Arabul Islam vs Shaukat Mulla

আইনি নোটিস, ক্ষমা না-চাইলে মানহানির মামলা! আরাবুল-শওকতের লড়াই কি এ বার আদালতে যাবে

মঙ্গলবার আরাবুলকে মানহানির আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন শওকত। তাঁর দাবি, আরাবুল প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন, ওই বিধায়কের আত্মীয়দের অনেকেই ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং ভাঙড়ে তোলাবাজি করছেন।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৬:১৬
TMC MLA Shaukat Mulla sends notice of defamation case to Arabul Islam

(বাঁ দিকে) আরাবুল ইসলাম। শওকত মোল্লা (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।

শেষ পর্যন্ত ভাঙড়ের রাজনীতির চালিকাশক্তি কে হবেন? প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলাম না ক্যানিং পূর্বের বর্তমান বিধায়ক শওকত মোল্লা? এমনই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভাঙড়ের রাজনীতিতে। এ বার এই দুই নেতার লড়াই পৌঁছল আইনি গণ্ডিতে। মঙ্গলবার আরাবুলকে মানহানির আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন শওকত। তাঁর দাবি, কয়েক দিন আগে আরাবুল প্রকাশ্য সভায় বলেছিলেন, ওই বিধায়কের আত্মীয়দের অনেকেই ঠিকাদারি কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং ভাঙড়ে ছাতা-কম্বল-শীতবস্ত্র দেওয়ার নাম করে তোলাবাজি করছেন। এই মন্তব্য নিয়েই এ বার আইনি লড়াইয়ের পথে নেমেছেন শওকত। তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করতেই অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন আরাবুল ইসলাম। তাই তাঁকে আইনি চিঠি দিয়েছি। আশা করি জবাব দেবেন। না হলে আইনের পথেই লড়াই হবে।’’

Advertisement

শওকত আরও বলেন, ‘‘শুধু আমি নয়, আমার স্ত্রী, মা, বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ করেছেন আরাবুল ইসলাম। তাঁকে আইনি চিঠি দিয়ে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছি। তিনি তা না করলে, কলকাতা হাই কোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করব।’’ প্রসঙ্গত, ভাঙড়ের রাজনীতিতে আরাবুল বনাম শওকতের দ্বন্দ্ব নতুন বিষয় নয়। বামফ্রন্ট জমানায় শওকত যখন সিপিএমের ক্যানিং-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন, সেই সময় থেকেই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। তখন তৃণমূলের হয়ে ভাঙড়ের ‘গড়’ রক্ষা করতেন একা আরাবুল। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভাঙড় ছিল বসিরহাট লোকসভার অন্তর্গত। সেই ভোটে তৃণমূল প্রার্থী সুজিত বসু ভাঙড় থেকে ৫২ হাজারের বেশি ভোটে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভাঙড় আসনে তৃণমূলের টিকিটে জিতেছিলেন আরাবুল। সেই ভোটে বামফ্রন্টের ২৩৫ আসন জয়ের মধ্যেও ভাঙড়ে আরাবুলের জয় তৃণমূলের কাছে ছিল বড় প্রাপ্তি। সেই থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে আলোচনায় উঠে আসেন আরাবুল। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএম নেতৃত্বের সঙ্গে আরাবুলের গোষ্ঠীর সংঘর্ষের খবর প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে। তৎকালীন বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার ভূমি ও ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার অনুগামীদের সঙ্গে আরাবুলের অনুগামীদের বিবাদ ছিল তখন ভাঙড়ের রাজনীতির নিত্য ঘটনা। বর্তমানে ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক তথা ভাঙড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা শওকত তখন আরাবুলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রেজ্জাকের পাশেই ছিলেন।

