BJP MP Nishikant Dubey

বাংলা ভাগের দাবি অনেক, কেন্দ্র চাইলেই নতুন রাজ্য বানাতে পারে কি? এ দেশ দেখেছে অনেক ভাঙা-গড়া

বাংলার মুসলিম অধ্যুষিত দুই জেলাকে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ করার দাবি বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন বিতর্ক। কিন্তু কেন্দ্র কি চাইলেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে?

Advertisement
পিনাকপাণি ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৪ ০৮:৫৭
What is the process of evolution of new state and UT in India

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নতুন করে রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত রাজ্য ভাগ বিতর্কে। বাংলা ভেঙে আলাদা রাজ্য গড়ার একাধিক দাবি গত কয়েক দশক ধরে উঠেছে। গোর্খাল্যান্ড থেকে কামতাপুরি আন্দোলন নানা সময়ে উত্তাপও ছড়িয়েছে রাজ্যে। তবে এ বার যা হয়েছে সবই সংসদে। বৃহস্পতিবারই রাজ্যসভায় ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে বাংলার মালদহ এবং মুর্শিদাবাদকে আলাদা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তার সঙ্গে বিহারের তিন জেলা জুড়ে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হোক, এমনটা চান তিনি। তার ঠিক আগের দিন বুধবার বিজেপি সাংসদ নগেন্দ্র রায় (অনন্ত মহারাজ) পৃথক কোচবিহার রাজ্যের দাবি জানিয়েছেন রাজ্যসভায়। সেই দিনই বিতর্কে জড়িয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। তিনি রাজ্য ভাগের কথা না-বললেও উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্ব ভারতের বন্ধনীতে জুড়ে, তার উন্নয়নমূলক কাজের অঙ্গ বানাতে চেয়েছেন। বাংলার শাসকদল তৃণমূল এই সবক’টিকেই বাংলা ভাগের ‘চক্রান্ত’ বলে অভিযোগ তুলেছে।

Advertisement

ভারতে এখন রাজ্যের সংখ্যা ২৮টি আর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আটটি। স্বাধীনতার আগে ভারতকে গোদা ভাবে চার ভাগে (ডিভিশন) রেখে সেগুলির অধীনে মোট ৩১টি রাজ্যে ভেঙেছিল ব্রিটিশরা। ১৯৫০ সালের পরে বদলাতে শুরু করে এই সংখ্যা। অনেক রাজ্যের এখন আর অস্তিত্বই নেই। বিন্ধ্যপ্রদেশ, বিলাসপুর, পূর্ব পঞ্জাব নামে এক সময়ে রাজ্য ছিল। পরে কারও নামবদল হয়েছে, কোনওটি অন্য একটির সঙ্গে মিশেছে। কারও বা সীমানা বদলেছে।

স্বাধীনতার সময়েও দেশের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট এলাকা ছিল বিভিন্ন রাজপরিবারের। মোট সংখ্যাটা ছিল ৫৬৫। এরা একে একে যুক্ত হয় ভারতের সঙ্গে। সেই সময়েই বিভিন্ন রাজ্যের সীমানা বদল হতে শুরু করে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত বাংলার ছোট শহর তথা অতীতের ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ছিল না। ভোটাভুটির মাধ্যমে ঠিক হয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল না-হয়ে পশ্চিমবঙ্গের অঙ্গ হবে ‘ফরাসডাঙা’ চন্দননগর। এর পরে আরও কিছু সংযোজন, বিয়োজন চলতে থাকে। পরে ১৯৫৬ সালে পাশ হয় প্রদেশ পুনর্গঠন আইন। আর তাতেই ভারতে ১৪টি রাজ্য এবং ছ’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হয়। প্রসঙ্গত, সেই সময়ে এখনকার রাজ্য মণিপুর, ত্রিপুরা, হিমাচলপ্রদেশ ছিল কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।

এর পরেও বদল থামেনি। ১৯৬০ সালে বোম্বে রাজ্য ভেঙে জন্ম নেয় মহারাষ্ট্র এবং গুজরাত। ১৯৬৯ সালে মাদ্রাজের নাম বদলে হয় তামিলনাড়ু। পরের বছর রাজ্যের মর্যাদা পায় হিমাচল প্রদেশ। ১৯৭২ সালে জন্ম নেয় উত্তর-পূর্বের মণিপুর, মেঘালয়, ত্রিপুরা। পরের বছরে মাইসোর রাজ্য বদলে হয় কর্নাটক। এর পরেও মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যের মর্যাদা পায়।

