই দাপাদাপি করুক, দেশটার প্রতিরোধ কিছুতেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে না। তালিবান কোনও অবস্থাতেই ক্ষমতা দখলের কাছাকাছি যেতে পারবে না। আর আজ কাবুলের মাত্র ১১ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর শরনা দখল করে নিল তালিবান বাহিনী।
গত কয়েক দিনেই ছবিটা দ্রুত পাল্টে গেল। দিন চারেক আগে রাতভর বিকট শব্দে অস্থির হয়েছি। কাছেই আমেরিকান দূতাবাস এবং কাবুল বিমানবন্দরে না কি ‘অ্যান্টি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম’ বসানো হচ্ছিল। শনিবার বিকেলে এ লেখা লিখতে বসেও গোলাগুলির আওয়াজ শুনছি। দফায় দফায় তালিবান আরও কতটা কাছাকাছি এল, সংবাদমাধ্যমে সমানে তারই ধারাবিবরণী শুনে চলেছি।
আজ স্থানীয় টিভি চ্যানেল থেকে খবর পেলাম, তালিবান একেবারে কাবুলের দোরগোড়ায়! পূর্ব আফগানিস্তানের পকতীকা প্রদেশের রাজধানী শরনা দখল করে নিয়েছে তারা। গত কয়েক দিন ধরেই উত্তর আফগানিস্তানের মাজ়ার-ই-শরিফ শহরটিতে প্রচণ্ড লড়াই চলছিল। আজ ‘পতন’ হয়েছে মাজ়ারেরও। বুঝতে পারছি, যত এগোচ্ছে, ততই শক্তি সঞ্চয় করছে তালিবান বাহিনী। আফগান সেনাকে যে সব অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছিল আমেরিকা, তার অনেকটাই এখন তালিবানের দখলে।
এমনিতে আমি থাকি সুরক্ষিত গ্রিন জ়োনে। কলকাতায় বাড়ির লোককে রোজ ফোনে জোর গলায় বলি, দিব্যি আছি! কিন্তু কয়েক দিন আগে আমার অফিস-কাম-আস্তানার ঘরের জানলা থেকেই অল্প দূরে ‘মাশরুম স্মোক’ দেখেছি! প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বাড়িতে তখনই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। পরের দিন, ওই জায়গায় আমায় কাজে যেতে হয়েছিল। ধ্বংসস্তূপ দেখে এই বঙ্গতনয় তখন শিউরে উঠেছিল!
পরিস্থিতি যে দ্রুত পাল্টেছে, তা বাজারে গেলেও মালুম হচ্ছে। কাবুল শহরে ডলারের মূল্য শুক্রবারও ৮১ আফগানি (এখানকার মুদ্রা) ছিল। এক দিনে তা এক লাফে ৯৬ আফগানি হয়ে গিয়েছে। একটু আগে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। দেখলাম খুব ভিড়। শুনলাম, একসঙ্গে অনেক লোকজন তাঁদের সঞ্চয় বা মাইনের টাকা তুলে নেওয়ায় ব্যাঙ্ক সঙ্কটে। সবারই তো নিজেদের রোজগারের টাকা উদ্ধার নিয়ে ভয় আছে! এখানে পেট্রলের দাম ভারতের থেকে অনেকটাই কম ছিল। তবে কয়েক দিনেই তা ৩৫ টাকা থেকে দ্বিগুণ হয়ে ৭০ টাকা ছুঁয়েছে। এখানে গম ছাড়া মানুষের জীবন অচল। তিন-চার দিনে তা ২৫ কেজি ১২০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮০০ টাকা হয়ে গিয়েছে।
তবু আমার কাছে যুদ্ধ বলতে গোলাগুলির শব্দ বা চড়া বাজারদর নয়। গত ২৫ মাস আফগানিস্তানে আছি। আমার চেনা কাবুল শহরটা বদলে যাওয়াই যেন ক্ষয়ের সব থেকে বড় চিহ্ন। সাধারণত বাইরে থেকে আসা লোকে এখানে নিজের কর্মস্থলের পরিসর ছেড়ে মেলামেশা করে না। কিন্তু একটু গণ্ডি পেরোলেই অদ্ভুত সহৃদয়তার খোঁজ মেলে! যখনই আমি একজন ভারতীয় বলে পরিচয় দিয়েছি, সেলুনে বলে ‘খ্যায়ের’! মানে— ‘ঠিক আছে দাম দিতে হবে না!’ রুটি কিনতে গিয়েও ঝুলোঝুলি করে দাম দিতে হয়েছে। এমন অভিজ্ঞতা তো ভারতে সচরাচর হয় না।
কাবুলের বিত্তবানদের মহল্লা শেহের-ই-নাও এখন খাঁ-খাঁ করছে। লোকে হয় শহর ছেড়ে গিয়েছে, নয়তো খোলস-বন্দি। লকডাউনকে হার মানায় এই শূন্যতা। আমাদের গ্রিন জ়োনেও এক অবস্থা। কেউ তুরস্ক, কানাডা, দুবাই, আমেরিকায় পাড়ি দিচ্ছেন। বিভিন্ন দূতাবাসকর্মীরা ঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন। ভারতীয়দের সংখ্যাও ক্রমশ তলানিতে ঠেকেছে। বুঝতে পারছি, হয়তো আমাকেও কাবুল ছাড়তে হবে। শহরের এই বদলটাই সব থেকে কষ্ট দিচ্ছে।
তালিবান এক বার কাবুলে ঢুকে পড়লে কী হবে জানি না। অন্যান্য শহরে যেমন পুলিশের দফতর, সংশোধনাগার, প্রশাসনিক ভবন দখল করে নিচ্ছে তারা, কাবুলেও কি তাই করবে? অনেকে বলছেন, কাবুল শহরের খুব কাছে এসে গেলেও তালিবান বাহিনী প্রথমে আমেরিকান সেনাদের কাবুল ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষা করবে। আজই কয়েকশো আমেরিকান সেনা কাবুলে এসে পৌঁছেছেন। কালকের মধ্যে মোট তিন হাজার আমেরিকান সেনার এখানে পৌঁছনোর কথা। তবে তালিবানের সঙ্গে যুদ্ধ করতে নয়, কাবুলে আমেরিকান দূতাবাসের কর্মীদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য তাঁদের। আর যে হাজার দেড়েক আমেরিকান সেনা এখনও আফগান বাহিনীকে সাহায্য করে যাচ্ছেন, তাঁরা এ মাসের মধ্যেই কাবুল ছাড়ছেন। সাংবাদমাধ্যমের দাবি, আমেরিকান সেনারা কাবুল ছাড়ার পরেই আফগান প্রেসিডেন্টকে পদত্যাগের চাপ দিতে পারে তালিবান। তবে তার আগেই প্রেসিডেন্ট আশরফ গনি পদত্যাগ করতে পারেন, এ রকম জল্পনাও শোনা যাচ্ছে।
কাবুলের দুর্গত এলাকায় শিক্ষার প্রসার নিয়ে কাজ করতে আমি দু’বছরে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। এমন মেহমানদারি ভোলার নয়। দেশের ৯৩ শতাংশ লোকের দিনে দু’ডলার রোজগারের ক্ষমতা নেই, কিন্তু নিজের খাবার থালা অতিথির দিকে এগিয়ে দিতে ভাবেন না! যা বুঝেছি, এই মানুষগুলো নতুন কিছু শিখে বাকি দুনিয়ার সমান হতে চায়। আর একটু শান্তি চায়! এত বড় সঙ্কটেও তাই এই মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে তীব্র গ্লানি হচ্ছে।
(লেখক কাবুলে কর্মরত)