Jiban Krishna Saha

‘কোনও বেআইনি কাজ করতেন’? উত্তর এড়িয়ে পাল্টা কী প্রশ্ন করলেন তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ?

রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে গত ১৭ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তার আগে প্রায় ৬৫ ঘণ্টা ধরে তাঁর দফতর-সহ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৩ ১২:৫১
TMC MLA Jiban Krishna Saha is produced to special CBI court in Alipore on Thursday

নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা। ফাইল চিত্র ।

বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ ওঠার পর হাই কোর্টের নির্দেশে মুর্শিদাবাদের বড়ঞা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের আফ্রিকা মোড়ের সাতটি দোকান সম্প্রতি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, তারই মধ্যে একটিতে মাঝেমধ্যে বসতেন নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে ধৃত তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহা। এই দোকানঘরটিকেই নাকি নির্বাচনী কার্যালয় হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। তবে বৃহস্পতিবার আলিপুর স্পেশাল সিবিআই আদালতে প্রবেশ করার সময় বড়ঞা তৃণমূল বিধায়কের দাবি, ওই অফিস তাঁর ছিল না। পাশাপাশি তিনি এ-ও জানান, নির্মাণ বেআইনি হলে তা ভেঙে ফেলা উচিত।

নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বিচার বিভাগীয় হেফাজত শেষে বৃহস্পতিবার সকালে জীবনকৃষ্ণ-সহ মোট ৯ জনকে আলিপুর স্পেশাল সিবিআই আদালতে পেশ করা হয়। আদালতে প্রবেশ করার সময় জীবনকৃষ্ণকে তাঁর বিভিন্ন অফিস ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে মতামত জানতে চাওয়া হলে উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘বেআইনি হলে তা তো ভাঙবেই।’’

Advertisement

পাশাপাশি তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি নিজে কোনও বেআইনি কাজ করতেন কি না? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর সন্তর্পণে এড়িয়েই যেতে দেখা যায় ধৃত তৃণমূল বিধায়ককে। বদলে তিনি বলেন, ‘‘ওটা আমার অফিস নয়। কে বলল ওটা আমার অফিস?’’ এর পরই আদালতের ভিতরে চলে যান জীবনকৃষ্ণ।

প্রসঙ্গত, বড়ঞার স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ ছিল, বড়ঞা-২ গ্রাম পঞ্চায়েতের আফ্রিকা মোড়ের বাজারে অবৈধ নির্মাণ বানিয়ে রমরমিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছেন পঞ্চায়েত প্রধান এবং তাঁর স্বামী। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে হওয়া মামলায় অবৈধ নির্মাণ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্ট। এর পরই সেই অবৈধ নির্মাণ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেঙে দেওয়া দোকানগুলির মধ্যে একটি জীবনকৃষ্ণের কার্যালয় ছিল বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। যদিও স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, ওই দোকানঘরের সঙ্গে জীবনকৃষ্ণের কোনও সম্পর্ক নেই। জীবনকৃষ্ণ যদি কখনও সেখানে বসেও থাকেন, তবুও সেটিকে কার্যালয় বলে মানতে নারাজ স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। একই কথা বৃহস্পতিবার শোনা গেল জীবনকৃষ্ণের মুখ থেকেও।

আগে যা ঘটেছে

রাজ্যে নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে গত ১৭ এপ্রিল মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তার আগে প্রায় ৬৫ ঘণ্টা ধরে তাঁর দফতর-সহ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চলে। সিবিআই সূত্রে জানা যায়, নিয়োগ ‘দুর্নীতি’র তদন্তে অসহযোগিতা ও তথ্যপ্রমাণ লোপাট করার চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় জীবনকৃষ্ণকে। তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছিল, জীবনকৃষ্ণের দফতর এবং অন্যান্য জায়গায় তল্লাশি চলাকালীন চাকরিপ্রার্থীদের নথির পাশাপাশি এসএলএসটির নিয়োগ প্রক্রিয়ার ‘ডেটাবেস’ও পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে উদ্ধার হয়েছিল প্রায় দু’বস্তা নথি! সিবিআইয়ের একটি সূত্র দাবি করেছিল, তৃণমূল বিধায়কের বাড়ি থেকে প্রায় ৩,৪০০ প্রার্থীর তথ্য উদ্ধার হয়। যার মধ্যে নবম এবং দশমের চাকরিপ্রার্থীদের নাম ও রোল নম্বর-সহ বহু নথি রয়েছে।

