Indian pangolin survey in West Bengal

বিপন্ন বনরুইদের বাঁচাতে জঙ্গলমহলে সমীক্ষা বন দফতরের, পরিকল্পনা প্রজনন কর্মসূচিরও

‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জ়ু অথরিটি’র সহায়তায় দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলের পাঁচ জেলায় বনরুইদের সংখ্যা, বিচরণক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস-সহ বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার কাজ চলছে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:২৯
ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন।

ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন। ছবি: পশ্চিমবঙ্গ বন দফতর সূত্রে পাওয়া।

ভারতে সবচেয়ে বেশি চোরাশিকার হওয়া বন্যপ্রাণীদের তালিকায় রয়েছে তাদের নাম। কয়েক দশক আগেও রাঢ়বঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ওদের বসবাস থাকলেও চোরাশিকার আর বাসস্থান ধ্বংসের কারণে তা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বিক্ষিপ্ত কতগুলি বনাঞ্চলে। ‘বিপন্ন’ প্রজাতির সেই ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন (বাংলায় বনরুই, পিপিলিকাভূক, সূর্যমুখী বা বজ্রকীট নামেও যাদের পরিচিতি)-দের সমীক্ষার কাজ রাজ্য বন দফতরের উদ্যোগে বছর কয়েক আগে শুরু হয়েছে। আর তাতে উঠে এসেছে নানা তথ্য।

Advertisement

‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জ়ু অথরিটি’র আর্থিক সহায়তা এবং তত্ত্বাবধানে দক্ষিণবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, বীরভূম এবং পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বনরুইদের সংখ্যা, বিচরণক্ষেত্র, খাদ্যাভ্যাস-সহ বাস্তুতন্ত্র বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষার কাজ করছে হুগলির শ্রীরামপুর কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগ এবং পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের কনজ়ারভেশন বায়োলজি বিভাগ। দুর্গাপুরের বন্যপ্রাণপ্রেমী সংগঠন ‘উইংস’-এর সদস্যেরাও রয়েছেন সহযোগিতায়।

বনরুইয়ের খোঁজে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় ‘বন্দি’ চিতাবাঘ।

বনরুইয়ের খোঁজে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় ‘বন্দি’ চিতাবাঘ। ছবি: পশ্চিমবঙ্গ বন দফতর সূত্রে পাওয়া।

রাজ্য বন দফতরের ‘অ্যাডিশনাল প্রিন্সিপাল চিফ কনজ়ারভেটর অফ ফরেস্ট’ (অতিরিক্ত প্রধান মুখ্য বনপাল) তথা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল জ়ু অথরিটি’র মেম্বার সেক্রেটারি সৌরভ চৌধুরী জানিয়েছেন, দক্ষিণবঙ্গের জঙ্গলমহলের জেলাগুলিতে শাল, সেগুন ও পিয়ালের জঙ্গলে প্যাঙ্গোলিনদের দেখা মেলে। তাদের প্রধান খাদ্য উঁই ও পিঁপড়ে। কিন্তু তাদের নিয়ে তেমন গবেষণা বা সমীক্ষার কাজ হয়নি পশ্চিমবঙ্গে। তাই এই উদ্যোগ। তিনি বলেন, ‘‘এই সমীক্ষার প্রাথমিক লক্ষ্য হল, দক্ষিণবঙ্গে ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিনদের বিচরণক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করা, খাদ্যাভাস, বাসস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং দক্ষিণবঙ্গে তাদের বিচরণক্ষেত্রগুলিতে উপযুক্ত খাদ্য এবং বাসস্থান রয়েছে কি না, তা যাচাই করা।’’

