বৃহস্পতিবার তৃণমূলের শীর্ষনেত্রী এবং নেতা একই সঙ্গে পৌঁছচ্ছেন মালদহে। —ফাইল চিত্র।
মালদহ জেলার নাম উঠলেই ফজলি আম আর রসকদম্বের কথা মনে পড়ে। আর জেলার রাজনীতির কথা উঠলে দেড় দশক আগে অধুনাপ্রয়াত গনি খান চৌধুরীর কথা। দীর্ঘ সময়ের কংগ্রেস সাংসদ কেন্দ্রের অনেক মন্ত্রক সামলেছিলেন। কিন্তু এখনও তাঁর ‘খ্যাতি’ রেলমন্ত্রী হিসাবেই।
গনি খানের জেলায় কংগ্রেস এখনও বেঁচে রয়েছে গনি পরিবারের দৌলতেই। মালদহ দক্ষিণ লোকসভা থেকে ২০১৯ সালে জিতেছিলেন গনির ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরী (লেবু)। কিন্তু চৌধুরী পরিবারের খাসতালুক সুজাপুর বিধানসভা ছাড়া জেলার কোথাও জিততে পারেনি কংগ্রেস। আবু হাসেমকে এগিয়ে দিয়েছিল পাশের জেলা মুর্শিদাবাদের দুই বিধানসভা আসন ফরাক্কা এবং শমসেরগঞ্জ। বিজেপির শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরীকে হারিয়ে আবু হাসেম জয় পান মাত্র ৮,২২২ ভোটে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস শূন্যে পৌঁছে গিয়েছে। সেই জায়গা দখলের মরিয়া চেষ্টা করছে তৃণমূল। তবে গত দু’টি পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, লোকসভা নির্বাচনে জয় না পেলেও মালদহের মাটি ঘাসফুলের জন্য বেশ ভাল। গত বিধানসভা নির্বাচনেও জেলার এক-তৃতীয়াংশ আসনে জয় পেয়েছে তৃণমূল।
বৃহস্পতিবার সেই জেলায় একসঙ্গে থাকবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী মমতা যাচ্ছেন প্রশাসনিক বৈঠকে। আর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক তাঁর চলতি জনসংযোগ যাত্রার অংশ হিসাবে। বৃহস্পতিবার মালদহে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক। তিনি পৌঁছবেন বুধবারই। সেই একই দিনে দুই দিনাজপুর জেলায় ‘জনসংযোগ যাত্রা’ সেরে মালদহে পৌঁছবেন অভিষেকও। দু’জনের দেখা হবে কি না, বা কোনও যৌথ কর্মসূচি থাকবে কি না, তা এখনও পর্যন্ত তৃণমূল জানায়নি। তবে এটা ঠিক যে, তৃণমূলের কাছে তিনটি কারণে মালদহ জেলা গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফল ধরে রাখা। দ্বিতীয়, আগামী লোকসভা নির্বাচনে জেলায় খাতা খোলা। এবং তৃতীয়, গত বিধানসভা নির্বাচনে জেলায় ভাল ফলের পরেও দলীয় কোন্দলের ক্ষত সারিয়ে তোলা।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে জেলায় তৃণমূলের অগ্রগতি ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৩ সালে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪৯২ আসন জেতা তৃণমূল ২০১৮ সালে পায় ১,১০৯টি। আর পঞ্চায়েতে সমিতির ক্ষেত্রে ৭২টি আসন থেকে বেড়ে হয় ২৫৩। জেলা পরিষদের ফল বলছে, ২০১৩ সালে মাত্র ৬টি আসন জেতা তৃণমূল ২০১৮ সালে জয় পায় ৩০টিতে। মোট ৩৮ আসনের মালদহ জেলা পরিষদে দ্বিতীয় হয় বিজেপি শূন্য থেকে ছ’য়ে পৌঁছে। কংগ্রেস ১৬ থেকে ২ এবং বামফ্রন্ট ১৫ থেকে শূন্যে চলে যায়।
২০১৮ সালে বিজেপির যে উত্থান, সেটাই বড় হয়ে দেখা দেয় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। মালদহ উত্তরে বিজেপির খগেন মুর্মু জয় পান ৮৪,২৮৮ ভোটে। গনি খান পরিবারের সদস্য তথা প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মৌসম নুরকে প্রার্থী করেও তৃণমূল সুবিধা করতে পারেনি। পাশাপাশি, মালদহ দক্ষিণে তৃণমূল চলে যায় তৃতীয় স্থানে। সেই ভোটেই বিজেপি বিধানসভার ফলাফল অনুযায়ী জেলায় মোট ১২টি আসনের মধ্যে ৬টি আসনে এগিয়ে থাকে। কংগ্রেস ২টি এবং তৃণমূল এগিয়ে ছিল ৪টি আসনে। তবে তার দু’বছর পরে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ‘ক্ষত’ অনেকটাই মেরামত করতে পেরেছিল তৃণমূল। জেলার মোট ১২টি আসনের মধ্যে ৮টিতে জয় পায় তারা। ভাল ফলের লক্ষ্য নিয়েও বিজেপি আটকে যায় ৪টি আসনে।
এই পর্যন্ত হিসাব দেখলে বোঝা যায়, তৃণমূলের জমি ‘দুর্বল’ নয় মালদহে। কিন্তু তাদের ভাবাচ্ছে মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি আসনের উপনির্বাচনের ফল। ওই ভোটের ফল রাজ্য রাজনীতিতে অনেক প্রশ্ন তৈরি করেছে। তার মধ্যে একটি হল, সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ কি তৃণমূল থেকে সরে যাচ্ছে? সেটা সত্যি হলে মালদহ নিয়ে তৃণমূলের চিন্তার কারণ রয়েছে। কারণ, গত বিধানসভা নির্বাচনে মালদহে যে সব আসনে তৃণমূল জিতেছে, তার সবক’টিতেই সংখ্যালঘু ভোটের প্রাধান্য রয়েছে। সেই পাঁচটি আসনে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ৭০ শতাংশেরও বেশি।
এর উপর রয়েছে দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। জেলার দুই প্রাক্তন মন্ত্রী কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী এবং সাবিত্রী মিত্রের লড়াই অনেক বার তৃণমূলকে ‘অস্বস্তিতে’ ফেলেছে। নীচু স্তরেও রয়েছে গোষ্ঠীকোন্দল। চলতি বছরের তিনটি ঘটনায় তার প্রমাণ মিলেছে।
গত জানুয়ারি মাসে ইংরেজবাজার থানার কাজিগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের লক্ষ্মীপুর এলাকার তৃণমূল কার্যালয়ে দলেরই আর এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ভাঙচুর এবং গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। ফেব্রুয়ারি মাসে মাদ্রাসা ভোট কেন্দ্র করে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর বিবাদে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে রতুয়া। ছ’টি আসনে আলাদা আলাদা ভাবে প্রার্থী দিয়েছিল শাসকদলেরই দুই শিবির। ভোটগ্রহণের দিন মোটরবাইক ভাঙচুর, বোমাবাজি, এমনকি গুলি চালানোরও অভিযোগ ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। তার পরে ২১ মার্চ মালদার মানিকচক ব্লকের নুরপুর অঞ্চলের তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে বুথের প্রার্থী বাছাই নিয়ে বিবাদ শুরু হয়। বিবাদ থেকে বচসা থেকে হাতাহাতি। আহত হন তিনজন।
ফলে গত বিধানসভা ভোটে তুলনায় ভাল ফল করলেও মালদহ নিয়ে চিন্তা রয়েছে। চিন্তা যেমন রয়েছে নবান্নের, তেমনই রয়েছে ক্যামাক স্ট্রিটেরও। সম্ভবত সে কারণেই বৃহস্পতিবার তৃণমূলের শীর্ষনেত্রী এবং নেতা একই সঙ্গে পৌঁছচ্ছেন মালদহে। নবান্ন দেবে পরিষেবা। ক্যামাক স্ট্রিট দেবে রাজনৈতিক দিশা।