—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এক জন। সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট এক জন। আর দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ার। খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ টিস্যু, রক্ত, সিমেনের মতো নমুনা সংগ্রহের জন্য ছিলেন না কোনও বিশেষজ্ঞও। রাখা হয়নি কোনও ‘ক্রাইম সিন’ বিশেষজ্ঞকেও। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়াকে খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহ করেছেন কে? সোমবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানিতে উঠেছিল এই প্রশ্ন। উত্তর খুঁজতে গিয়ে এ বার সামনে এল এই তথ্য।
জানা যাচ্ছে, ৯ অগস্ট অর্থাৎ মৃতদেহ উদ্ধারের দিন, কলকাতা পুলিশের মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিটের অফিসার ইনচার্জ তথা রাজ্য ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর বেলগাছিয়ায় রাজ্য ফরেন্সিক ল্যাবেই ছিলেন। অথচ, তিনি ঘটনাস্থলে যাননি। পাঠানো হয়েছিল তাঁর চেয়ে কম পদমর্যাদার দুই কর্মী আর দু’জন সিভিক ভলান্টিয়ারকে। যাঁরা কলকাতা পুলিশেরই সিভিক ভলান্টিয়ার বলে সূত্রের খবর।
এর পরেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, যেখানে স্বয়ং কলকাতার পুলিশ কমিশনার আর জি করের ঘটনাস্থলে পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেখানে ল্যাবেই থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পদমর্যাদার অফিসার গেলেন না কেন? পলাশবরণ মাইতি নামে ওই অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের দাবি, ‘‘সিভিক ভলান্টিয়ারেরা সাহায্য করার জন্য যান। ওঁদের বিশেষ ভূমিকা নেই। অন্য সব কেসেও তো এই ভাবেই চলছে।’’ কিন্তু একটি সরকারি হাসপাতালের ভিতরেই চিকিৎসককে খুন এবং ধর্ষণের মতো ঘটনার সঙ্গে কি অন্য ঘটনাকে এ ভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়? পলাশবরণ যাঁকে পাঠিয়েছিলেন, সেই কর্মী সনৎকুমার সাহার মন্তব্য, ‘‘আমাদের কাছে এটা খুব জলভাতের মতো কেস।’’
অথচ ১৪ অগস্ট রাতে আর জি করে হামলার ঘটনায় বিধাননগর মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিটের প্রধান দেবাশিস সাহা, হাওড়া মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিটের প্রধান চিত্রাক্ষ সরকার, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার তথা বায়োলজিস্ট সন্দীপ ঘোষ, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার সনৎকুমার সাহা-সহ একটি বিশেষ ফরেন্সিক দল পাঠানো হয়েছিল। প্রশ্ন উঠছে, হামলার ঘটনায় এই তৎপরতা খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় দেখা গেল না কেন?
সুপ্রিম কোর্টে শুনানিতে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাও ফরেন্সিক রিপোর্ট হাতে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘নমুনা সংগ্রহ করল কে?’’ এর পর রিপোর্টের কিছু অংশ চিহ্নিত করে বিচারপতিদের দেখতে দিয়ে তিনি এ-ও মন্তব্য করেন, ‘‘সারা শরীরে এত আঘাত, মৃতদেহ অর্ধনগ্ন অবস্থায় পড়ে রইল, এত জন এল-গেল, আর রিপোর্ট এল এই রকম? নমুনা সংগ্রহ করল কে?’’
সূত্রের দাবি, সিভিক ভলান্টিয়ার-সহ চার জনের ওই দল ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর পর মৃতার গায়ের চাদর সরিয়েও দেখেননি। আশপাশে পড়ে থাকা কিছু নমুনা সংগ্রহ করেই কাজ শেষ করেছেন তাঁরা। নমুনা সংগ্রহের কোনও ‘ফরমাল ভিডিয়োগ্রাফি’ও করা হয়নি। অথচ, ভারতীয় ন্যায় সুরক্ষা সংহিতা অনুযায়ী, ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহের গোটা পর্ব ভিডিয়োগ্রাফি করে রাখা নিয়ম। যে ‘চিপ’ বা ‘কার্ডে’ ভিডিয়োগ্রাফির ফুটেজ তোলা হল, সেটাকে ‘সিল’ করে সরাসরি আদালতে পাঠানো হয়। এর পর ওই চিপ বা কার্ড আদালতে বিচারকের সামনেই খুলে দেখার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কী হয়েছে? সূত্রের খবর, ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক পুলিশকর্মীর ফোনেই ভিডিয়ো রেকর্ড করা হয়েছে। পরে যা পাঠানো হয়েছে আদালতে। যা শুনে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের দাবি, এই ধরনের ভিডিয়ো ফুটেজে তো অদল-বদল করার সুযোগ থেকে যায়! কলকাতা পুলিশের মোবাইল ফরেন্সিক ইউনিটের অফিসার ইনচার্জ তথা রাজ্য ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর পলাশবরণের দাবি, ‘‘ভিডিয়োগ্রাফি করার জন্য লোক তো আমাদের নেই। ওটা পুলিশ থেকে দেওয়া হয়। সে দিন ওই সময়ে কেউ আসেননি।’’
