Waterlogged Situation

বৃষ্টি কমলেও দুর্ভোগ কমল না, বাড়ছে প্লাবনের আশঙ্কা, দক্ষিণের ১০ জেলায় ১০ জন সচিবকে পাঠাচ্ছে নবান্ন

প্লাবন-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দলের নেতা-মন্ত্রীদের জেলায় জেলায় প্লাবিত এলাকা পরিদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কথা বলেছেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের সঙ্গেও।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:১২
হুগলি জেলায় প্লাবন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আরও একাধিক জেলায়।

হুগলি জেলায় প্লাবন পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা আরও একাধিক জেলায়। ছবি: সংগৃহীত।

নিম্নচাপের কারণে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলায় প্লাবন-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতির দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুর্যোগ কবলিত এলাকাগুলি পরিদর্শনে যাওয়ার জন্য দলের নেতা-মন্ত্রীদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডের বৃষ্টির কারণে মাইথন ও পাঞ্চেত বাঁধের জল ছেড়েছে ডিভিসি। তাতে প্লাবন-উদ্বেগ আরও বেড়েছে বাংলার।

Advertisement

ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের সঙ্গে ইতিমধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন মমতা। মঙ্গলবার বিকেলে মু‌খ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্লাবন পরিস্থিতির জন্য রাজ্যের ১০ জেলায় ১০ জন সচিবকে পাঠানো হচ্ছে। তিনি বলেন, “ডিভিসির মাইথন, পাঞ্চেত জলাধার ও দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে অত্যধিক জল ছাড়ার কারণে নিম্ন দামোদর উপত্যকায় প্লাবনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর ফলে দক্ষিণবঙ্গের অনেক জেলা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেই কারণে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রধান সচিব ও সচিব পর্যায়ের ১০ জন সিনিয়র আধিকারিককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।”

বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, হাওড়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম বর্ধমান ও পূর্ব বর্ধমানে পাঠানো হচ্ছে সচিবদের। নিচু এলাকা থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরানো, আশ্রয়কেন্দ্রগুলিকে প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে।

পশ্চিম বর্ধমান

মঙ্গলবার সকালে আবারও জল ছেড়েছে ডিভিসি। মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার মিলিয়ে ১ লাখ ৪৯ হাজার কিউসেক জল ছাড়া শুরু হয় মঙ্গলের সকালে। যার জেরে দক্ষিণবঙ্গের প্লাবন পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা। নিম্নচাপের বৃষ্টির কারণে ডিভিসির দু’টি জলাধারে জলের চাপ বেড়েছে। মাইথন ও পাঞ্চেত— দুই জলাধার থেকেই জল ছাড়া হচ্ছে। সোমবার সন্ধ্যা থেকেই মাইথন জলাধার থেকে জল ছাড়া শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার সকালে জল ছাড়ার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে মাইথন থেকে প্রায় ১ লাখ কিউসেক এবং পাঞ্চেত থেকে প্রায় ৪৯ লাখ কিউসেক জল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই দু’টি জলাধার থেকেই জল ছাড়া হলে, তা দামোদর নদ হয়ে পৌঁছয় পশ্চিম বর্ধমানের দামোদর ব্যারেজে। জলের চাপ বাড়তে থাকলে সেখান থেকেও জল ছাড়ার পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

বাঁকুড়া

দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে ছাড়া জলের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি করা হচ্ছে। মঙ্গলবার সন্ধ্যার মধ্যে তা আড়াই লক্ষ কিউসেকের সীমা স্পর্শ করতে পারে বলে আশঙ্কা। দামোদর তীরবর্তী চারটি ব্লকে ইতিমধ্যে সতর্কতা জারি করেছে বাঁকুড়া জেলা প্রশাসন। পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকতে বলা হয়েছে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও। মঙ্গলবার সকালে দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে জল ছাড়ার পরিমাণ ছিল দেড় লক্ষ কিউসেক। বাঁকুড়ার জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে ছাড়া জল এ দিন সন্ধ্যার মধ্যে এসে পৌঁছবে দুর্গাপুর ব্যারেজে। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে মঙ্গলবার সকাল থেকেই নীচু এলাকাগুলিতে মাইকে প্রচার শুরু করেছে প্রশাসন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে একাধিক স্কুল ও কমিউনিটি হল। প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলিকে ত্রাণশিবির হিসেবে ব্যবহার কা হবে। বাঁকুড়ার জেলাশাসক সিয়াদ এন জানিয়েছেন, “মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে সেই জল দুর্গাপুর ব্যারেজে এসে পৌঁছবে। স্বাভাবিক ভাবে ওই পরিমাণ জলই দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে ছাড়া হতে পারে তেমন সতর্কবার্তা আমরা পেয়েছি । সে ক্ষেত্রে বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়র ও ইন্দাসে প্রভাব পড়তে পারে।”

ডিভিসি জল ছাড়ায় উদ্বেগে বাঁকুড়ার চারটি ব্লক।

ডিভিসি জল ছাড়ায় উদ্বেগে বাঁকুড়ার চারটি ব্লক। —নিজস্ব চিত্র।

বীরভূম

মঙ্গলবার থেকে আবহাওয়ার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় জল ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে বীরভূমের বিভিন্ন প্রান্তে। কঙ্কালীতলা মন্দিরে সোমবার কোমরসমান জল উঠে গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতির থেকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে মন্দির চত্বরের পরিস্থিতি। কোপাই নদীর জলও কিছুটা নেমেছে। তবে এখনও উদ্বেগ পুরোপুরি কাটেনি। বীরভূমের ইলামবাজারের শাল নদীর উপর সেতু এখনও জলের তলায়। মঙ্গলবার সকালেই সেই জলমগ্ন সেতু পার হওয়ার সময় অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন দুই বাইক আরোহী। নদীর জলের তোড়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাইক ভেসে যায় নদীর জলে। যদিও দুই বাইক আরোহীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।

সেতুর উপর দিয়ে বইছে জল।

সেতুর উপর দিয়ে বইছে জল। —নিজস্ব চিত্র।

পশ্চিম মেদিনীপুর

সোমবারের থেকে পরিস্থিতি সামান্য উন্নতি হলেও পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, দাসপুরের বিভিন্ন এলাকা এখনও জলমগ্ন। প্লাবন পরিস্থিতির মধ্যেই নেমেছে নৌকা। ডিঙিতে চেপেই যাতায়াত করছেন এলাকাবাসীরা। সোমবারই ঘাটালের প্লাবন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেছেন সাংসদ দেব। দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়েছেন তিনি। প্লাবন পরিস্থিতির মাঝে জেলায় ইতিমধ্যে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। যার নম্বর ০৩২২২-২৭৫৮৯৪, ৮৩৪৮৩৩৮৩৯৩। মেদিনীপুর সদর মহকুমার কন্ট্রোল রুমের নম্বর ০৩২২২-২৭৫৩৩০, খড়্গপুর মহকুমার কন্ট্রোল রুম নম্বর ০৩২২২-২২৫৩৪৫, ঘাটাল মহকুমার কন্ট্রোল রুম নম্বর ০৩২২৫-২৫৫০৪৫,২৫৫১৪৫।

যাতায়াতে ডিঙিই ভরসা পশ্চিম মেদিনীপুরে প্লাবিত এলাকাগুলিতে।

যাতায়াতে ডিঙিই ভরসা পশ্চিম মেদিনীপুরে প্লাবিত এলাকাগুলিতে। —নিজস্ব চিত্র।

হুগলি

মঙ্গলবার থেকে আকাশ কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে। তবে দুর্ভোগ এখনও কমেনি পুরোপুরি। দ্বারকেশ্বরের জল প্রবেশ করেছে আরামবাগ শহরে। পুরসভার বেশ কয়েকটি ওয়ার্ড এখনও জলমগ্ন। বিশেষ করে ২, ১৫ ও ১৮ নং ওয়ার্ডের পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ। আরামবাগ-মেদিনীপুর এবং আরামবাগ-বাঁকুড়া রাজ্য সড়কের উপর থেকে জল অনেকটাই নেমেছে। তবে পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক নয়। বিপদের আশঙ্কায় বেশ কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে দ্বারকেশ্বর নদের বাঁধে। খোলা আকাশের নীচে, ত্রিপল খাটিয়ে কোনও রকমে চলছে রাত্রিবাস। যদিও সরকারের তরফে তাঁদের শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। খানাকুলে রূপনারায়ণ নদীর জল এখনও বিপদসীমার উপরে। খানাকুলের ধান্যগরী ঘুঁটেপাড়াতে দ্বারকেশ্বরের বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। এলাকার মানুষজন বাঁধ মেরামতির চেষ্টা করছেন। রূপনারায়ণ থেকে বিভিন্ন খালবিল দিয়ে জল প্রবেশ করছে খানাকুলের বিভিন্ন গ্রামে। মঙ্গলবার গোঘাটের পাবা এবং হাজিপুরে প্লাবন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া ও মন্ত্রী বেচারাম মান্না।

নদিয়া

বৃষ্টি কিছুটা কমলেও নদিয়ার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী কিছু অঞ্চলে উদ্বেগ এখনও রয়েছে। ভাগীরথীর জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় শান্তিপুরে বেশ কিছু জায়গা নতুন করে ভাঙন দেখা গিয়েছে। নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জের বেশ কিছু এলাকায় জলমগ্ন হয়ে রয়েছে। দুর্গতদের জন্য স্থানীয় ভাবে আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। প্রশাসন সূত্রে খবর, নদিয়ার এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে প্রায় ১৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

মুর্শিদাবাদ

মুর্শিদাবাদে সোমবারের তুলনায় মঙ্গলে কিছুটা উন্নত হয়েছে পরিস্থিতি। তবে ফরাক্কা, লোহাপুর, শমসেরগঞ্জ, প্রতাপপুর-সহ আশপাশের এলাকাগুলিতে ভাগীরথীর ভাঙন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবারও নতুন করে নদীবাঁধ ভাঙতে দেখা গিয়েছে এই এলাকাগুলিতে। মুর্শিদাবাদ জেলায় বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রগুলিতে প্রায় ৩০০ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

উত্তর ২৪ পরগনা

বসিরহাট মহকুমার ইছামতী নদী তীরবর্তী এলাকাগুলিতে গত কয়েক দিন ধরে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছিল এলাকাবাসীদের। নদীবাঁধের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা বাড়ছিল প্রশাসনেরও। তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। যদিও বসিরহাটের স্বরূপনগরের গোবিন্দপুর, তরণীপুর এলাকায় এখনও জল জমে রয়েছে। ইছামতীর জল কানায় কানায় পূর্ণ, ফলে গ্রামের জমা জল নামতে সমস্যা হচ্ছে। হাসনাবাদেও ইছামতী তীরবর্তী বরুণহাট এলাকায় জল জমে রয়েছে। বনগাঁ মহকুমাতেও একাধিক এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে। মঙ্গলবার গাইঘাটার সুটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি নারায়ণ গোস্বামী। পরে রামনগরের একটি স্কুলে চালু করা ত্রাণশিবিরও পরিদর্শন করেন তিনি। ত্রাণশিবির থেকে দুর্গতেরা ঠিকঠাক সাহায্য পাচ্ছেন কি না, সেই খোঁজ নেন নারায়ণ। গাইঘাটা পরিদর্শনের পর তিনি জানিয়েছেন, এলাকার মানুষ খাল সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। দ্রুত কী উপায়ে সমস্যার সমাধান করা যায় সে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখা হবে বলেও আশ্বস্ত করেছেন তিনি।

বসিরহাট মহকুমায় এখনও বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন।

বসিরহাট মহকুমায় এখনও বেশ কিছু এলাকা জলমগ্ন। —নিজস্ব চিত্র।

দক্ষিণ ২৪ পরগনা

আবহাওয়ার উন্নতি হওয়ায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার পরিস্থিতি এখন অনেকটাই উন্নতির দিকে। সোমবার গোসাবার পাখিরালয়ের কাছে নদীবাঁধে ধস নেমেছিল। সেটিও সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যে সব জায়গায় বাঁধ দুর্বল ছিল, সেই জায়গাগুলিতে ইতিমধ্যে মেরামতি ও সংস্কারের কাজ শুরু করেছে ব্লক ও সেচ দফতরের উদ্যোগে।

আরও পড়ুন
Advertisement