পরিবর্তনের ধারা বজায় থাকে ২০০০ সালের পরেও। ২০০০ সালে মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তীসগঢ় এবং উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড এবং বিহারের একটি অংশ ঝাড়খণ্ড নামে আলাদা রাজ্য হয়। তখন দেশে বিজেপি সরকার। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। আর নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে ২৯তম রাজ্য হিসাবে অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে জন্ম হয় তেলেঙ্গানার। আবার ২০১৯ সালে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল হওয়ার সময়ে কমে যায় একটি রাজ্য। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখ আলাদা করে দু’টিকেই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হয়।

দেশে অনেক রাজ্যেই রয়েছে আলাদা হয়ে যাওয়ার আন্দোলন। পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনকে অনেক ক্ষেত্রে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’, এমনকি কখনও কখনও ‘দেশদ্রোহ’ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও, রাজ্য ভাগের প্রস্তাব অসাংবিধানিক নয়। যে উদাহরণ সদ্যই দেখা গেল। গ্রেটার কোচবিহার রাজ্যের দাবিতে আন্দোলনে মদত দেওয়ার অভিযোগে নানা মামলার কারণে এক সময়ে রাজ্য ছেড়ে অসমে আশ্রয় নিতে হয়েছিল অনন্ত মহারাজকে। তিনিই এখন রাজ্যসভার সাংসদ। আর সেই রাজ্যসভাতেই তিনি পুরনো দাবিকে প্রস্তাব আকারে দিয়েছেন। আবার মালদহ, মুর্শিদাবাদ নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন নিশিকান্ত। এই প্রসঙ্গে সংবিধান বিশেষজ্ঞ তথা প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পৃথক রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন হিংসাত্মক হলে সেটা বিচ্ছিন্নতাবাদ। তবে কেউ প্রস্তাব রাখতেই পারেন।’’

রাজ্য ভাগের সিদ্ধান্ত কী ভাবে হয়? অশোক বলেন, ‘‘কেন্দ্র একাই রাজ্যগঠন, রাজ্য ভাগ বা রাজ্যের সীমানা বদল করতে পারে। লোকসভা এবং রাজ্যসভা দুই কক্ষেই পাশ করাতে হবে সেই সংক্রান্ত বিল। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির সম্মতি নেওয়া প্রয়োজন।’’ অন্য দিকে, প্রবীণ কংগ্রেসি রাজনীতিক আব্দুল মান্নানের কথায়, ‘‘এটা প্রশাসনিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে সংসদে বিল পাশ হয়ে গেলে রাজ্য বিধানসভায় বিল আনার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তবে গোলমাল এড়াতে আলোচনার ভিত্তিতেই করা হয়।’’

কেন্দ্রের হাতে অনেকটা ক্ষমতা থাকলেও কেউ দাবি করলেই রাজ্য ভাঙার উদ্যোগ নিতে পারে না সরকার। সাধারণ ভাবে কোনও এলাকার জনবিন্যাস, ভাষা, সংস্কৃতিগত ফারাক বিবেচনা করেই কোনও এলাকাকে আলাদা রাজ্যে ভাঙা বা অন্য রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। আবার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধার জন্যও রাজ্যকে ছোট করার যুক্তি কাজ করে। আর সব যুক্তিরই পাল্টা যুক্তি থাকায় ভারতে রাজ্য ভাগের ইতিহাসের সঙ্গে অনেক আন্দোলনেরও যোগ রয়েছে। সেই সব আন্দোলন অনেক সময়েই হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছে। তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক স্বার্থ। রাজ্য ভাগের দাবি নিয়েই জন্ম হয়েছে অনেক রাজনৈতিক দলের।

এখনও রাজ্য ভাগের কম প্রস্তাব নেই কেন্দ্রের কাছে। বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং উত্তরপ্রদেশের খানিকটা করে অংশ নিয়ে মিথিলা, উত্তরপ্রদেশের অন্য একটি অংশ নিয়ে অওয়াধ গড়ার দাবি অনেক দিনের। গুজরাতের থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় সৌরাষ্ট্র। বাংলায় গোর্খাল্যান্ড, কামতাপুরি, গ্রেটার কোচবিহারের দাবি তো আছেই বিভিন্ন গোষ্ঠীর পক্ষে। সেই সঙ্গে এ বার যুক্ত হল নিশিকান্তের কেন্দ্রীয়শাসিত অঞ্চল গড়ার নতুন প্রস্তাব। যদিও সেই প্রস্তাব কতটা বাস্তবিক তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে।

আরও পড়ুন
Advertisement