Women Leadership in Politics

বিভিন্ন দলে নানা ‘পাপিয়া’, যুবনেত্রীদের হেনস্থা কার্যত জলভাত, কী মত মহিলা রাজনীতিক, মনোবিদের?

প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, যুবনেত্রীদের সঙ্গে অল্পবয়সি কোনও নেতার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সেই সম্পর্ক কোনও কারণে বিগড়ে গেলেই ‘হেনস্থা’র ঘটনা ঘটছে। কোথাও আবার চাপ দেওয়া বা নিগ্রহের অভিযোগও উঠছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:২৫
রাজপুর-সোনারপুরের তৃণমূল কাউন্সিলর পাপিয়া হালদার।

রাজপুর-সোনারপুরের তৃণমূল কাউন্সিলর পাপিয়া হালদার। —গ্রাফিক সনৎ সিংহ।

রাজনীতিতে কি ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা, আগ্রাসী মনোভাব ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে? শুক্রবার রাজ্যের দুই প্রান্তে ঘটে যাওয়া দু’টি ঘটনার পর সেই প্রশ্নই নতুন করে উঠছে। শুক্রবার দু’টি ঘটনা সামনে এসেছিল। এক, রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর পাপিয়া হালদার অভিযোগ করেন, দলেরই এক যুব নেতা তাঁকে হেনস্থা করছেন। দুই, শুক্রবার সকাল ১১টা নাগাদ জগৎবল্লভপুরের ইসলামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্যা মৌসুমী পাল (৩৩)-এর ঝুলন্ত দেহ মেলে তাঁর ঘর থেকে। মৃতার পরিবারের লোকেদের দাবি, মৌসুমীর প্রেমিক ছিলেন ইসলামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান গৌতম বেরা। ওই তৃণমূল নেতার সঙ্গে মৌসুমীর সম্পর্কের অবনতি হয়। তার জেরেই পঞ্চায়েত সদস্যা আত্মহত্যা করেছেন।

Advertisement

কিন্তু এই ঘটনাকে শুধু তৃণমূল বা বাংলার নিরিখে না দেখে যদি সার্বিক ভাবে দেখা যায়, তা হলে স্পষ্ট হবে, গত কয়েক বছরে রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলেই এই ধরনের ঘটনা প্রায়শই ঘটছে। যুবনেত্রীদের সঙ্গে অল্পবয়সি কোনও নেতার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। সেই সম্পর্ক কোনও কারণে বিগড়ে গেলেই ‘হেনস্থা’র ঘটনা ঘটছে। কোথাও আবার সম্পর্কের জন্য চাপ দেওয়া বা নিগ্রহের অভিযোগও উঠছে। বাংলায় সেই তালিকায়, তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি রয়েছে। আবার ভিন্‌রাজ্যে কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে— বিভিন্ন দলের ক্ষেত্রেই এই ঘটনা ঘটছে। কোথাও দলীয় স্তরে ব্যবস্থা হচ্ছে, কোথাও তা পৌঁছে যাচ্ছে থানা-পুলিশ পর্যন্ত। কোথাও আবার দলীয় স্তরে ব্যবস্থা হচ্ছেও না। প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠছে।

রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পাপিয়া হালদারের অভিযোগ, তাঁকে অনেক দিন ধরেই বিরক্ত করছেন যুব তৃণমূলের নেতা প্রতীক দে। তাঁর অভিযোগ, ‘‘২০২০ সালে করোনা পরবর্তী সময় থেকে প্রতীক এবং আরও কয়েক জন তৃণমূল নেতা অসাধু কাজে যুক্ত হন। এবং আমাকে তাঁদের শিখণ্ডি হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করেন।’’ পাপিয়ার কথায়, ‘‘প্রতীক আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং আমি তা প্রত্যাখ্যান করি। কিন্তু তার পর থেকে উনি আমাকে নানা ভাবে অপদস্থ করতে থাকেন।’’ কাউন্সিলরের অভিযোগ, তাঁর বাড়িতে মত্ত অবস্থায় লোকজন নিয়ে ঢুকে গালাগালি এবং খারাপ ব্যবহার করা হয়। পাপিয়ার অভিযোগ, ক্রমাগত তাঁকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হচ্ছে। প্রতীকের পাল্টা দাবি, তৃণমূল কাউন্সিলর পাপিয়া কলকাতা পুলিশের এক আধিকারিকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘উনি দামি গাড়ি চড়ছেন, উইক এন্ডে (সপ্তাহান্তে) পার্টি করছেন। কিন্তু ওয়ার্ডের কোনও কাজ করছেন না। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দলীয় কর্মী এবং সমর্থকেরা।’’ যুব নেতার অভিযোগ, ‘‘কাউন্সিলর সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে এখন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন।’’