জীবনকৃষ্ণের বাড়িতে তল্লাশি চলাকালীন দু’টি নোটপ্যাড বাজেয়াপ্ত করা হয়। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সূত্রে জানা গিয়েছিল, বাড়ির একটি ঘরকেই নিয়োগ দুর্নীতির আস্তানা বানিয়ে রেখেছিলেন জীবনকৃষ্ণ। ওই ঘরকেই ‘ওয়ার রুম’ বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। সেখানে একাধিক কম্পিউটার, বেশ কয়েকটি ল্যাপটপ, তিনটি নোটপ্যাড, হাই স্পিড ইন্টারনেট সংযোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু সফ্‌টঅয়্যারের খোঁজ পাওয়া যায়। কী কাজে এই ঘর ব্যবহার হত, সে বিষয়ে বিধায়ককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল।

তৃণমূল বিধায়কের বিরুদ্ধে এ-ও অভিযোগ ওঠে, বাড়িতে তল্লাশির সময় তিনি দু’টি মোবাইল ছুড়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন। দু’দিন ধরে পাম্প চালিয়ে পুকুর থেকে জল তুলে, কাদা ঘেঁটে মোবাইল দু’টি উদ্ধার করে সিবিআই। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি! কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে দাবি, ফোনের তথ্যে যে বিপদ লুকিয়ে আছে তা অনুমান করেই বছর দেড়েক আগে নিজের দু’টি মোবাইলের তথ্য লোপাট শুরু করেন জীবনকৃষ্ণ। তবে গোয়েন্দাদের দাবি, বিধায়কের অজ্ঞাতেই ‘ডিলিট’ করা তথ্য আধুনিক মোবাইলে থেকে গিয়েছিল।

তদন্তকারীদের দাবি, ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে ওই দু’টি মোবাইল থেকে পুনরুদ্ধার করা তথ্যেও বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীর সুপারিশপত্র পাওয়া গিয়েছে। সেই সঙ্গে মিলেছে দুর্নীতির আরও অনেক তথ্যপ্রমাণ। মিডলম্যান (দালাল) এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে জীবনকৃষ্ণ কী ভাবে নিয়োগে ‘দুর্নীতি’ করেছিলেন সে বিষয়েও নানা তথ্য মিলেছে মোবাইল থেকে। পাওয়া গিয়েছে শতাধিক ভয়েস কলও।

তদন্তকারীদের অনুমান, ২০১৪ সালে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরি বিক্রির এজেন্ট হিসাবে কাজ করতেন জীবনকৃষ্ণ। চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি টাকা তুলতে শুরু করেন বলেও গোয়েন্দাদের একাংশের অভিযোগ। সিবিআই সূত্রে খবর, জীবনকৃষ্ণের বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট থেকে বহু টাকার লেনদেনের হিসাব পাওয়া গিয়েছে। বিধায়কের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী টগর সাহার নামেও একাধিক অ্যাকাউন্টের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সেই সব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টগুলিও ফ্রিজ় করেছে সিবিআই।

জীবনকৃষ্ণের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তিরও খোঁজ পাওয়া গিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সূত্রে জানা গিয়েছে। সাঁইথিয়ায় একাধিক সম্পত্তিও রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সেই জমির আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় চার-পাঁচ কোটি টাকা। শুধু সাঁইথিয়াতেই নয়, বোলপুরের অন্যান্য জায়গাতেও এই তৃণমূল বিধায়কের আনুমানিক প্রায় ৬ কোটি টাকা বাজারমূল্যের জমি রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে খবর। সরকারি নথি অনুযায়ী, জীবনকৃষ্ণের নামে এই সমস্ত জমি রেকর্ড হয়েছে ২০১৩-২০২২ সালের মধ্যে। জীবনকৃষ্ণের স্ত্রী টগরের নামেও আন্দি বাজার এলাকায় জমি এবং বাড়ি আছে। যার বর্তমান মূল্য প্রায় দু’কোটি টাকা।

বীরভূমে রাজনীতির বৃত্তে থাকাদের একাংশের দাবি, জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে বিশেষ দহরম-মহরম ছিল জীবনকৃষ্ণের। আর সেই সূত্রেই তাঁর যাবতীয় ‘লক্ষ্মীলাভ’! ২০১২-১৩ সাল থেকে কৃষ্ণ-কেষ্ট আঁতাঁত তৈরি হয় বলেও অনেকে দাবি করছেন।

এর আগে গত ২৫ মে আলিপুর আদালতে সশরীরে ভারপ্রাপ্ত সিজিএমের এজলাসে হাজির করানো হয়েছিল ধৃত তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণকে। সেখানে ছিলেন জীবনকৃষ্ণের স্ত্রী এবং পরিবারের অন্য সদস্যেরাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement