Calcutta High Court

কিশোরীদের সংযম-উপদেশ: সুপ্রিম কোর্টে সমালোচিত হাই কোর্টের রায়ের নেপথ্যে কোন কাহিনি

যে মামলাটি নিয়ে বিতর্ক, তার রায় গত অক্টোবরে দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাস এবং বিচারপতি পার্থসারথি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ। তবে ঘটনার শুরু তারও মাস চারেক আগে।

Advertisement
ভাস্কর মান্না
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৪৯

—ফাইল চিত্র।

শুক্রবার সকালে কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই পর পর ঘটে যায় কয়েকটা ঘটনা। কলকাতা হাই কোর্টের একটি রায়ের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা করে সুপ্রিম কোর্ট। দুপুরে সেই মামলার শুনানি হয়। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, যৌন নিগ্রহের একটি মামলায় কলকাতা হাই কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছে, তা ‘অত্যন্ত আপত্তিকর’। একই সঙ্গে অনাবশ্যকও। হাই কোর্ট ওই মামলার রায়ে কিশোর-কিশোরীদের যৌন আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। এই মন্তব্য নিয়েই আপত্তি তুলে সুপ্রিম কোর্ট বলে, বিচারপতিরা তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত বা দর্শনের ভিত্তিতে এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। কিন্তু কী কারণে কলকাতা হাই কোর্টের দুই বিচারপতি তাঁদের কর্তব্যে বেপথু হলেন? কেনই বা এমন মন্তব্য করলেন তাঁরা? কারণ খুঁজতে গিয়ে এক অদ্ভুত কাহিনির সন্ধান পেল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

যে মামলাটি নিয়ে বিতর্ক, তার রায় গত অক্টোবরে দিয়েছিল কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি চিত্তরঞ্জন দাস এবং বিচারপতি পার্থসারথি সেনের ডিভিশন বেঞ্চ। তবে ঘটনার শুরু তারও মাস চারেক আগে। কলকাতা হাই কোর্টের অলিন্দে যাতায়াতের পথে রোজই এক কমবয়সি মাকে শিশু কোলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতেন বিচারপতি দাস। মেয়েটির চুল উসকোখুসকো। পরনের শাড়িও মলিন। আর চোখে একরাশ উদ্বেগ। প্রত্যেকদিনই তাঁকে আদালতে বিচারকক্ষের বাইরে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দেখতে পেতেন। কিন্তু বুঝতে পারতেন না, কেন মেয়েটি ভিতরে আসে না, কেনই বা শোনা হচ্ছে না তার মামলা। এ ভাবেই বেশ কিছুদিন দেখার পর একদিন মেয়েটিকে এজলাসের ভিতরে নিয়ে আসার নির্দেশ দেন বিচারপতি দাস। জানতে চান, তাঁর সমস্যা কী? তিনি কি কোনও মামলা করতে চান বা করেছেন?

মেয়েটি কোনও মতে বিচারপতির সামনে দাঁড়িয়ে যা বলে, তার এক বর্ণও প্রথমে বুঝতে পারেননি বিচারপতি দাস। তিনি ওড়িশার মানুষ। মাতৃভাষা ছাড়া আদালতের কাজ মূলত ইংরেজিতেই সারেন। বাংলা সামান্য বুঝলেও এই মেয়েটির কথা বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু বিচারপতিকে জানতে হবে কী ঘটেছে? তিনি এক আইনজীবীকে বলেন সাহায্য করতে। জানতে পারেন, মেয়েটি একজন যৌন নির্যাতিতা। তবে তিনি নির্যাতনকারীর হয়েই কথা বলতে এসেছেন আদালতে। আদালতকে তিনি জানাতে চান, নির্যাতনকারীর কোনও দোষ নেই। তিনি যা করেছেন, তা তাঁর সম্মতিতেই করেছেন!

শুনে বিস্মিত হন বিচারপতি। নির্যাতিতা বলে চলেন, নির্যাতনকারী আসলে তাঁরই স্বামী। কোলের সন্তানটি তাঁদের দু’জনেরই। পরিবারের অমতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু তিনি নাবালিকা হওয়ায় তাঁর স্বামী পকসো আইনে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। নিম্ন আদালত ২০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে তাঁকে। তিনি গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে জেলে। আর এখন জুলাই মাস। আদালতকে ওই নাবালিকা জানান, গত ১০ মাস স্বামীকে ছাড়া এই শিশু সন্তান এবং শাশুড়িকে নিয়ে থাকছেন তিনি। শাশুড়ি ক্যানসারের রোগী। প্রায় শেষ অবস্থা। তিনিই তাঁর অভিভাবক। কিন্তু কোনও বিপদ এলে তাঁর কিছু করার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে আড়াই জনের পেট চালানোর অর্থও নেই। এই পরিস্থিতিতে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন সুরাহা চেয়ে। কারণ তিনি শুনেছেন, কিছু সমাধানের সুযোগ থাকলে এই আদালতেই তা সম্ভব হতে পারে।

নির্যাতিতার এই বক্তব্য শোনার পরই এই নিয়ে মামলা হয় হাই কোর্টে। মামলা চলাকালীন আদালতকে নির্যাতিতা জানিয়েছিলেন, আইন সম্পর্কে তাঁরা জানতেন না বলেই ভুল করে ফেলেছেন। জানলে হয়তো করতেন না। সম্প্রতি সেই মামলাতেই পকসো আইনে ২০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ওই যুবককে বেকসুর খালাস করেন দুই বিচারপতি। সেই সঙ্গে নিগৃহীতার উদ্দেশে তাঁরা বলেন, ‘‘কিশোরীদের নিজের শরীরে অধিকার, সম্মান এবং নিজের মূল্য রক্ষা করতে হবে। যৌন উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ দু’মিনিটের সুখের জন্য সেই নিয়ন্ত্রণ হারালে সে-ই সমাজের চোখে ‘ব্যর্থ’ হবে। নিজের গোপনীয়তা এবং শরীরের অধিকার নিজেকেই রক্ষা করতে হবে।’’ হাই কোর্টের এই নির্দেশ এবং মন্তব্য নিয়েই আপত্তি তুলে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, মামলা শোনার পর ন্যায্য রায়ই দেওয়া উচিত বিচারপতিদের। সেই রায় যেন কখনওই বিচারপতির ব্যক্তিগত মতামত বা দর্শন দ্বারা প্রভাবিত না হয়।

সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, হাই কোর্টের রায়ের নথিতে নানা জায়গায় ‘আপত্তিকর এবং অনাবশ্যক’ বক্তব্য রয়েছে। যা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১-এ বর্ণিত কিশোর-কিশোরীদের অধিকারের ‘পরিপন্থী’। স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে দায়ের হওয়া মামলায় নোটিসও দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার, অভিযোগকারিণী এবং অভিযুক্তকে।

আরও পড়ুন
Advertisement