২০১১ সালে পরিবর্তনের ভোটে রাজ্যের পালাবদল হলেও, ভাঙড়ে পরাজিত হন আরাবুল। জয়ী হন সিপিএমের বাদল জমাদার। সেই বছরেই তৎকালীন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের হাত ধরে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন শওকত। আর তৃণমূলের রাজনীতিতে পশ্চাদ্‌গমন শুরু হয় আরাবুলের। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হলেও দলে গুরুত্ব হারাতে থাকেন তিনি। এর পরে ২০১৫ সালে দলবিরোধী কার্যকলাপের জেরে ছ’বছরের জন্য তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয় ‘তাজা নেতা’কে। যদিও মাস আটেকের মধ্যেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের তৎকালীন সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জোড়া ধাক্কা খান আরাবুল। যে রেজ্জাকের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান, ভাঙড় বিধানসভায় তাঁকেই প্রার্থী করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ বুজে তা মেনে নেওয়া ছাড়া আরাবুলের উপায় ছিল না। একই সঙ্গে দলের অন্দরে তাঁর ‘প্রবল প্রতিপক্ষ’ শওকতকে ক্যানিং পূর্ব আসন থেকে টিকিট দেয় তৃণমূল। রেজ্জাক-শওকত দু’জনেই জেতেন। আর ভাঙড়ের রাজনীতিতে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকেন আরাবুল। ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত ভোটে জিতে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি হলেও তাঁর আর আগের মতো দাপট ছিল না। কারণ, তত দিনে ভাঙড় তৃণমূলের সাংগঠনিক দায়িত্ব চলে গিয়েছে শওকতের হাতে। বর্তমানে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শওকত দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থাভাজন বলেই পরিচিত।

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এড়াতে স্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে চিকিৎসক রেজাউল করিমকে ভাঙড়ে প্রার্থী করেছিল তৃণমূল। কিন্তু সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি সেখানে জিতে যান। ওই হারে আরাবুলের বিরুদ্ধেই ‘অন্তর্ঘাতের’ অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূলের একাংশ। পরে পঞ্চায়েত ভোটে তাঁকে ‘আহ্বায়ক’ পদ দেওয়া হলেও চাবিকাঠি ছিল শওকতের হাতেই। আর চলতি বছর ৮ ফেব্রুয়ারি তোলাবাজির অভিযোগে ঘটনায় আরাবুলকে গ্রেফতার করে কলকাতা পুলিশ। ৪ জুন লোকসভা ভোট পর্ব শেষ হতেই ভাঙড়-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদ থেকে আরাবুলকে সরিয়ে দেয় তৃণমূল। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার আচমকাই ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজারে জরুরি ভিত্তিতে বৈঠক ডাকেন ক্যানিং পূর্ব তৃণমূল বিধায়ক শওকত। সেই বৈঠকেই দলীয় সিদ্ধান্তের কথা স্থানীয় নেতৃত্বকে জানিয়ে দেওয়া হয়। বৈঠকে শওকত জানিয়ে দেন, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দীর্ঘ দিন না থাকায় কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছে। তাই তাঁর বদলে পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি সোনালি বাছাড়কে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়ে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পদে যোগ দিতে গেলে আরাবুল লক্ষ করেন তাঁর জন্য বরাদ্দ ঘরটি আর নেই। ইতিমধ্যে কলকাতা হাই কোর্ট আরাবুলকে সপ্তাহে সোম এবং বৃহস্পতিবার পঞ্চায়েত অফিসে যাওয়ার অনুমতি দেয়। কিন্তু ভাঙড়ে তৃণমূলের রাজনীতি এখন শওকতের নিয়ন্ত্রণে। তাই সভাপতির দায়িত্ব নিতে চাইলেও এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও কিছুই করে উঠতে পারেননি ভাঙড়ের ‘তাজা নেতা’।

কারণ প্রসঙ্গে জানা যায়, জামিন পেতে আরাবুলের আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি আদালতে এমন কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যাতে বেজায় অস্বস্তিতে পড়েছিল কলকাতা পুলিশ ও শাসকদল তৃণমূল। তাই কারাবাসে থাকাকালীনই আরাবুলের যাবতীয় সংগঠনিক দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়ে প্রকাশ্যেই শওকতের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন আরাবুল। তার ভিত্তিতেই তাঁকে আইনি নোটিস পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক। প্রমাণ হিসেবে তিনি আরাবুলের বক্তব্যের ভিডিয়ো জোগাড় করে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন। তবে শওকতের এ-হেন মানহানির মামলা করাকে বিশেষ পাত্তা দিতে নারাজ আরাবুল। তিনি বলেন, ‘‘যার যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারে। যে কেউ আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতেই পারে। এ নিয়ে আমার কোনও মতামত নেই।’’ আরাবুল-অনুগামীদের মতে, শওকতের কাছে কোনও ভাবেই ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন না আরাবুল। তেমনটা না হলে কি এ বার ভাঙড়ের লড়াই পৌঁছবে আদালতের দ্বারে? শীঘ্রই মিলবে জবাব।

Advertisement
আরও পড়ুন