এই নমুনা সংগ্রহে প্রশ্ন রয়েছে আরও। ৯ অগস্ট হাসপাতাল থেকে বেরনোর মুখে সনৎকুমার এবং তাঁর দলবল সংবাদমাধ্যমের সামনে বলে যান, তাঁদের মৃতদেহের চাদর সরিয়ে দেখার কথা নয়। যদিও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, চাদর এ ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছিল মৃতদেহের সম্মানরক্ষার্থে। সেই চাদর সরিয়ে না দেখলে কী করে নমুনা সংগ্রহ করা হবে? সনৎকুনার সে দিন এ-ও বলে যান, মৃতদেহে বেশ কিছু ‘কাট মার্ক’ পেয়েছেন তাঁরা। প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কি ‘কাট মার্ক’ ছিল মৃতদেহে? যদি থাকে, তা হলে ময়না তদন্তে তার উল্লেখ নেই কেন? তবে কি কাট মার্কের সঙ্গে ‘বাইট মার্ক’ গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল? সনৎকুমার বুধবার বলেন, ‘‘না না, বাইট মার্কই ছিল।’’ মৃতদেহের চাদর সরিয়ে না দেখার প্রসঙ্গে তিনি এ দিনও মন্তব্য করেন, ‘‘চাদর সরিয়ে দেখিনি আমরা।’’ যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে তা নিয়ে কি সন্তুষ্ট তিনি? সনৎকুমারের দাবি, ‘‘যা পাওয়া গিয়েছে, সবটাই তুলে দেওয়া হয়েছে। সিবিআইকে সবটা বলা হয়েছে। সব তথ্য সিবিআই জেনে নিয়েছে। নতুন করে কিছু বলতে পারব না।’’ যদিও রাজ্য ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির বর্তমান অ্যাডমিনিস্ট্রেটর তথা এডিজি পদমর্যাদার অফিসার কে জয়রামন বললেন, ‘‘ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা শুধু নমুনা সংগ্রহে পুলিশকে সাহায্য করেছেন। এর বেশি কিছু নয়। যা করার পুলিশ করেছে।’’
ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ অজয় গুপ্ত বলছেন, “মৃতদেহ থেকে ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহ করে দেওয়া যদিও মূলত ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের কাজ, কিন্তু ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহ করার সময় চাদর সরিয়ে দেখবই না ভিতরে কী আছে, সেটা ঠিক নয়। চাদরের নীচে মৃতদেহের আশেপাশেও তো বহু গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ থাকতে পারে, যা নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। সেটা না করা কিন্তু কর্তব্যে গাফিলতির সমান।”
প্রশ্ন এ-ও উঠছে, এমন খুন এবং ধর্ষণের ঘটনায় ফরেন্সিক নমুনা সংগ্রহকারীদের তরফে ‘ক্রাইম সিন রিপোর্ট’ জমা করা হয়নি কেন? এ প্রসঙ্গে উঠে আসছে এডিজি তথা রাজ্য ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর জয়রামনের চিঠির প্রসঙ্গ। গত ২২ জুলাইয়ের সেই চিঠিতে লেখা হয়েছে, সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসার আগে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের ভিত্তিতে কোনও মতামত বা রিপোর্ট যেন কোনও ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ না দেন। নমুনা পরীক্ষার রিপোর্টের সঙ্গে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পরে তৈরি হওয়া মতামত মিললে, শুধুমাত্র তখনই ‘ওপিনিয়ন নোট’ দেবেন এক জন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ। চিঠিতে সমস্ত তদন্তকারী অফিসারদের কাছে এ-ও অনুরোধ করা হয়েছে, আবশ্যিক না হলে তাঁরা যেন সব ঘটনাতেই ‘পিও ভিজিট রিপোর্ট’ বা ঘটনাস্থল পরিদর্শন রিপোর্ট না চান। পরিকাঠামোগত ঘাটতির কথা জানিয়ে যাতে সমস্ত ক্ষেত্রেই ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের ঘটনাস্থল পরিদর্শনের অনুরোধ করা না হয়, সে কথাও লেখা হয়েছে ওই চিঠিতে।
এই পরিকাঠামোর অভাবে কি এখন প্রশ্ন উঠছে নমুনা সংগ্রহ নিয়ে? জয়রামন বললেন, ‘‘আমাদের খুব ছোট একটা ইউনিট। সেই নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে। নতুন আইনে সাত বা তার বেশি বছরের সাজার যোগ্য অপরাধের সমস্ত ক্ষেত্রে ফরেন্সিক পরীক্ষা করানোর কথা বলা হয়েছে। প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গে এমন ৭০ হাজার মামলা রুজু হয়। এত মামলায় পাঠানোর মতো আমাদের লোক কোথায়?’’