তিনি জানান, পরবর্তী পর্যায়ে সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্যাঙ্গোলিন সংরক্ষণের দিশানির্দেশ স্থির করে সেই মতো পদক্ষেপ করা হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পাবে, জঙ্গলমহলের বাসিন্দা এবং কর্মরত বনকর্মীদের মধ্যে সচেতনতা প্রচার এবং চিড়িয়াখানার ঘেরাটোপে প্যাঙ্গোলিনদের প্রজনন (কনজ়ারভেশন ব্রিডিং) কর্মসূচি। সৌরভের কথায়, ‘‘প্রথম পর্যায়ে বিভিন্ন জঙ্গলে ট্র্যাপ ক্যামেরা বসিয়ে প্যাঙ্গোলিনের উপস্থিতির প্রত্যক্ষ প্রমাণ খোঁজা হচ্ছে। চলছে, বিভিন্ন চিহ্নের সন্ধান করে অপ্রত্যক্ষ প্রমাণ জোগাড়ের কাজ। সেই সঙ্গে জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেও তথ্য সংগ্রহ চলছে। এর পরে সেই তথ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে প্যাঙ্গোলিনের বাসস্থানের জিপিএস ম্যাপ তৈরি হবে। হবে প্রাক্তন তথ্যের পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা।’’ তিনি আরও জানান, ২০২৪-এর মধ্যেই রাজ্যের মুখ্য বন্যপ্রাণ সংরক্ষক (সিডব্লিউএলডব্লিউ)-এর নেতৃত্বাধীন বিশেষজ্ঞ কমিটিক কাছে সমীক্ষার রিপোর্ট পেশ করা হবে। এর পর কমিটির অনুমোদনের ভিত্তিতে শুরু হবে দ্বিতীয় দফার কাজ। রাষ্ট্রপুঞ্জ অনুমোদিত বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন-এর লাল তালিকায় (রেড ডেটা লিস্ট) ‘বিপন্ন’ (এনডেঞ্জারড) শ্রেণির ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন ‘ভারতীয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন’-এর ১ নম্বর তফসিলভুক্ত। অর্থাৎ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বাঘ, সিংহ, হাতি, গন্ডারের মতোই ‘সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত’।

পুরুলিয়ার জঙ্গলে কাঁকর হরিণ।

পুরুলিয়ার জঙ্গলে কাঁকর হরিণ। ছবি: পশ্চিমবঙ্গ বন দফতর সূত্রে পাওয়া।

শ্রীরামপুর কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক সৌমজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দুর্গাপুর সরকারি মহাবিদ্যালয়ের কনজ়ারভেশন বায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক তপোজিৎ ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণে জেলায় জেলায় বনরুই সমীক্ষার কাজটি করছেন বন্যপ্রাণ গবেষক দেবায়ন গায়েন। তিনি বলেন, ‘‘নিশাচর ও লাজুক এই প্রাণীর শরীরের আঁশ থেকে চিনে ‘ওষুধ’ তৈরির প্রচলন রয়েছে। যার ফলে এর চোরাচালান নিয়মিত ঘটনা। বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চ এবং ডব্লিউডব্লিউএফ-ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৮ থেকে ২০২৩ এই পাঁচ বছরে ভারতে প্রায় ১২০০ টিরও বেশি প্যাঙ্গোলিন শিকার বা চোরাচালান করা হয়েছে।’’

দেবায়ন জানান, পৃথিবীতে মোট আট প্রজাতির প্যাঙ্গোলিন পাওয়া যায়। যার মধ্যে দু’টি প্রজাতি ভারতবর্ষে মেলে। একটি ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিন এবং অন্যটি চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন। পশ্চিমবঙ্গে চাইনিজ প্যাঙ্গোলিন পাওয়া যায় উত্তরের কিছু জেলায় এবং ইন্ডিয়ান প্যাঙ্গোলিনের দেখা মেলে দক্ষিণবঙ্গের পশ্চিমের জেলাগুলিতে। গত কয়েক বছরে পুরুলিয়ার কোটশিলা, ঝালদা, রঘুনাথপুর, পাড়া, আরশা, মানবাজার, বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়, পাত্রসায়ের, ছাতনা, পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল, বীরভূমের ইলামবাজারে একাধিক বার উদ্ধার হয়েছে প্যাঙ্গোলিন। উদ্ধারের নিরিখে সবার উপরে পুরুলিয়া যেখানে শেষ ১০ বছরে ২৫টিরও বেশি প্যাঙ্গোলিন উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়, বাঁকুড়ার সুতান ও বিহারিনাথে, ঝাড়গ্রামে বেলপাহাড়ির আশপাশের বনাঞ্চলে বনরুইদের বাসস্থানের খোঁজ মিলেছে বলে জানিয়েছেন দেবায়ন। তিনি বলেন, ‘‘ওই এলাকাগুলিতে তাদের গতিবিধি জানা এবং সংখ্যার আপেক্ষিক চিত্র তুলে ধরার জন্য এই জেলাগুলির বিভিন্ন জায়গায় বনদফতরের সহায়তায় ট্র্যাপ ক্যামেরা বসানোর কাজ চলছে। এই কাজ চলবে ৩ বছর ধরে। সেই সঙ্গে ওই এলাকাগুলির বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। চোরাচালান বিষয়ক তথ্য রাজ্য বন দফতর এবং ‘কেন্দ্রীয় বন্যপ্রাণ অপরাধ দমন ব্যুরো’ (ডব্লিউসিসিবি) সহায়তায় জোগাড় করা হচ্ছে।