সিপিএমেও এই ধরনের ঘটনা রয়েছে। বছর দেড়েক আগে টালিগঞ্জের এক যুব নেতার কাণ্ডে তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল দলে। এক যুবনেত্রীকে রাস্তায় ফেলে পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। তারও নেপথ্যে ছিল সম্পর্কের টানাপড়েন। সেই যুব নেতাকে সিপিএম সাসপেন্ডও করেছিল। যদিও দলের অনেকে বলেন, শাস্তি কমানোর ক্ষেত্রেও দলের একটি অংশ প্রভাব খাটিয়েছিল। উত্তর ২৪ পরগনার এক শিক্ষক নেতার বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগকারী এক গৃহবধূ। সেখানে আবার কোনও শাস্তি না দিয়ে সেই নেতাকে কমিটির পদে বসানো হয়েছে বলেও দাবি অনেকের।

এই সমস্ত ঘটনাকে কী ভাবে দেখছেন মহিলা রাজনীতিকেরা? বিজেপি বিধায়ক শ্রীরূপা মিত্র চৌধুরী বলেন, ‘‘রাজনৈতিক মূল্যবোধ নিম্ন স্তরে নেমে গিয়েছে। যার আমি তীব্র নিন্দা জানাই। মূল্যবোধের এই অধঃপতনের জন্য আমি লজ্জিত।’’

সিপিএমের মহিলানেত্রী কনীনিকা ঘোষ আবার এই বন্ধনীতে নিজের দলকে রাখতে চাননি। কিন্তু টালিগঞ্জ ও উত্তর ২৪ পরগনার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হলে তাতে ‘হ্যাঁ’ না বললেও তিনি সার্বিক প্রেক্ষাপটে বলেন, ‘‘দেশ এবং রাজ্যের সরকারের পুঁজিবাদী ও উদারনৈতিক অর্থনীতির কারণেই এই অবক্ষয় তৈরি হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি রয়েছে।’’

তৃণমূলের একাধিক নেত্রী আবার এ নিয়ে প্রতিক্রিয়াই দিতে চাননি। তাঁদের বক্তব্য যা বলার দলের মুখপাত্ররাই বলবেন। এই প্রসঙ্গে কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘এটাকে সার্বিক ভাবে দেখলে হবে না। ঘটনা ধরে দেখতে হবে। কে কোথায় দোষী, কোন সম্পর্কে কী হচ্ছে তা বলা মুশকিল।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ভাল আছি, ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো তো এক জন নিরীহ পুরুষেরই লেখা লাইন। ফলে সরলীকরণ করা ঠিক হবে না।’’

একের পর এক ঘটনা যে ঘটছে সে বিষয়ে মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই মানসিকতার মধ্যে আদতে তো রয়েছে এক ধরনের পিতৃতান্ত্রিকতার দমনমূলক মনোভাব। প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, যিনি নিগ্রহ করছেন বা চাপ সৃষ্টি করছেন, তিনি তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানগত ক্ষমতাতেও নারীর থেকে ঊর্ধ্বে রয়েছেন। ফলত, একটা ক্ষমতায়নের ভাষার অপপ্রয়োগের দিকও এখানে উন্মোচিত হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘এটি এমন একটি মনোভাব, যেখানে যিনি নিগ্রহ করছেন তিনি মনে করছেন তাঁর লিঙ্গ পরিচয়গত একটি সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। ক্ষমতার ভাষা প্রয়োগ করে তিনি অন্যের ‘না’কে নস্যাৎ করতে পারেন।’’ অনুত্তমার কথায়, ‘‘অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মতো মহিলারা অনেক বেশি রাজনীতিতে আসছেন। ফলে এখানেও আমরা দখল ও অধিকারের ভাষার প্রয়োগের নিদর্শন দেখতে পাচ্ছি। ব্যক্তি পরিচয়ের বদলে উল্টো দিকের মানুষটির লিঙ্গ পরিচয় দিয়ে তাঁকে আয়ত্তে এনে ফেলার এই যে মানসিকতা, এর পরিবর্তনের জন্য আরও অনেক কর্মশালা, আরও অনেক লিঙ্গ স্পর্শকাতরতার বিষয়ে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।’’

Advertisement
আরও পড়ুন