ডব্লিউসিসিবির প্রাক্তন পূর্বাঞ্চলীয় ডিরেক্টর অগ্নি মিত্র বলেন, ‘‘চিন এবং তাইওয়ানে প্যাঙ্গোলিনের আঁশ থেকে প্রাচীন পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। যদিও তার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। প্যাঙ্গোলিনের আঁশ প্রধানত বাংলাদেশ, মায়ানমার দিয়ে পাচার করা হয়। দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গেও এই চোরাচালান চক্র শক্তিশালী। আমরা অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে বহু বার প্যাঙ্গোলিনের আঁশ এমনকি, জীবিত প্যাঙ্গোলিন উদ্ধার করেছি।’’

বনরুইয়ের খোঁজে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় হায়নার ছবি।

বনরুইয়ের খোঁজে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় হায়নার ছবি। ছবি: পশ্চিমবঙ্গ বন দফতর সূত্রে পাওয়া।

‘জ়ু অথরিটি’র মেম্বার সেক্রেটারি জানিয়েছেন, চোরাশিকার এবং চোরাচালান রুখতে গ্রামবাসীদের পাশাপাশি জঙ্গলমহলের স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের সচেতন করার জন্য বিভিন্ন গ্রামে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে বনরুই এর সন্ধানে বসানো ট্র্যাপ ক্যামেরায় জঙ্গলমহলে আরও কিছু বন্যপ্রাণ নজরে পড়েছে বলে সমীক্ষক দেবায়ন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘কাঁকর হরিণ (বার্কিং ডিয়ার), হায়না, শজারু, ভাম, গন্ধগোকুল, বনবিড়াল এমনকি, চিতাবাঘেরও ছবি পাওয়া গিয়েছে।’’

তবে বনরুই সংরক্ষণ কর্মসূচির শেষ পর্ব অর্থাৎ ঘেরাটোপে প্যাঙ্গোলিনদের প্রজনন কর্মসূচি (কনজ়ারভেশন ব্রিডিং) এবং মুক্তি প্রকৃতিতে পুনর্বাসনের অধ্যায়টি যথেষ্ট কঠিন বলে জানিয়েছেন সৌরভ। এ ক্ষেত্রে বন্দি অবস্থায় যাতে প্যাঙ্গোলিন শাবকদের উপর তাদের দেখভালকারী মানুষের ‘প্রভাব’ না পড়ে, সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তা না হলে, জালের ঘোরাটোপে জন্মানো শাবকদের বন্য পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু কোথায় হতে পারে প্যাঙ্গোলিনদের প্রজনন কর্মসূচি? বনকর্তার কথায়, ‘‘সাধারণ ভাবে বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক বিচরণক্ষেত্র যে এলাকায়, তার কাছাকাছিই করতে হয়। অতীতে দার্জিলিঙের চিড়িয়াখানায় হিমালয়ের লাল পান্ডার সফল প্রজনন হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পুরুলিয়ার সুরুলিয়া, বর্ধমানের রমনাবাগান এবং ঝাড়গ্রাম চিড়িয়াখানা আমাদের ভাবনায় রয়েছে।’’

Advertisement
আরও পড়ুন